প্রকাশিত: ১৬/১১/২০১৬ ১১:২১ পিএম

শাহেরীন আরাফাত

সোমবার মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশের টেকনাফ শরণার্থী শিবিরে পালিয়ে আসা ১৯ বছর বয়সী রোহিঙ্গা তরুণ মোহাম্মদ তৌহিদ ফোনে এএফপি-কে জানান, ‘তারা (সেনাবাহিনী) আমার চোখের সামনে আমার বোনকে গুলি করে হত্যা করেছে। হামলা চালানোর সময় আমি গোবরের নিচে লুকিয়ে ছিলাম। রাত গভীর হওয়ার পর আমি সেখান থেকে সীমান্তে পালিয়ে আসি।’মিয়ানমারের সেনাবাহিনী জ্বালিয়ে দেয় রোহিঙ্গাদের গ্রাম

ওই তরুণ আরও বলেন, ‘আমি আমার মা-কে বাড়িতে একা ফেলে এসেছি। তিনি বেঁচে আছেন কিনা, আমি তাও জানি না।’ তিনি আরও জানান, সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের শতশত ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে।

মিয়ানমারের মুসলিম অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যের গ্রামগুলোতে গত কয়েকদিনের হামলায় অন্তত ৬৯ জন রোহিঙ্গা হত্যার কথা স্বীকার করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। তবে নিহতের প্রকৃত সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি হবে বলে আশঙ্কা করছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো।

চলতি বছর অক্টোবরের ৯ তারিখে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি চেকপোস্টে সন্ত্রাসীদের হামলায় নয় পুলিশ সদস্য নিহত হন। এরপর মিয়ানমারের সরকার হামলাকারীদের খোঁজে ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’ শুরু করে। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী রাখাইন রাজ্যে জাতিগত দমনপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সেখানে ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়া, নারীদের ধর্ষণসহ নানান ধারার শারীরিক ও মানসিক নিপীড়ন চলছে। ২০১২ সালে ওই রাজ্যের জাতিগত দাঙ্গায় শতাধিক রোহিঙ্গা মুসলিম নিহত হওয়ার পর সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে সেখানে চরম উত্তেজনা দেখা গেছে।

টেকনাফ শরণার্থী শিবিরে এক রোহিঙ্গা শরণার্থী আলজাজিরা-কে বলেন, ‘সেনাবাহিনী গ্রামে হামলা চালালে পুরুষরা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। আর যে নারীরা পালাতে পারেনি, তাদের সেনাসদস্যরা ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে।’

তিনি আরও জানান, ‘তারা (সেনাবাহিনী) আমাদের গ্রাম থেকে ৩০ জন নারীকে গ্রেফতার করে। আর আমার ২৩ বছর বয়সী ছোট বোনসহ ১৯ জনকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করে। আমার বোন এখন চলতেও পারছে না। পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত আরও খারাপ হচ্ছে।’রোহিঙ্গাদের গ্রামে পুনর্বাসন করা হচ্ছে অন্য জায়গার রাখাইনদের

রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদের জন্য স্থানীয় রাখাইন জনগোষ্ঠীকেও ব্যবহার করা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের যেসব জায়গা থেকে উচ্ছেদ করা হয়, সেখানে পুনর্বাসন করা হয় অন্য স্থান থেকে আনা হয় রাখাইনদের। কি কান পিন গ্রামের ঘরহারা এক রোহিঙ্গা আলজাজিরাকে বলেন, ‘সেনাবাহিনী গ্রামে হামলা করার পর রাখাইন প্রতিবেশীরাই আমাকে এবং আমার পরিবারকে নিজবাড়ি থেকে বের করে দেয়। তারা জানান, আমরা সেখান থেকে চলে না গেলে আমাদের হত্যা করা হবে। এরপর ঘরহারা আমি সেখান থেকে চলে আসি।’

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক হামলার সবচেয়ে বড় লক্ষ্য রাখাইন প্রদেশের মংডু শহরের নিকটবর্তী উত্তরের গ্রামগুলো। মংডু থেকে ৪২ কিলোমিটার দূরবর্তী নাখুরা গ্রামের স্থানীয় স্কুলের এক শিক্ষক নিজের নাম না প্রকাশ করে ফরাসি বার্তাসংস্থা এএফপি-কে জানান, সেনাবাহিনীর আক্রমণের সময় স্কুলের ২০ জন কর্মী এবং শিক্ষার্থীরা একটি বাড়িতে লুকিয়ে ছিলেন।

তিনি বলেন, ‘আমরা দুইদিন ধরে কিছু খাইনি। এখানকার অবস্থা ভালো নয়। চারিদিক থেকে সংঘর্ষের খবর পাওয়া যাচ্ছে। আমরা ঘরের বাইরে যাওয়ার সাহসটুকুও করছি না।’

রোহিঙ্গাদের সাগরে মাছ ধরার জন্যও অনুমতির দরকার হয়। গত মাসেই থায় চাউং চেকপয়েন্টের পুলিশ কর্মকর্তারা রোহিঙ্গা যুবক আবদু জলিলকে আন্দামান সাগরে মাছ ধরার অনুমতি দেন। কিন্তু এর এক সপ্তাহ পর যখন সাগরে তিনি মাছ ধরছিলেন, তখন মিয়ানমার নৌবাহিনী তাদের নৌকা আটক করে।

জলিল কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা-কে বলেন, ‘তারা আমার নৌকা, জাল এবং অন্যান্য সরঞ্জাম আটক করে নিয়ে গেছে। আমার ছয়জন ক্রুসহ আমাকে তারা বেঁধে পেটায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি ভীষণ ভয়ে আছি। তারা (সেনাবাহিনী) আবার ফিরে আসতে পারে। তাদের কাছে আমাদের নাম, ঠিকানা এবং ছবি রয়েছে।’

.

” onclick=”return false;” href=”http://cdn.banglatribune.com/contents/cache/images/800x0x1/uploads/media/2016/11/16/4735fb22662ad4e6ecec4be2b4fa9fb3-582c5d899eb75.jpg” title=”” id=”media_2″ class=”jw_media_holder media_image jwMediaContent aligncenter”>রোহিঙ্গাদের ওপর হামলারত মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় বাহিনী

মিয়ানমারের লক্ষাধিক রোহিঙ্গা সেখানকার শরণার্থী শিবিরে বন্দি। এক শরণার্থী শিবিরের নেতা রেডিও ফ্রি এশিয়া-কে  জানান, শরণার্থী শিবিরের অবস্থা ভালো নয়। এখানে চারিদিকে বিভিন্ন ব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে।

ওই শরণার্থী নেতা আরও বলেন, ‘আমরা প্রায় সবাই এক কাপড়ে পালিয়ে এসেছি। আমাদের পরার মতো কাপড় নেই। চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধও এখানে নেই।’

অপর এক শরণার্থী নাম প্রকাশ না করে বলেছেন, ‘এখানকার শরণার্থীদের মধ্যে শিশুদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। তাদের প্রয়োজনীয় ওষুধ, খাবারও দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’

এক বৃদ্ধা জানান, তার ভাগ্য ভালো ছিল, তাই তিনি প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার এক ছেলে গ্রাম থেকে খাবার আনতে গেলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাকে হত্যা করে। চারিদিকে ল্যান্ডমাইন ছড়িয়ে রাখা হয়েছে যেন কেউ পালিয়ে আসতে না পারে। আমি এবং আমার পরিবারের অপর ১০ সদস্য পালিয়ে আসতে সক্ষম হই।’

.

” onclick=”return false;” href=”http://cdn.banglatribune.com/contents/cache/images/800x0x1/uploads/media/2016/11/16/b54c7f0d10f5145855aad894a22ce41b-582c5d87f0a2d.jpg” title=”” id=”media_3″ class=”jw_media_holder media_image jwMediaContent aligncenter”>আটকা পড়া রোহিঙ্গা (ফাইল ফটো)

মিয়ানমারের কেন্দ্র সরকার ও রাখাইন রাজ্য সরকার রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবতা প্রদর্শনকেও অস্বীকার করেছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মুসলিম বিদ্বেষও সুস্পষ্ট। ৮ নভেম্বর রাখাইন রাজ্য সরকারের নির্বাহী সচিব টিন মং সুয়ে রাষ্ট্রীয় রেডিওতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। আর এই মুসলিমরা তার অংশ নয়। তোমরা বিদেশিরা কি মনে করো, আমরা তার পরোয়া করি না। আমাদেরকে অবশ্যই নিজভূমি রক্ষা করতে হবে। এরপরে আসবে মানবতার কথা।’

উল্লেখ্য, জাতিসংঘ ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের বিশ্বের ‘সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী’ বলে ঘোষণা করেছে।

‘গণতন্ত্রপন্থী’ নেত্রী অং সান সু চি এবং তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসিও এর বাইরের কেউ নয়। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তারা ক্ষমতায় আসার পরও বাস্তবতায় কোনও হেরফের হয়নি। বরং নির্বাচনের আগে-পরে ফাঁস হয়েছে খোদ সু চির মুসলিমবিদ্বেষের নানা দিক। নির্বাচনে তিনি মুসলমানদের প্রার্থীও করেননি। ‘রোহিঙ্গা’ পরিচয়টিও অস্বীকার করেন সুচি।

সূত্র: এএফপি, আলজাজিরা, রেডিও ফ্রি এশিয়া, বিবিসি

পাঠকের মতামত