প্রকাশিত: ০১/১০/২০১৭ ১১:১৪ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ১২:৫০ পিএম

আর্ন্তজাতিক ডেস্ক::
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের করুণ দশার জন্য জাতিসংঘের ব্যর্থতা দায়ী বলে যে অভিযোগ উঠেছে তা প্রত্যাখ্যান করেছে সংস্থাটি। এর আগে বিবিসি এক দীর্ঘ প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি রেনেটা লক ডেসালিয়েন শুরু থেকেই রোহিঙ্গা ইস্যুটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন, তার কারণেই পরিস্থিতি আজ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

ওই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে শুক্রবার জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক বলেন, ‘আবাসিক প্রতিনিধি রেনেটা লক ডেসালিয়েনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার সঙ্গে জাতিসংঘ কোনোভাবেই একমত নয়। আবাসিক প্রতিনিধি ও তার টিমের ওপর মহাসচিবের পূর্ণ আস্থা রয়েছে।’

তুর্কি গণমাধ্যম আনাদলুর খবরে বলা হয়েছে, এক বিবৃতিতে দুজারিক বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ‘মানবাধিকার, দ্বন্দ্ব প্রতিরোধ, মানবিক ও উন্নয়ন সহযোগিতা’য় লক ছিলেন নিবেদিত প্রাণ।

বিবিসির জোনাহ ফিশারের তৈরি করা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সংস্থাটি ও অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সূত্রের মাধ্যমে জানতে পেরেছে, মিয়ানমারে জাতিসংঘের প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা রেনেটা লকই রোহিঙ্গা সংকটকে দেশটির সরকারের কাছে তুলে ধরেননি। শুধু তাই নয়, মানবাধিকার সংগঠনগুলো যাতে সঙ্কটকবলিত এলাকা পরিদর্শন না করতে পারে তারও ব্যবস্থা করেছেন ডেসালিয়েন। এমনকি বিষয়টি প্রকাশ্যে নিয়ে আসতেও বাধা সৃষ্টি করেছেন তিনি।

এ ছাড়া যেসব কর্মকর্তা বিষয়টি নিয়ে মুখ খোলার চেষ্টা করেছেন এবং সতর্ক করতে চেয়েছেন যে, এভাবে চলতে থাকলে জাতিগত নিধন অনিবার্য, তাদেরকেও তিনি বিচ্ছিন্ন করে রেখেছেন।

ক্যারোলিন ভ্যান্ডিনাবিলি নামের এক ত্রাণ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বলা হয়, প্রথম যখন তিনি মিয়ানমারে পৌঁছেন তখন সেখানকার পরিস্থিতি দেখে আতঙ্কিত হন। এর আগে রুয়ান্ডার গণহত্যাও দেখেছেন তিনি।

ক্যারোলিন বলেন, ‘আমি কিছু পূর্বসূরী ও বার্মিজ (মিয়ানমারের আরেক নাম) ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলার সময় রাখাইন ও রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করি। তখন এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমাদের উচিত ওদের সবগুলোকে মেরে ফেলা, কারণ ওরা কুকুরের মতো’।’ মানবতার প্রতি এমন অমানবিকতা দেখে আমি অত্যন্ত হতাশ হয়ে যাই,’ বলেন ক্যারোলিন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১২ সালের সহিংসতার পর সেখানকার বৌদ্ধরা এতটাই ভয়ংকর হয়ে উঠে যে, কোনো ধরনের ত্রাণ বা মানবিক সাহায্য পৌঁছে দিতেও বাধা দেয়া হয়। এমনকি ত্রাণবাহী যানবাহনে হামলাও চালানো হয়। আর জাতিসংঘের পক্ষ থেকে দেশটিতে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বললে বৌদ্ধরা ক্ষেপে যাবেন এ জন্য কোনো কথা বলতেন না। বিষয়টি এমন যে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বলার ওপর যেন অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা ছিল।

এমন অবস্থায় জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রাখাইনে দীর্ঘমেয়াদি নীতি গ্রহণ করে। তারা মনে করেন, রাখাইনে যদি উন্নয়ন করা যায় তাহলে সেখানকার রোহিঙ্গা ও বৌদ্ধদের মধ্যে উত্তেজনা কমতে পারে। কিন্তু সেটাও সম্ভব হয়নি।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, জাতিসংঘ এমন অনেক প্রেস রিলিজ দিয়েছে যেখানে রোহিঙ্গাদের মূল সমস্যার কথা উল্লেখই করা হয়নি। আর মিয়ানমার সরকার তো তাদের রোহিঙ্গা কিংবা স্বতন্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকারই করে না। এর পরিবর্তে সরকার তাদের ‘বাঙালি’ বলে চিহ্নিত করে।

প্রতিবেদক বলেন, মিয়ানমারে আমি দীর্ঘদিন যাবত কাজ করছি। কিন্তু জাতিসংঘের কোনো প্রতিনিধিকে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে খোলাখুলি মুখ খুলতে দেখিনি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের অনেক সমস্যার কথা ফাইলবন্দি করে রাখা হতো।

মিয়ানমারে ত্রাণ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত এমন একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটিতে জাতিসংঘের শীর্ষ পর্যায়ের যে বৈঠক হতো সেখানে দেশটির কর্তৃপক্ষের কাছে রোহিঙ্গাদের অধিকার দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়াও একপ্রকার অসম্ভব ছিল। এ ব্যাপারে ডেসালিয়েনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি রাজি হননি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

তবে প্রতিবেদনে আনা ওইসব অভিযোগ একবারে অস্বীকার করে জাতিসংঘের ইয়াঙ্গুন (সাবেক রাজধানী) ভিত্তিক অফিস। তাদের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা শক্তভাবে এইসব অভিযোগের বিরোধিতা করছি। আবাসিক সমন্বয়ক আলোচনায় কোনো বাধা দেয়নি, বরং রাখাইন রাজ্যে কিভাবে শান্তি ফেরানো যায় তা নিয়ে নিয়মিত জাতিসংঘের সকল সংস্থার সঙ্গে বৈঠকের ব্যবস্থা করেছেন।’

এদিকে বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি উন্মুক্ত আলোচনার আয়োজন করে, যা বিগত আট বছরের মধ্যে প্রথম।

ওই আলোচনায় জাতিসংঘে মার্কিন দূত নিক্কি হেলি বলেন, মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ওপর যে সহিংসতা চালাচ্ছে তা জাতিগত নিধন বলেই আমরা মনে করছি। আর বর্বরোচিত সহিংসতার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার প্রস্তাব করতেও আমরা দ্বিধা করব না।

পাঠকের মতামত