প্রকাশিত: ২৪/০৮/২০১৭ ৭:০২ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ২:৪০ পিএম

পীর হাবিবুর রহমান:: প্রতিদিন লাখো লাখো পিস মরণ নেশা ইয়াবা ধরা পরছে। ইয়াবার আগ্রাসনে এখন আর রাজধানী থেকে নগর, নগর থেকে শহরই নয়, গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে গেছে। এক সময় ফেনসিডিল, প্যাথেড্রিন, গাঁজায় আসক্ত হতেন তরুণেরা। ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে ফেনসিডিল বস্তায় বস্তায় এসেছে। ফেনসিডিল জামানা শেষ। অভিজাতদের প্রিয় নেশা ইয়াবা এখন গরিবেরও নেশায় পরিণত হয়েছে। চড়া মূল্যে এই মরণ নেশা কিনতে গিয়ে স্নেহময়ী মাতা-পিতার প্রতি মারমূখী হচ্ছে সন্তান। কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী ইয়াবার নেশায় বুঁদ হয়ে পরে থাকছে। সাময়িক উত্তেজনার মুখে এই নেশা নিতে গিয়ে রাতের পর রাত জাগছে। দিনের বেলা অর্ধেক পার করছে ঘুমে। খিটখিটে মেজাজে পরিবারে শান্তি নির্বাসনে দিচ্ছে। ইয়াবার জন্য টাকার চাহিদা, উন্মাসিক জীবনের প্রশ্রয় চাচ্ছে পরিবারের কাছ থেকে।

মাদক ও নিষিদ্ধ ড্রাগের আসক্তদের সংখ্যা যত বাড়ছে, সেই হারে বাড়ছে না মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র। সরকারি পর্যায়ে তো নেয়ই, বেসরকারি পর্যায়ে অপ্রতুল। মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে চিকিৎসা করাবে সেই সুযোগও নেই। দিনের পর দিন রেখে চিকিৎসা করাচ্ছে, বের হয়ে আবার মরণনেশাতেই সন্তান ঝুঁকছে। প্রচলিত আছে, কোনো কোনো মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রেও ইয়াবা সরবরাহ হচ্ছে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী যাদের ধরছে তারা বেশিভাগ ইয়াবা সেবনকারী অথবা সরবরাহকারী। এখন পর্যন্ত মোটা দাগের কোনো ব্যবসায়ী ধরা পরেনি। শোনা যায় ড্রাগ ব্যবসার সঙ্গে শক্তিধর মানুষেরা জড়িত রয়েছে।

একটি ইয়াবা যে পরিবারে প্রবেশ করেছে শুধু সেই পরিবারের একজন সদস্যেরই নয়; সবার শান্তি হারাম করে ফেলেছে। মায়ানমার সীমান্তে ইয়াবার কারখানা গড়ে উঠেছে। টেকনাফ দিয়ে বানের স্রোতের মতো এসে ঢুকছে ইয়াবা। সর্বনাশা ইয়াবা একটি প্রজন্মকে শেষ করে দিচ্ছে। তার লেখাপড়ার ক্ষমতা, সৃজনশীলতা, শারিরীক, মানসিক শক্তি, জীবনের স্বপ্ন ও শান্তি সব কেড়ে নিচ্ছে। একসময় জীবনেরও পরিসমাপ্তি ঘটছে। একজন ঐশ্বী ইয়াবা সেবনকারী হিসাবে সমাজে চিহ্নিত হয়েছে। পিতামাতার হত্যাকারী হিসাবে দণ্ডিত হয়েছে, জেল খাটছে। কিন্তু প্রায় ৫৫ হাজার বর্গমাইল জুড়ে এমন কোনো পরিবার নেই যেখানে এখন ইয়াবা নক করছে না। যেসব পরিবারে প্রবেশাধিকার ঘটেনি, তাদের প্রতি যেন আল্লাহর রহমত রয়েছে। যে পরিবারে প্রবেশ করেছে, সেটি যেন অভিশপ্ত হয়ে উঠেছে।

একজন ব্যক্তি, একটি পরিবার, একটি সমাজ, একটি দেশের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। মানব কল্যাণের রাজনীতির সঙ্গে যারা জড়িত, সমাজ প্রগতির অগ্রভাগে যেসব সমাজপতি শিক্ষাঙ্গনে যারা শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন, লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, প্রশাসনের কর্মকর্তা, কর্মচারী সবাই মিলে সংঘবদ্ধভাবে ইয়াবার বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ ঘোষণা করবেন সেটিও দেখা যাচ্ছে না। গোটা দেশজুড়ে ইয়াবার আগ্রাসন যেন এক রহস্যময় ঘটনা। দেশ সয়লাব হয়ে যাওয়া মরণনেশা ইয়াবার এমন বাজারজাতকরণে নেপথ্য কালোশক্তি কারা? এখন পর্যন্ত তা উদঘাটিত হচ্ছে না। এদের প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। অসংখ্য সংসার, দাম্পত্য জীবন কলহে কলহে, তিক্ততায়, তিক্ততায় ধ্বংসিত হয়ে ভেঙে যাচ্ছে। সুখ, শান্তি, প্রেম, ভালোবাসা, সন্তান-সন্ততির সকল মায়া বিষাক্ত করে দিচ্ছে ইয়াবা নামের মরণ ড্রাগ।

পশ্চিমা দেশ তো বটেই, অনেক মুসলিম দেশেও হার্ড ড্রিংকস, বিয়ার প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য প্রকাশ্যে সহজলভ্য। এমনকি সিগারেট পর্যন্ত অপ্রাপ্ত বয়স্কদের কাছে বিক্রি হয় না। বিক্রি হলে বিক্রেতাকে দণ্ড ভোগ করতে হয়। বাংলাদেশে যে তারুণ সমাজ বিপ্লবের, সমাজ প্রগতির চাকা বা শক্তি হিসাবে আবির্ভূত, যে কিশোর-কিশোরী-তরুণ, তরুণী ভবিষ্যত নেতৃত্ব হিসাবে গড়ে উঠার কথা; তার কাছে গোপন পথে মাদক, ফেনসিডিল, মরণ নেশা ইয়াবা সহজলভ্য। চড়া দামে গোপনে নিয়মিত ইয়াবা, ফেনসিডিল কিনতে পারে। কিন্তু পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সেটি রুখতে পারে না। গোটা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ইয়াবার আগ্রাসনের মুখে অসহায়। ইয়াবার আগ্রাসনে ফেনসিডিলের রমরমা বাণিজ্যে তরুণ সমাজ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। লিভার-কিডনি, হার্ট, চোখের দ্যুতি একের পর এক অঙ্গ হারিয়ে মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছে। তবুও তারা সেটি যখন তখন হাত বাড়ালেই পেতে পারে। ঘরের দরজায় সরবররাহকারীরা দিয়ে আসে। নগদ টাকা না থাকলে ডিলাররা বাকিতে দেয়। অনেক টাকা জমা হলে সন্ত্রাসী দিয়ে তরুণের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। তারা তখন চড়াও হয় টাকার জন্য মা-বাবার ওপর। সকল বোধশক্তি হারিয়ে মরণ নেশার টাকার জন্য মারমূখী হয়ে উঠে।

রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত যারা তারা চিন্তাও করতে পারছেন, পরিস্থিতি কতটা ভয়ংকর। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, মৃত্যুর দাওয়াই হিসাবে ইয়াবা গোপনে কেনা যাবে অনেক দামে। কিন্তু অল্প দামে স্বাস্থ্যের জন্য কম ক্ষতিকর বিয়ার কেনা যাবে না প্রকাশ্য দিবালোকে। ইয়াবার বিরুদ্ধে, ফেনসিডিলের বিরুদ্ধে বিয়ার, হুইস্কি সহজলভ্য করে দিলে, লাইসেন্স চালু করলে দেশজুড়ে মরণ নেশা ইয়াবা ও ফেনসিডিল থেকে জেনারেশন যেমন মুক্ত হবে, তেমনি সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়বে না, দেশজুড়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ইয়াবা-ফেনসিডিলের অবৈধ গোপন সর্বনাশা বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়ে দেশজুড়ে পাব চালু ও বিয়ার বিক্রির সুবিধা স্টেশনারী দোকনগুলোতে দিলে অসুবিধা কোথায়?

রাজনীতির জন্য, ধর্মের জন্য বিয়ার, হার্ড ড্রিংকস হারাম বলে নিষিদ্ধ করে রাখলাম। অন্যদিকে ধর্মের নামে, নীতি নৈতিকতার নামে প্রজন্মের জীবন বাঁচাতে ইয়াবা-ফেনসিডিলের আগ্রাসন থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারলাম না, এত লাভ কার? আজকে সকল দলমত নির্বিশেষে সবাইকে ভাবতে হবে গোপনে সন্তানকে ইয়াবা খাওয়াবো, নাকি কমমূল্যে স্বাস্থ্যের জন্য কম ক্ষতিকর বিয়ার পান করতে দিবো?

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

পাঠকের মতামত

নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোই যখন বড় চ্যালেঞ্জ!

মিয়ানমারের তিনটি প্রধান এথনিক রেজিস্ট্যান্ট গ্রুপ—তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল এলায়েন্স (এমএমডিএ) এবং ...