
ডেস্ক রিপোর্ট ::
ইয়াসমিন । বয়স চৌদ্দ পনের’র কৌটায় । আরাকানের মংডু উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। ক্লাসের রোল নম্বর ছিল ২ । শুধু মেধাবী নয়, তুখোড় মেধাবী শিক্ষার্থীর এক উদাহরণ ছিল এ মেয়েটি । জীবনের লক্ষ্য ছিল ডাক্তার হওয়া । আরাকানের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির হতদরিদ্র বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে নিজ হাতে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার স্বপ্ন দেখছিল মেয়েটি । কিন্তু ২৪ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া ভয়াবহ সেনা বর্বরতায় সব স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল ইয়াসমিনের । অন্য দশজন রোহিঙ্গার মত ইয়াসমিনের পরিবারও প্রাণ বাঁচাতে চলে যায় বাংলাদেশে । হয়ে যায় ভাগ্যবিড়ম্বিত রোহিঙ্গা শরণার্থী ।
আরাকান টিভি’র সংবাদদাতার সাথে কক্সবাজার কুতুপালং-এ কথা হয় ইয়াসমিনের । ইয়াসমিন জানান, তার বাবা জহির উদ্দিন ছিলেন মংডুর হাইন্দা পাড়া এলাকার সাবেক চেয়ারম্যান । মা মসুদা খাতুন ছিলেন গৃহিণী । এলাকায় তাদের সুপরিচিত ছিল । তাদের পরিবারের সদস্যদের লোকেরা সম্মান করতো । অর্থ প্রতিপত্তি ছিল । বহু জায়গা-জমি ছিল । কিন্তু বর্মী সেনাবাহিনীর কালো থাবা সব নিঃশেষ করে দিয়েছে ।
ইয়াসমিন আরো জানান, ৭ ভাইবোনের মধ্যে সে ২য় । লেখাপড়ার প্রতি অদম্য ইচ্ছা আর প্রতিক্লাসে কৃতিত্ব অর্জনের কারনে বাবা-মা দু’জনই তাকে খুব আদর করতেন । এমনকি সহপাঠিদের মধ্যেও তার আলাদা একটা গুরুত্ব ছিল । বাবা-মা দু’জনই শিক্ষিত হওয়ায় তাকে লেখা পড়ার প্রতি অনুপ্রেরণা যোগাতেন। তার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন পূরণে উৎসাহ দিতেন বাবা ।
ইয়াসমিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “ পঁইস তারিখ শুক্কুবারে আঁর বাবারে দরি নিগিয়ই মেলিটেরীঅলে । তারপত্তুন বাবারে আর তোয়ায় ন’পাই । বাবা বাঁচি আছেনে মরি গিয়য় হইত্ নপারি” । অর্থ্যাৎ ২৫ আগস্ট শুক্রবার আমার বাবাকে ঘর থেকে ধরে নিয়ে যায় মিলিটেরীরা । তারপর থেকে আর বাবার খোঁজ পায়নি । বাবা বেঁচে আছেন, না মারা গেছে তাও জানিনা ।
কিছুক্ষণ গুঙ্গিয়ে নিরবে চোখের পানি ঝরান ইয়াছমিন । তারপর আবার বলা শুরু করেন। তার বলা কথাগুলোর অনুবাদ হুবহু এরকম । বার্মায় রোহিঙ্গাদের পড়াশুনার তেমন সুযোগ সুবিধা নেই । কেউ পড়তে চাইলে তাকে মঘের নাম দিয়ে স্কুলে ভর্তি হতে হয় । পড়ালেখায়ও বৈষম্য করে রাখাইন ছাত্র ও শিক্ষকরা । “ক্বলা ছা” বলে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে ।
ক্বলা ছা মানে কি জানতে চাইলে ইয়াছমিন বলেন, ‘ক্বলা’ মানে বাঙ্গালি আর ছা মানে বাচ্চা অর্থাৎ বাঙ্গালীর বাচ্ছা । সে জানাই, রোহিঙ্গাদের হেয় করে অপমানজনকভাবে রাখাইন ও বর্মীরা এটা বলে থাকে ।
ইয়াছমিন বলেন, সব অপমান সয়েও আমরা বেশ ক’জন রোহিঙ্গা ছাত্রছাত্রী পড়ছিলাম । কিন্তু এবছর থেকে রোহিঙ্গা ছাত্রছাত্রীদের জাতিয় কোন দিবসের প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে দেয়নি । সামনে থেকে স্কুলে ভর্তি করা হবেনা বলে ঘোষণাও দিয়েছে ।
ইয়াছমিন বলেন, এত এত বৈষম্যের পরও রোহিঙ্গা ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করে । গত বছরের অক্টোবরের সহিংসতার পরও মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশ নিয়ে অনেকজন গুন্ডা (জিপিএ ফাইভ) পেয়েছে । পরীক্ষা দিতে পারলে এবার আমিও গুন্ডা নিতে পারতাম।
ইয়াসমিন আবারো দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলে বলেন, “আমার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন আর কোন দিনও পূরণ হবেনা !”
ইয়াসমিন ও তা ছোট পাঁচ ভাইবোন, বড় ভাই ও মা এখন শুধু মাথা গুজার ঠাঁই খুঁজে বেড়াচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে । হয়তো আশ্রয়ের ঝুপড়ি পেয়ে যাবে কিছু দিনের মধ্যে। কিন্তু তার ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন কি সে আবার দেখতে পারবে? বাবার ইচ্ছে পূরণের সুযোগ কি তার হবে ? সে কি পাবে এমন এক বিদ্যালয় যেখানে তাকে আর কোন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবেনা কেউ? এইসব প্রশ্ন কি শুধু প্রশ্নবোধক চিহ্নই হয়ে থাকবে নাকি তার কোন উত্তর মিলবে?
সুত্র : আরকান টিভি
পাঠকের মতামত