
উখিয়া নিউজ ডটকম::
মিয়ানমার থেকে সীমান্ত দিয়ে ইয়াবাসহ মাদক ও নেশাজাতীয় দ্রব্য চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তা বন্ধে মিয়ানমার পুলিশ ফোর্সের (এমপিএফ) সহযোগিতা চেয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এ জন্য ৪৯টি ইয়াবা তৈরি কারখানার ঠিকানাসহ মিয়ানমার পুলিশকে তালিকা হস্তান্তর করেছে বিজিবি।
বিজিবির দাবী, এসব কারখানা থেকে তৈরি ইয়াবা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পাচার করা হচ্ছে।
বিজিবির দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে সীমান্ত দিয়ে মাদক বিশেষ করে ইয়াবা পাচাররোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে এমপিএফ। যদিও ইয়াবার সমস্যায় মিয়ানমারের যুবসমাজও বিপথগ্রস্থ বলে স্বীকার করেছেন প্রতিনিধি দলের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মেয়ো সেও উইন।
ঢাকায় পিলখানায় বিজিবি-এমপিএফ এর অতিরিক্ত মহাপরিচালক পর্যায়ের ৬ দিনব্যাপী (১-৬ এপ্রিল) সীমান্ত সম্মেলন শেষে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বিজিবির অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আনিছুর রহমান বলেন, মাদক ও নেশাজাতীয় দ্রব্য বিশেষ করে ইয়াবা যুব সমাজের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। সীমান্ত চোরাচালান প্রতিরোধে উভয়পক্ষ আন্তর্জাতিক সীমান্তের বিধি-নিষেধ পরিপালনে তৎপরতা বৃদ্ধি, মাঠ পর্যায়ের অধিনায়কদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ বৃদ্ধি ও তাৎক্ষণিক তথ্য বিনিময়ের বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছেছে।
ব্রিগেডিয়ার আনিছুর রহমান বলেন, ইয়াবা তৈরির কারখানার বিষয়ে মিয়ানমার পুলিশকে আমরা এর আগে একটি তালিকা দিয়েছিলাম। তারা এর কোনো হদিস পায়নি বলে জানিয়েছে। তবে সীমান্তে প্রতিনিয়ত ইয়াবা উদ্ধারের বিয়ষটি তারা অবজার্ভ করেছে। এবার সীমান্ত সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে আরও ৪৯টি ইয়াবা তৈরি কারখানার তালিকা এমপিএফ প্রতিনিধি দলের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ কারখানাগুলো মিয়ানমারে অবস্থিত।
বৈঠকে আন্তঃসীমান্ত অপরাধ যেমন- মাদক ও নেশাজাতীয় দ্রব্য বিশেষ করে ইয়াবা চোরাচালান প্রতিরোধে উভয় পক্ষ আন্তর্জাতিক সীমান্তের বিধি-নিষেধ পরিপালনে আরও তৎপরতা বৃদ্ধি, মাঠ পর্যায়ের অধিনায়কবৃন্দের মধ্যে নিয়মিত আনুষ্ঠানিক/অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং তাৎক্ষণিক তথ্য বিনিময়ের বিষয়েও সম্মত হন।
বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আনিছুর রহমান যুব সমাজের উপর মাদকের বিশেষ করে ইয়াবার ক্ষতিকর প্রভাবের কথা উল্লেখ করে বাংলাদেশে মাদক চোরাচালান প্রতিরোধে আন্তরিক সহযোগিতা প্রদানের জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেন।
জবাবে মিয়ানমারের চিফ অব পুলিশ জেনারেল স্টাফ বলেন, তাদের দেশেও একই সমস্যা বিরাজ করছে। একইভাবে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ ও সীমান্তে ইয়াবা পাচার প্রতিরোধে তৎপর রয়েছে। এ প্রসঙ্গে মিয়ানমার পক্ষ, টেকনাফের উত্তর দিকে আরও একটি ‘সীমান্ত প্রবেশ পথ’ স্থাপনের বিষয়ে অনুরোধ করেন। বিজিবি’র অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রস্তাবটি যথাযথ কর্তৃপক্ষের বরাবরে প্রেরণের ব্যাপারে আশ্বস্ত করেন।
সংবাদ ব্রিফিঙে আরো জানানো হয়, সম্মেলনে পারস্পরিক ফলপ্রসূ আলোচনার মাধ্যমে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এর অংশ হিসেবে উন্নততর সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, আস্থা ও সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং সীমান্তে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ-মিয়ানমার নাফ রিভার এগ্রিমেন্ট- ১৯৬৬, বাংলাদেশ-মিয়ানমার বর্ডার এগ্রিমেন্ট- ১৯৮০ এবং বাংলাদেশ-মিয়ানমার ল্যান্ড বাউন্ডারি ট্রিটি- ১৯৯৮ যথাযথ অনুসরণে উভয় পক্ষ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছেন।
সম্মেলনে উভয় প্রতিনিধি দলের প্রধানরা নিজ নিজ দেশের সরকারের অবস্থান তুলে ধরে জানান যে, উভয় দেশের সরকার অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র বিরোধী কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য তাদের ভূমি সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করতে দেয় না। সীমান্তের বিশেষ কোনো এলাকায় এধরণের অপরাধীদের অবস্থানের সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া গেলে সমন্বিত অপারেশন পরিচালনার বিষয়েও উভয়পক্ষ সম্মত হন।
সীমান্তের শুণ্য লাইনের আশেপাশে পুঁতে রাখা আইইডি (ইমপ্রোভাইসড ইক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) ও মাইনের বিস্ফোরণে আহত ও নিহতের ঘটনা প্রতিরোধে এবং সীমান্তে টহল পরিচালনাসহ সুষ্ঠু সীমান্ত ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালনা করার স্বার্থে তা অপসারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে উভয় পক্ষ সম্মত হন।
সম্মেলনে বিজিবি’র অতিরিক্ত মহাপরিচালক বাংলাদেশে মিয়ানমার নাগরিকদের অবৈধ অনুপ্রবেশ বিশেষ করে গত অক্টোবর ২০১৬ হতে অস্বাভাবিক হারে অবৈধ অনুপ্রবেশের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন বলে জানানো হয়। এর জবাবে মিয়ানমার পুলিশ ফোর্সের চিফ অব পুলিশ জেনারেল স্টাফ জানান যে, বর্তমানে মিয়ানমারের মংডুতে পরিস্থিতি স্থিতিশীল ও স্বাভাবিক রয়েছে। আলোচনার মাধ্যমে উভয় পক্ষ ভবিষ্যতে এ ধরণের অবৈধ অনুপ্রবেশ প্রতিরোধে পরস্পরকে সহযোগিতা প্রদানে সম্মত হয়েছেন।
বৈঠকে বিজিবির পক্ষ থেকে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী কর্তৃক সীমান্ত লঙ্ঘন, সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীসহ বাংলাদেশী নাগরিক এবং জেলেদের উপর গুলির্বণের ঘটনায়ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে সীমান্ত এলাকার শান্তি ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারে এমন কর্মকাণ্ড বন্ধের জন্য মিয়ানমারকে অনুরোধ জানান। মিয়ানমারের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি দলের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মেয়ো সেও উইন সীমান্তে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের উপর গুরুত্বারোপ করে জানান, এ ধরণের গুলিবর্ষণ এবং অনাকাঙ্খিত সীমান্ত অতিক্রমের ঘটনা বন্ধের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সেই সাথে তিনি সীমান্তে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর উপর সন্ত্রাসীদের গুলিবর্ষণের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে উভয় পক্ষ সম্মত হন যে, উভয় দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী সীমান্তের বিধি-বিধান লঙ্ঘন করবেন না এবং পূর্বানুমোদন ছাড়া সীমান্ত অতিক্রম করবেন না।
এছাড়াও অনিচ্ছাকৃতভাবে সীমান্ত অতিক্রমকারী কোনো নাগরিকের কাছে অবৈধ দ্রব্য পাওয়া না গেলে তার কাছে থাকা বিষয় সম্পত্তিসহ তাকে অতিসত্বর অপর পক্ষের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর কাছে হস্তান্তর করার বিষয়ে উভয় পক্ষ সম্মত হন।
এ বিষয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে সীমান্ত অতিক্রমের দায়ে একে অপরের দেশে আটক থাকা নাগরিকদের প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে তাদের সাথে নিজ নিজ দেশের দূতাবাসের প্রতিনিধির সাক্ষাতের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি উভয় পক্ষ তুলে ধরেন। উভয় পক্ষের প্রতিনিধিদলের প্রধানরা নিজ নিজ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে অবহিত করতে সম্মত হয়েছেন।
উভয় পক্ষ মানব পাচার ও অবৈধ অনুপ্রবেশ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে সম্মত হন। তারা সংঘবদ্ধ মানব পাচার চক্রের তথ্য আদান প্রদান এবং এ ধরণের ঘৃণ্য অপরাধ প্রবণ এলাকায় নজরদারি বৃদ্ধির বিষয়েও সম্মত হন।
এজন্য নিয়মিতভাবে বিভিন্ন পর্যায়ের অধিনায়কদের মধ্যে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে এবং উভয় পক্ষ প্রয়োজন মনে করলে যে কোনো সময় জরুরী বৈঠকের আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এবং উভয় পক্ষের নিজ নিজ দায়িত্বপূর্ণ এলাকার স্থল ও জল সীমান্তে সমন্বিত টহল পরিচালনা করা হবে।
সম্মেলনে পারস্পরিক আস্থা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ হিসেবে প্রীতি ম্যাচ ও খেলাধুলা, প্রশিক্ষণ বিনিময়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, স্কুল শিক্ষার্থীদের ভ্রমণ, পরিবার কল্যাণ সমিতির সদস্যদের ভ্রমণ বিনিময় ইত্যাদি আয়োজনের বিষয়ে উভয় পক্ষ নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছেন।
বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলে বিজিবির উর্দ্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কোস্ট গার্ড, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, সার্ভে জেনারেল অব বাংলাদেশ এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তাবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। অপরদিকে মিয়ানমার প্রতিনিধিদলে মিয়ানমার পুলিশ ফোর্সের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাবৃন্দ ও ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমার দূতাবাসের প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন।
সম্মেলনে উভয় পক্ষ পরবর্তী সীমান্ত বৈঠক মিয়ানমারের নেপিতো তে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠানের ব্যাপারেও নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছেন।
পাঠকের মতামত