

রোহিঙ্গা সংকটের আট বছর পূর্তিতে কক্সবাজারে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সংলাপে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গাদের দ্রুত, নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য সাত দফা রূপরেখা ঘোষণা করেছেন। একই সঙ্গে তিনি বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, মিয়ানমারের জান্তা ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নির্মূলের ভয়াবহ পরিকল্পনা থেকে বিরত রাখতে সম্মিলিত পদক্ষেপ নিতে হবে।
সোমবার (২৫ আগষ্ট) সকালে কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছে ইনানীর হোটেল বে–ওয়াচে আয়োজিত তিন দিনব্যাপী ‘স্টেকহোল্ডারস ডায়ালগ: টেক অ্যাওয়ে টু দ্য হাই-লেভেল কনফারেন্স অন দ্য রোহিঙ্গা সিচুয়েশন’-এর মূল অধিবেশনে যোগ দেন প্রধান উপদেষ্টা। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে উদ্বোধনী বক্তব্যে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের জীবন রক্ষা করা এবং জাতিগত নিধন প্রতিরোধ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। তবে সংকটের মূলোৎপাটন মিয়ানমারেই ঘটাতে হবে। বাংলাদেশ স্থিতিশীল আছে এবং নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। এই সংলাপ প্রত্যাবাসনের রোডম্যাপ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
ড. ইউনূস তাঁর প্রস্তাবিত রূপরেখায় উল্লেখ করেন, রোহিঙ্গাদের মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন জরুরি। এজন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনার অর্থায়নের ঘাটতি পূরণ করতে হবে এবং দীর্ঘমেয়াদি তহবিল গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ও আরাকান আর্মিকে সহিংসতা বন্ধে বাধ্য করতে হবে এবং উত্তেজনা প্রশমনে অন্তর্ভুক্তিমূলক সংলাপ চালু করতে হবে। সীমান্ত অপরাধ দমনে আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে, জাতিগত নিধনের বিরুদ্ধে স্পষ্ট ও কঠোর অবস্থান নিতে হবে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রক্রিয়া শক্তিশালী করে গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
সম্মেলনে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও রোহিঙ্গা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পর্কিত।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম জানান, বাংলাদেশের সীমিত সম্পদ দিয়ে এত দীর্ঘ সময় ধরে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। ইউএনএইচসিআরের সহকারী হাই কমিশনার রাউফ মাজু প্রতিশ্রুতি দেন, আন্তর্জাতিক সহায়তা অব্যাহত থাকবে।
সংলাপে অংশ নেওয়া রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা সরাসরি বিদেশি কূটনীতিকদের সামনে তাঁদের দুঃখ–কষ্ট ও প্রত্যাবাসনের আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরেন। এক তরুণ রোহিঙ্গা প্রতিনিধি বলেন, আমরা বাংলাদেশে আশ্রিত, কিন্তু এখানে আমাদের ভবিষ্যৎ নেই। আমাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে মিয়ানমারে। জাতিসংঘের প্রতিনিধি সভায় মন্তব্য করেন, রোহিঙ্গা সংকট শুধু বাংলাদেশের নয়, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি জানান, তাদের পক্ষ থেকে মানবিক সহায়তা অব্যাহত থাকবে, তবে সমাধানের জন্য মিয়ানমারের ওপর আরও রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করতে হবে।
এর আগে এক মিনিট নীরবতা পালন করে স্মরণ করা হয় ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের ‘রোহিঙ্গা গণহত্যা দিবস’। এতে প্রদর্শিত হয় রোহিঙ্গাদের দুর্দশা ও সংগ্রাম নিয়ে একটি তথ্যচিত্র।
তবে স্থানীয়দের দাবি, আর কথা বা পরিকল্পনা না, এখন সময় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের। তাঁদের মতে, শুধু আলোচনা নয়, নতুন কোনো রোহিঙ্গা যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য সীমান্ত কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ জরুরি। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা এই সংকট যদি দ্রুত সমাধানে না পৌঁছায়, তবে কক্সবাজারে বড় ধরনের সামাজিক ও নিরাপত্তাজনিত অস্থিতিশীলতা তৈরি হতে পারে।
আয়োজক সূত্রে জানা গেছে, এই আন্তর্জাতিক সংলাপে বিশ্বের অন্তত ৪০টি দেশের কূটনীতিক, আন্তর্জাতিক সংস্থা, গবেষক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক ও রোহিঙ্গা নেতারা অংশ নিচ্ছেন। এখানকার সুপারিশগুলো আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিতব্য উচ্চপর্যায়ের সম্মেলনে উপস্থাপন করা হবে, যেখানে ১৭০টিরও বেশি দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন।
মঙ্গলবার (২৬ আগষ্ট) সম্মেলনের শেষ দিনে বিদেশি অতিথিরা উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প সরেজমিনে পরিদর্শন করবেন। তাঁরা শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলবেন, বাস্তব পরিস্থিতি দেখবেন এবং প্রত্যাবাসনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় এই অভিজ্ঞতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
পাঠকের মতামত