
বিদেশে পালাচ্ছেন জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) জালিয়াতির ঘটনায় অভিযুক্তরা। ধরাছোঁয়ার বাইরে রাঘববোয়ালরাও। রোহিঙ্গাদের এনআইডি দেওয়ার পেছনে ইসির ১৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ অন্তত ২৫ জন জড়িত বলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রতিবেদন দেয়। কিন্তু প্রতিবেদন দেওয়ার এক সপ্তাহ পরও আইনের আওতায় আসেননি অধিকাংশ অভিযুক্ত। আবার অভিযুক্তদের মধ্যে সাতজনের ব্যাংক ব্যালান্সসহ সম্পদ অনুসন্ধান শুরু করার অনুমতি চেয়েছিল চট্টগ্রাম দুদক। গত ২২ সেপ্টেম্বর এটির অনুমোদনও দিয়েছে কেন্দ্রীয় দুদক। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত তাদের কারও বিরুদ্ধে ইস্যু করা হয়নি নোটিশ। করা হয়নি জিজ্ঞাসাবাদও। উল্টো চট্টগ্রাম দুদকের তিন সদস্যের যে এনফোর্সমেন্ট টিম এনআইডির এ জালিয়াতি উদ্ঘাটন করেছিল; তাদের তিনজনকেই সরিয়ে দেওয়া হয়েছে তদন্ত প্রক্রিয়া থেকে। প্রসঙ্গত, জালিয়াতির এ ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে পুলিশ এখন পর্যন্ত আটজনকে গ্রেফতার করলেও তাদের মধ্যে দুদকের সন্দেহভাজন অভিযুক্ত আছেন মাত্র চারজন।
জানতে চাইলে দুদক চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিচালক মাহমুদ হাসান বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কে কীভাবে দায়িত্ব অবহেলা করেছেন সেটি উল্লেখ করে আমরা প্রতিবেদন পাঠিয়েছি ঢাকায়। সন্দেহভাজন সাতজনের সম্পদ অনুসন্ধানের অনুমতিও চাওয়া হয়েছে ঢাকা থেকে। এখন এ বিষয়ে পরবর্তী করণীয় ঠিক করবে আমাদের ঢাকা অফিস।’ চট্টগ্রাম দুদকের তিন সদস্যের এনফোর্সমেন্ট টিমকে তদন্ত প্রক্রিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘এনআইডি জালিয়াতির ঘটনা তদন্তে ভবিষ্যতে কারা থাকবেন সে ব্যাপারে এখনও কোনো নির্দেশনা আসেনি আমাদের কাছে। ঢাকা অফিস যাকে রাখবে আমরা তাকে নিয়েই কাজ করব।’ তিন সদস্যের এই টাস্কফোর্স টিমে ছিলেন দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-২ এর সহকারী পরিচালক রতন কুমার দাশ, উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন ও উপ-সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ জাফর সাদেক শিবলী। তাদের কেউই এখন কাজ করছেন না এনআইডি নিয়ে। জানতে চাইলে এনফোর্সমেন্ট টিমের সদস্য মো. শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘আমরা এখন এ ব্যাপারে বক্তব্য দেওয়ার দায়িত্বশীল কেউ নই।’ এ প্রসঙ্গে আর কোনো কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান তিনি।
বিদেশ পালাচ্ছেন অভিযুক্তরা :কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার পেছনে ইসির ১৫ কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ অন্তত ২৫ জন জড়িত বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে দুদক। গত ১৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পাঠানো এ প্রতিবেদনে দুই নির্বাচন কর্মকর্তাসহ সাতজনের সংশ্নিষ্টতার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ায় তাদের সম্পদ অনুসন্ধানেরও অনুমতি চান চট্টগ্রাম দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তারা। এতে চট্টগ্রাম জেলার জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মুনীর হোসাইন খান ও চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ শেখের নাম রয়েছে। লতিফ শেখ বর্তমানে পাবনার জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। অন্যরা হলেন- ঢাকা এনআইডি প্রজেক্টের টেকনিক্যাল এক্সপার্ট সাগর, একই শাখার সাবেক টেকনিক্যাল এক্সপার্ট সত্যসুন্দর দে, চট্টগ্রামের পটিয়ার বড় উঠান ইউনিয়নের শাহানুর মিয়া, সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাচন অফিসের অস্থায়ী অপারেটর জনপ্রিয় বড়ুয়া (পটিয়া উপজেলা নির্বাচন অফিসের অফিস সহকারী রাসেল বড়ুয়ার চাচাত ভাই) ও চট্টগ্রাম ডবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীন। তাদের মধ্যে সাগর ও সত্যসুন্দর দে এরই মধ্যে ভারত পালিয়ে গেছেন বলে ধারণা করছেন দুদকের এনফোর্সমেন্ট শাখার এক কর্মকর্তা। এ বিষয়ে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. শহীদুল্লাহ বলেন, ‘সাগর ও সত্যসুন্দর দেকে গ্রেফতার করতে একাধিকবার অভিযান চালিয়েছিলাম আমরা। তাদের কোনো হদিস পাচ্ছি না কোথাও।’
ধরাছোঁয়ার বাইরে অন্যরাও :এনআইডি জালিয়াতিতে শাহনূর ও জয়নালকে পুলিশ গ্রেফতার করতে সক্ষম হলেও এ দুইজনের সিন্ডিকেটে থাকা সবাই ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ দুদকের প্রতিবেদনে নাম আছে শাহনূরের খালাতো ভাই কক্সবাজার সদর নির্বাচন অফিসের অপারেটর নঈম ইসলাম, বোয়ালখালী নির্বাচন অফিসের অপারেটর শাহ আলম, শাহনূরের খালাতো দুই বোন ইয়াছমিন আক্তার রূপা, ফারজানা আক্তার, ভাগ্নে শহিদ উল্লাহ, ভাগ্নে শারমিন, জেঠাতো ভাই শাহেদ, তার বন্ধু রামু নির্বাচন অফিসের অপারেটর হিরু ও পাঁচলাইশ নির্বাচন অফিসের অপারেটর তাছলিমা আক্তার। দুদক বলছে আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান আইপিএলের কর্মকর্তা দ্বিজেন দাশের মাধ্যমে আর্থিক সুবিধা দিয়ে তাদের সবাইকে কমিশনে নিয়োগ দিয়েছেন শাহনূর মিয়া। অন্যদিকে জয়নাল আবেদীনের সিন্ডিকেটেও তার ছয় থেকে আটজন আত্মীয়স্বজন নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন কার্যালয়ে কাজ করছেন বলে উল্লেখ করে দুদক। তাদের মধ্যে রয়েছেন তার আত্মীয় নুর আহমেদ, বোনজামাই বয়ান উদ্দিন। রিশি, সৈকত বড়ূয়া, শাহ জামাল ও পাভেল বড়ূয়াও ছিল জয়নালের অবৈধ কাজের সহযোগী।
গ্রেফতারদের বেশির ভাগই চুনোপুঁটি :এনআইডি জালিয়াতিতে জড়িত সন্দেহে গ্রেফতার হওয়া জয়নাল আবেদীন, শাহনূর মিয়া, মোস্তফা ফারুক ও পাভেল বড়ূয়া ছাড়া সবাই চুনোপুঁটি। এই চারজনের নাম দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে থাকলেও বাকি চারজনের নাম ছিল না। তবে পুলিশ বলছে জয়নাল ও মোস্তফার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে নাম আসায় অন্যদেরও গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা হচ্ছেন কোতোয়ালি থানা নির্বাচন অফিসের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মো. শাহীন, বন্দর থানার ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মো. জাহিদ, জয়নালের বন্ধু বিজয় দাশ ও তার বোন সীমা দাশ ওরফে সুমাইয়া। শেষের দু’জন নির্বাচন কমিশন অফিসের বাইরের লোক।
পাঠকের মতামত