প্রকাশিত: ২৩/১২/২০১৭ ৭:৪৭ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ৯:১০ এএম
ফাইল ছবি

সমকাল::

ফাইল ছবি

ভারত ও মিয়ানমার বঙ্গোপসাগরে তাদের অংশে গ্যাস অনুসন্ধানে ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ অংশে অনুসন্ধান কার্যক্রমে কোনো গতি নেই। গভীর সাগরে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ তেল বা গ্যাস আবিস্কার করতে পারেনি। এমনকি অধিকাংশ ব্লকে কোনো কার্যক্রমই নেই। দেশে গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে অত্যন্ত ব্যয়বহুল এলএনজি বা তরল প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির দিকেই সরকারের ঝোঁক বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমদানি করা এলএনজি সার্বিক উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে দেবে। সরকার বর্তমানে যে দামে গ্রাহকদের কাছে গ্যাস বিক্রি করছে, আমদানি করা গ্যাস সেই দামে বিক্রি করতে পারবে না, দাম বাড়াতেই হবে। কারণ, এত বেশি ভর্তুকি বহন করা সরকারের পক্ষে সম্ভব হবে না। গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে সার্বিক অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। গ্যাসের দাম বাড়ার আশঙ্কায় ব্যবসায়ীরাও উদ্বিগ্ন।

ভারত তার সমুদ্র সীমানায়, বিশেষ করে গোদাভারী বেসিনে দেশি-বিদেশি কয়েকটি কোম্পানি নিযুক্ত করেছে। এসব কোম্পানি রাত-দিন অনুসন্ধান কাজ করছে। মিয়ানমার তার অংশে গ্যাস আবিস্কার করেছে। বিশ্বের নামকরা অনেক তেল-গ্যাস কোম্পানি মিয়ানমারের সমুদ্র অংশে ব্যাপক অনুসন্ধান কাজ করছে। কিন্তু বাংলাদেশ তার সমুদ্র এলাকায় অনুসন্ধান কাজে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের অগভীর সমুদ্রে, অর্থাৎ উপকূলে একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কার করা হয়, যেটার নাম সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র। এখানে গ্যাস তোলা শুরু হয় ১৯৯৮ সালে, শেষ হয়েছে ২০১৩ সালে। সাঙ্গু এখন পরিত্যক্ত। এ ছাড়া সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বাংলাদেশের কোনো সাফল্য নেই।

সমুদ্র এলাকার সীমানা নিয়ে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে দীর্ঘকাল বিরোধ ছিল। এ কারণে গভীর সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কাজে সমস্যা হতো। কিন্তু আন্তর্জাতিক আদালতে ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। বিরোধ নিষ্পত্তির এ ঘটনা ‘বাংলাদেশের সমুদ্র জয়’ হিসেবে দেখা হয়। বাংলাদেশ গভীর সমুদ্রে এক লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটারের মালিক হয়। কিন্তু গত পাঁচ বছরে গভীর বা অগভীর সমুদ্রে পেট্রোবাংলা কোনো গ্যাস বা তেলক্ষেত্র আবিস্কার করতে পারেনি। এমনকি অনুসন্ধান কাজ জোরালো করারও দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই।

সমুদ্র সীমানা নিষ্পত্তির পর পেট্রোবাংলা সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ব্লকগুলোকে পুনর্নির্ধারণ করে। বর্তমানে বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকায় মোট ২৬টি তেল-গ্যাস ব্লক রয়েছে। এর মধ্যে ১১টি অগভীর অংশে ও ১৫টি গভীর সাগরে। সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির পর ভারত ও মিয়ানমার যে গতিতে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, সে তুলনায় বাংলাদেশের কার্যক্রম অনেকটা হতাশাজনক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ গত চার বছরে কেবল তিনটি ব্লকে অনুসন্ধান চালানোর জন্য পিএসসি, অর্থাৎ উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তি করেছে। এগুলো হলো অগভীর সাগরে ব্লক নম্বর ৪, ৯ ও ১১। ভারতের ওএনজিসি এবং অস্ট্রেলিয়ার সান্তোস ও ক্রিস এনার্জির সঙ্গে এ চুক্তি হয়। বাকি ২৩টি সমুদ্র ব্লক এখনও অলস পড়ে আছে। এই ২৩ ব্লক সমুদ্র এলাকার প্রায় ৮০ শতাংশ। এখানে বর্তমানে কোনো অনুসন্ধান কার্যক্রম নেই। তবে সীমানা নিষ্পত্তির আগে ২০০১ সালে মার্কিন কোম্পানি কানকোফিলিপসকে পিএসসির মাধ্যমে ১০ ও ১১ ব্লক ইজারা দেওয়া হয়। কিন্তু ২০১৪ সালে এ কোম্পানি ব্লক দুটি ছেড়ে দেয়। চলতি বছর ১২ ব্লকে দাইয়ু করপোরেশন কাজ করতে সম্মত হয়েছে। তবে চূড়ান্ত পিএসসি এখনও হয়নি।

বঙ্গোপসাগরের ভারতীয় অংশের কৃষ্ণা-গোদাভারী বেসিনে ব্যাপক পরিমাণ গ্যাসের মজুদ পাবে বলে আশা করছে সে দেশের তেল-গ্যাস কোম্পানি ওএনজিসি। ভারতের সরকারি প্রতিষ্ঠান ওএনজিসি, গুজরাট স্টেট পেট্রোলিয়াম করপোরেশন, ভারতের বড় শিল্প গ্রুপ রিলায়েন্স এ এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধানে রাত-দিন কাজ করে যাচ্ছে। সর্বশেষ ২০১৫ সালে এই ভারতের অংশে গভীর সমুদ্রের কেজি ডি ৫ ব্লকে ওএনজিসি একটি বড় গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পেয়েছে বলে বলা হচ্ছে। যদিও সেটি এখনও চূড়ান্ত নয়।

মিয়ানমার ২০১৩ সালেই সমুদ্র সীমানায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান আরও জোরদার করে। তাদের সমুদ্র সীমানায় মোট ২০টি অনুসন্ধান ব্লকে ১০টির বেশি বিদেশি কোম্পানি বর্তমানে অনুসন্ধান কাজ করছে। কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে ফ্রান্সের টোটাল, ব্রিটেনের শেল অয়েল, ব্রিটিশ গ্যাস, যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন, কনোকোফিলিপস, ইতালির ইএনআই ও নরওয়ের স্ট্যাট অয়েল। সমুদ্র সীমানা বিরোধ মীমাংসার পর থেকে মিয়ানমার তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

সমুদ্র এলাকায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের সক্ষমতা ও দক্ষতা নেই রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি বাপেক্সের। ফলে সাগরে অনুসন্ধান চালানোর জন্য বিদেশি কোম্পানির ওপরই নির্ভর করতে হয়। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, নানা কারণে বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকায় বিদেশি কোম্পানিগুলোর আগ্রহ কম। কারণ বাংলাদেশের সমুদ্র অংশে তেল-গ্যাস সম্পর্কে প্রাথমিক কোনো জরিপ তথ্য নেই।

এজন্য সাগরে জরিপ তথ্য সংগ্রহ করার জন্য বিদেশি কোম্পানি নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেয় পেট্রোবাংলা। ওই কোম্পানি পূর্ণাঙ্গ জরিপ তথ্যউপাত্তসহ প্রতিবেদন তৈরি করে পেট্রোবাংলাকে দেবে। এর জন্য বিদেশি কোম্পানি পেট্রোবাংলার কাছ থেকে কোনো অর্থ নেবে না। এই ‘তথ্য প্যাকেজ’ বিদেশি তেল অনুসন্ধানকারী কোম্পানির কাছে বিক্রি করে নিজের লভ্যাংশ রেখে পেট্রোবাংলাকে একটি অর্থ অংশ প্রদান করবে ওই জরিপ কোম্পানি। এ প্রক্রিয়ায় পেট্রোবাংলা বিদেশি পাঁচ কোম্পানির কাছ থেকে প্রস্তাব পায়। এগুলোর মধ্য থেকে সবচেয়ে যোগ্য কোম্পানিকে বাছাই করার জন্য একটি বিশেষজ্ঞ মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়। যেখানে পেট্রোবাংলার জ্যেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই মূল্যায়ন কমিটি যথাসময়ে মূল্যায়ন শেষ করে সুনির্দিষ্টভাবে একটি কোম্পানিকে সর্বাপেক্ষা যোগ্য বিবেচনা করে। পেট্রোবাংলা সেই প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এভাবেই সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম এক নিবন্ধে লিখেছেন, পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার গত তিন বছরে তার সমুদ্র সীমানায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমকে যেভাবে গতিশীল করেছে, বাংলাদেশ তা পারেনি কেন, এটি বিশ্নেষণের সময় এসেছে। বাংলাদেশকে তার অনুসন্ধান কাজের ব্যবস্থাপনায় ধীরগতি, আমলা মহলের অযাচিত হস্তক্ষেপের গি থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পরই গুরুত্ব দিয়েছিলেন সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে। তার নীতি ছিল, দেশের স্থলভাগে যে গ্যাস আছে, তা আজ হোক কাল হোক তোলা যাবে। সেখানে কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু আগে সাগরের তেল-গ্যাস তুলতে হবে। সে অনুযায়ী তিনি বিদেশি কোম্পানিকে কাজেও লাগিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ঘাতকের হাতে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কাজ থেমে যায়। বিদেশি ওই তেল-গ্যাস কোম্পানি বাংলাদেশ ত্যাগ করে। সেই থেকে এ পর্যন্ত গভীর সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে জোরালো কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আজ সারাদেশে গ্যাসের জন্য হাহাকার চলছে। সমস্যা সমাধানে সরকার অতি উচ্চমূল্যে গ্যাস আমাদানির জন্য সার্বিক প্রচেষ্টা নিয়েছে। কিন্তু সাগরে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।

সমুদ্র অনুসন্ধান ত্বরান্বিত করতে চলতি বছর ৫ জানুয়ারি একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি অস্থায়ী ‘ব্লু ইকোনমি সেল’ গঠন করা হয়। এ সেলের জনবল ছয় কর্মকর্তাসহ মোট ১০ জন। তাদের কার্যক্রমও দৃশ্যমান নয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মিনারেল রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ম তামিম সমকালকে বলেন, অনেক আগেই সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে গুরুত্ব আরোপ করা উচিত ছিল; কিন্তু সেটা হয়নি। সাগরে মাটির নিচের কোনো তথ্য পেট্রোবাংলার কাছে নেই। কোনো জরিপও হয়নি। ফলে বিদেশি কোম্পানিগুলোর খুব একটা আগ্রহ নেই। কিন্তু মিয়ানমার অনেক আগেই তাদের অংশে জরিপ করেছে। ফলে সেখানে অনেক বড় বড় কোম্পানি যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এখন এলএনজি আমদানির দিকেই সরকারের ঝোঁক বেশি। কিন্তু সাগরে গ্যাস পাওয়া গেলে তা অনেক কম দামেই সরকার পেতে পারত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সমকালকে বলেন, মিয়ানমার তাদের অংশে গ্যাস আবিস্কার করেছে সীমানা নির্ধারণের আগেই। আর ভারত তার অংশে এখনও কোনো আবিস্কার করতে পারেনি। বাংলাদেশ অংশে এরই মধ্যে তিনটি ব্লকে জরিপের কাজ চলছে। জরিপ কাজ শেষ হলে অন্যান্য ব্লক পিএসসির মাধ্যম বিদেশি কোম্পানির কাছে ইজারা দেওয়া হবে। সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম অনেকটা স্থবির কেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনুসন্ধান কাজ চলছে। ভবিষ্যতে গতি আরও বাড়বে।

পাঠকের মতামত

রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল সংগ্রহে আইওএমকে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান

নতুন অংশীজন খোঁজার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থাকে (আইওএম) রোহিঙ্গাদের জন্য আরো তহবিল সংগ্রহের আহ্বান জানিয়েছেন ...

গ্রামাঞ্চলে দ্রুত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

গ্রামাঞ্চলে দ্রুত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ...

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির আশা বাংলাদেশ-গাম্বিয়ার

রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে করা মামলার দ্রুত নিষ্পত্তিতে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে বাংলাদেশ ও গাম্বিয়া। ...

কারামুক্ত হলেন মামুনুল হক

হেফাজতে ইসলামের সাবেক কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক কারামুক্ত হয়েছেন। শুক্রবার (৩ মে) সকাল ...

সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উখিয়ায় হবে উন্মুক্ত কারাগার, শিগগির নির্মাণ শুরু

উন্নত দেশের ন্যায় বাংলাদেশে উন্মুক্ত কারাগার নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ...