
এক দশকের বেশি আগে কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট স্টেডিয়াম তৈরি করার কথা বলে ১ লাখ ১ টাকা প্রতীকী মূল্যে প্রায় ৫০ একর জমি বন্দোবস্ত নিয়েছিল যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়।
নামমাত্র করা সেই ‘আন্তর্জাতিক’ স্টেডিয়াম এখন পরিত্যক্ত।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে (বিসিবি) দেওয়া নিজেদের এ জমি ফেরত চায় পর্যটন করপোরেশন।
ফেরত না দিলে বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী ওই মন্ত্রণালয়ের কাছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা চেয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থাটি।
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের লাবণী পয়েন্টে পর্যটন করপোরেশনের গলফ মাঠে প্রায় ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে স্টেডিয়ামটি নির্মাণ করেছিল বিসিবি।
এটির নামকরণ করা হয় ‘শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম’। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ স্টেডিয়ামের উদ্বোধন করেন।
পর্যটন করপোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, এটি নামেই শুধু আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম। এক দশক পেরিয়ে গেলেও পূর্ণাঙ্গ অবকাঠামো করা হয়নি।
আন্তর্জাতিক কোনো ম্যাচ হয় না। পাশে বিমানবন্দর থাকায় স্টেডিয়ামে ফ্লাডলাইটসহ বড় অবকাঠামো নির্মাণ করার সুযোগ নেই।
ওই জমি দিনের পর দিন অব্যবহৃত পড়ে আছে। বিদেশি বিনিয়োগ এনে এটিকে কাজে লাগাতে চান তাঁরা।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন করে বিষয়টি সামনে এনে পর্যটন করপোরেশন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে।
নথি বলছে, লাবণী পয়েন্টের ঝিলংজা মৌজায় পর্যটন করপোরেশনের হোটেল শৈবালের আওতায় ১৮৫ একর জমি ছিল।
২০১৪ সালের টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্রিকেটকে সামনে রেখে কক্সবাজারে একটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম ও ক্রিকেট কমপ্লেক্স তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়।
সে জন্য হোটেল শৈবাল থেকে প্রায় ৫০ একর জমি পেতে অনুরোধ জানিয়েছিল তারা।
একই বছর এ জমি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে হস্তান্তর করে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।
পর্যটন করপোরেশন বলছে, জমি হস্তান্তরের সময় এর মূল্য ছিল ৭৬৮ কোটি টাকা।
এর বিপরীতে মাত্র এক লাখ এক টাকা প্রতীকী মূল্যে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে দীর্ঘমেয়াদে তা বন্দোবস্ত দেওয়া হয়।
পর্যটন করপোরেশনের চিঠিতে বলা হয়, ক্রিকেট স্টেডিয়ামটিতে দীর্ঘদিন কোনো ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়নি। স্টেডিয়ামটি এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণের কারণে স্টেডিয়ামে ফ্লাডলাইট ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সেখানে আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম করা যাবে না।
যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে দেওয়া চিঠিতে আরও বলা হয়, জমিটি অব্যবহৃত না রেখে হোটেল শৈবালের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া যৌক্তিক হবে।
জমি পর্যটন করপোরেশনকে ফেরত বা বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা দিতে হবে।
স্টেডিয়ামটি তৈরি করে বিসিবি ২০১৪ সালে জানিয়েছিল, এটির খালি জায়গায় দৃষ্টিনন্দন একাডেমিক ভবন, জিমনেসিয়াম, সুইমিংপুল ও তারকা মানের হোটেল বানাবে তারা।
এটি হবে দেশের অন্যতম আকর্ষণীয় একটি স্টেডিয়াম। আর পর্যটক বৃদ্ধির পাশাপাশি হোটেল-মোটেলসহ নানা ব্যবসার উন্নয়ন ঘটবে। পাল্টে যাবে কক্সবাজারের চেহারা।
তবে স্টেডিয়াম ঘুরে দেখা যায়, এসবের কিছুই হয়নি। আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজন করার মতো অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। ভিআইপি লাউঞ্জসহ অন্যান্য স্থাপনা অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে।
স্টেডিয়ামের মূল ফটক দিয়ে ঢুকে দেখা গেল, বিশাল মাঠ খালি পড়ে আছে। কোথাও কোথাও বড় ঘাস। রফিক উল্লাহ নামের একজনকে দেখা গেল গরুর খাবারের জন্য ঘাস তুলছেন।
এক নিরাপত্তাপ্রহরী জানালেন, মাঝেমধ্যে লিগের খেলা হয়। বড় কোনো ম্যাচ হয় না।
স্টেডিয়ামের অবকাঠামো উন্নয়নের দায়িত্বে রয়েছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ।
কক্সবাজার স্টেডিয়ামের উন্নয়নের কোনো পরিকল্পনা আছে কি না, জানতে চাইলে ক্রীড়া পরিষদের সচিব (যুগ্ম সচিব) মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘স্টেডিয়ামের অবকাঠামো উন্নয়নে এখন কোনো প্রকল্প চলমান নেই।
তবে সেখানে ক্রিকেট ও ফুটবল স্টেডিয়াম করতে একটি সমীক্ষা করা হয়েছিল। এর বাইরে আর কোনো উদ্যোগ নেই।’
জমি ফেরত পাওয়া প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসরীন জাহান এ প্রতিবেদককে পর্যটন করপোরেশনের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।
পরে পর্যটন করপোরেশনের মহাব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা, পরিসংখ্যান ও প্রশিক্ষণ) জিয়াউল হক হাওলাদার বলেন, ‘যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে দেওয়া জমিটি অব্যবহৃত পড়ে রয়েছে।
সেখানে আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম করার সুযোগ নেই। কারণ, পাশেই কক্সবাজার বিমানবন্দর।
পর্যটন বিকাশে ওই জমিতে বিনিয়োগ করতে বিদেশি বিনিয়োগকারীর আগ্রহ রয়েছে। গলফ ট্যুরিজমেরও সম্ভাবনা রয়েছে। সে কারণে আমরা জমিটি ফেরত চেয়েছি।’
শুধু যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ই নয়, সরকারি আরও কিছু সংস্থা হোটেল শৈবালের জমি নিয়েছে।
শৈবাল সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার জেলা পরিষদ ১ দশমিক ২ একর, কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশ প্রায় ১ একর, ইয়াসির লাইফ গার্ড ৫০ শতাংশ নিয়েছে।
এ ছাড়া কবিতা চত্বর এলাকায় দুই দশমিক ছয় একর জায়গা বেদখল হয়ে গেছে।
হোটেল শৈবালের চারপাশ ঘুরে দেখা যায়, সীমানাপ্রাচীর না থাকায় তাদের জমি দখল হয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া দীর্ঘদিন সরকারের তরফে বড় কোনো বিনিয়োগ নেই।
সেখানকার স্থাপনাগুলো পুরোনো হয়ে গেছে। করা হচ্ছে না সংস্কারও।
পর্যটন করপোরেশন ১৯৮৩ সালে হোটেল শৈবাল প্রতিষ্ঠা করে। একসময় এটিই ছিল আকর্ষণীয় পর্যটন স্থাপনা। তবে দিন দিন এটি জনপ্রিয়তা হারিয়েছে।
বিপরীতে বেসরকারি হোটেল ও রিসোর্টগুলো ভালো ব্যবসা করছে।
স্টেডিয়ামে গরুর খাবারের জন্য ঘাস সংগ্রহ করছেন এক ব্যক্তি
কক্সবাজারে পর্যটন করপোরেশনের আওতায় শৈবাল, উপল, প্রবাল ও লাবণি—এ চারটি হোটেল ও মোটেল রয়েছে।
এর মধ্যে ক্রমাগত লোকসানে শৈবাল, উপল,প্রবাল ও লাবণি ছয় বছর আগে কক্সবাজারে কর্মরত কয়েকটি ইউএন সংস্থাকে ভাড়া দিয়ে দেয় করপোরেশন। তবে শৈবাল ও উপল এর কিছু অংশ চলছে কোনোমতে।
হোটেল শৈবালের ব্যবস্থাপক রায়হান উদ্দিন আহমেদ বলেন, বেসরকারি হোটেল ও রিসোর্ট ভালো ব্যবসা করলেও বিনিয়োগের অভাবে পর্যটন করপোরেশনের আওতাধীন হোটেলগুলো ব্যবসা করতে পারছে না।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নৈরাজ্য বন্ধে সরকারি হোটেল ও মোটেলে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। করতে হবে নতুন নতুন অবকাঠামো।
পাঠকের মতামত