প্রকাশিত: ০৬/০১/২০২২ ৯:৫৯ এএম

সৌদি আরবে ওমরা বা হজ সম্পাদন শেষে হাজিরা ইতিহাস-ঐতিহ্যের নিদর্শন দেখতে তায়েফে আসেন। আমার ভ্রমণপিপাসু মন সুযোগ পেলেই ওড়তে চায়। তাই দেরি না করে ছুটলাম। পবিত্র মক্কা থেকে তায়েফ প্রায় ৯১ কিলোমিটার পূর্ব-পশ্চিম কোনাকুনি। কাবা শরিফ দেখে যেকোনো মুসলমানের অন্তর শীতল থাকে, সেই শীতলতা সঙ্গী করে প্রভুর দেওয়া প্রাকৃতিক ও মক্কার আধুনিক স্থাপত্য দেখতে দেখতে পথ চলছি। রাস্তার দুই ধারে সুউচ্চ পাথুরে পাহাড়, এ বিশাল পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে মহাসড়ক। কিছুদূর যেতে চোখে পড়ে দীর্ঘতম উড়ালসড়ক। সত্যি অবাক না হয়ে উপায় নেই। এত নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে এ দূরদর্শী পরিকল্পনার প্রশংসা করতে হয়।

চলার পথে চোখ যতদূর যায় দেখলাম শুধু ধু-ধু মরুভূমি। কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে বসতি নেই। তবে মরুরচরে উট আর দুম্বার দেখা মেলে। রাস্তার ধারে চিরল পাতার খেজুরগাছ ছাড়া বৃক্ষ বলতে ছোট পাতার বাবলা গাছ, যে গাছ ধূলিঝড়ে ধুলা আটকায়। প্রায় এক ঘণ্টা জার্নি শেষে শরীরে শীত শীত অনুভব করলাম, আবহাওয়ার তারতম্যেই জানান দিলÑ আমি তায়েফ এরিয়ার কাছাকাছি। এবার শুরু, তবে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ। আলো ঝলমলে রাস্তার দুই পাশ গাড়ি চলছে ঝকঝকে-চকচকে পিচঢালা পথে। একটু পরে অনুভব করলাম, গাড়ি উড়োজাহাজের মতো ওপরের দিকে উড়ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৬ হাজার ৬৯ ফুট উঁচুতে, আমি তখন তায়েফের রিং রোডে। নিচে তাকিয়ে দেখছি আধুনিক কারুকার্যময় স্থাপত্য। সমতলে যখন ফিরলাম তখন দেখলাম, ছোট সুপার মার্কেট (বাকালা), বিভিন্ন কটেজ, রিসোর্ট ও শিষাবার। গাড়ির জানালা দিয়ে নিচে ও ওপরে তাকালে ভয় লাগে, আবার বেশ রোমাঞ্চকর অনুভূতিও কাজ করে। পথিমধ্যে দেখতে পাই, অন্য প্রাণিকুল মহাসড়ক ঘেঁষে একদল বানর দল বেঁধে ঘুরে বেড়াতে। তখন চোখের চারপাশে মায়াবী সৌন্দর্যের হাতছানি, নির্মল সবুজের সমারোহ। যা আমার জন্য চমৎকার এক যাত্রার অভিজ্ঞতা। দেড় ঘণ্টায় তায়েফ শহরে পৌঁছে যাই।

তায়েফের মাটিতে নেমে প্রথম দর্শনেই চোখ ছানাবড়া। জনমানবপূর্ণ বসতি অথচ কোলাহলহীন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন শহর। সরু সড়কের পাশেই নারী-পুরুষের জন্য বিনোদন কেন্দ্র, পৃথক পার্ক। উপশহরে অবস্থিত হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস মসজিদ, এটি তায়েফের কেন্দ্রীয় মসজিদ নামে পরিচিত। দেখতে দৃষ্টিনন্দন। মসজিদের কোলঘেঁষে শায়িত আছেন তিনি। তায়েফের ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলোর অন্যতম হজরত আলী মসজিদ, ওপরে উঠতে দেখা মেলে প্যাঁচানো সিঁড়ির দেয়ালে নানা জাতের ফুলের কারুকার্য, যা দেখে অবাক না হয়ে পারা যায় না। সহস্রাধিক বছর আগের নিখুঁত নির্মাণশৈলী মনকে নাড়িয়ে দেয়। তারপর দেখতে গেলাম বহু বছরের পুরোনো মসজিদে আদম, এ মসজিদ আঙুরের বাগানের পাশেই। এরপর দেখা হলো বিশ্বনবী (সা.)-এর হাঁটার পথে কাঁটা ছিটিয়ে রাখা কথিত বুড়ির বাড়ি। জায়গাটি সৌদি সরকারের সংরক্ষণ করা। বুড়ির ঘর ইট-পাথর দিয়ে ঘেরাও করে রাখা। তার ঠিক পাশেই ছোট্ট দুটি পাথর দ্বারা আটকে আছে বড়সড় দুটি পাথর। নবী করিম (সা.)-কে হত্যার উদ্দেশে পাহাড়ের ওপর থেকে এই পাথরগুলো বুড়ি ফেলতে চেয়েছিল বলে জনশ্রুতি আছে। কিন্তু আরশে আজিমের অশেষ কুদরতে তা প্রতিহত হতো। যা আজও সেভাবেই আছে। পাহাড়ের পাদদেশে আছে হুজুর পাক (সা.)-এর নামে মসজিদ। মসজিদের দুই পাশে সারি সারি বৃক্ষ, বিশেষ করে নিমগাছের আধিক্য, তরু লতাপাতা ফুল ফসলের সবজি খেত আর দৃষ্টিনন্দন মার্বেল পাথরের স্থাপনা।

ধর্মীয় অনুভূতির দিক থেকে মক্কা-মদিনার পর তায়েফের অবস্থান, গুরুত্বের দিক থেকে তৃতীয় বলা চলে। খুবই শীতল শহর। এ মাটিতে ১২ মাস শাকসবজি হয়, নানা ফলের আবাদ হয়। হরেক রকম ফুলেরও চাষাবাদ হয়। গোলাপজল তৈরিতে তায়েফের গোলাপের সুনাম রয়েছে।

এবার যাচ্ছি ভাড়ায় চালিত গাড়ি করে সাদিয়া তায়েফ, যা তায়েফ উপশহর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে হুজুর (সা.)-এর দুধ মা হালিমার বাড়ি। দ্রুত গতিবেগে গাড়ি গন্তব্য ছুটছে, গাড়ির গ্লাসের ফাঁক দিয়ে দৃষ্টিসীমা যতদূর যায়, শুধুই পাহাড়। বুঝতে বাকি নেই, পুরো সৌদি আরব পাহাড়ঘেরা দেশ। ৪০ মিনিটের যাত্রা শেষে সাদিয়া তায়েফ পৌঁছলাম। গাড়ি থেকে নেমে প্রাকৃতিক রূপ দেখে মুগ্ধ। ক্লান্ত শরীরে কিছুটা পথ হেঁটে প্রথমেই গেলাম হুজুর (সা.)-কে যে স্থানে সিনা চাক করা হয়েছিল। ওই স্থানে একটি বড় কুলগাছ রয়েছে। অনেকেই বলল, কুলগাছটা নাকি সে সময় থেকে এভাবেই আছে।

কুলগাছের কিছুটা দূরেই পানির কূপ। এই কূপ থেকে আমাদের আখেরি নবী পানি তুলতেন। পুরো এলাকায় মানুষজনের আনাগোনা কম, তবে এ অঞ্চলও বড়-ছোট পাহাড়ঘেরা। পাহাড়ের নিচে চাষাবাদের আবাদি জমি, তবে অধিকাংশ জমিই অনাবাদি পড়ে আছে। সর্বশেষ দেখতে যাই হজরত হালিমার বাড়ি। ঘর আছে তবে তেমন কিছু নেই, শুধু পাথর দিয়ে ঘরটা ঘেরাও করে সংরক্ষণ করা।

গোধূলি গড়িয়ে রাত নেমেছে, এবার ফেরার পালা। আসতে দেখতে পেলাম, রাতের সাদিয়া তায়েফ প্রকৃতি ঘেরা বৈদ্যুতিক বাতির আলোয় আলোকিত।

ওবাইদুল হক চৌধুরী
সৌদি আরব থেকে ফিরে

পাঠকের মতামত

স্বামী-স্ত্রীর মাঝে বিবাদ-বিচ্ছেদ লাগানো নিয়ে যা বলেছেন মহানবী (সা.)

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মান-অভিমান, মনোমালিন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে বর্তমানে অনেকে ব্যক্তিগত স্বার্থ, নিজের পছন্দ-অপছন্দ ও ব্যক্তি ...