প্রকাশিত: ৩০/০৮/২০১৭ ২:৫৭ পিএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ২:২১ পিএম

উখিয়া নিউজ ডেস্ক::
বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দুই আড়াই দশক আগে সংঘাতের সময় সে দেশের সেনাবাহিনীর বসানো এন্টি পার্সোনাল মাইন বা ভূমি মাইনে অনেক রোহিঙ্গার জীবন গেছে অথবা পঙ্গু হয়েছেন। শুক্রবার থেকে পুনরায় শুরু হওয়া সংঘাতের পর আবারো সেই মাইন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত এ জনগোষ্ঠির মধ্যে।

এবারের সংঘাতে গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসা নিতে বাংলাদেশে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে মাইন বিস্ফোরণের শিকার ব্যক্তিরাও আছেন বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

গত পাঁচদিনে কমপক্ষে শতাধিক গুরুতর আহত নারী-পুরুষ শরীরে মারাত্মক জখম নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে চিকিৎসা নিচ্ছে বাংলাদেশর বিভিন্ন হাসপাতালে। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন মাইন বিস্ফোরণে আহতরাও রয়েছেন। যাদের চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বাকি জীবনে ভুগতে হবে দীর্ঘস্থায়ী জটিল শারীরিক সমস্যায়।

কক্সবাজারের মেমোরিয়াল খ্রিস্টান হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মংডুর থলংখালি এলাকার কাঠমিস্ত্রি হাবিব উল্যার দুটি আঙ্গুলসহ ডান পায়ের কিছু অংশ কেটে ফেলতে হয়েছে। মুখ ও শরীরের বিভিন্ন অংশ পুড়ে গেছে বিস্ফোরণে। সেনাবাহিনীর হামলার মুখে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় বাড়ির পাশেই বিস্ফোরণে এমন হাল হয়েছে তার।

সরেজমিনে মেমোরিয়াল খ্রিস্টান হাসপাতালে মঙ্গলবার দুপুরে হাবিব উল্যা পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, ‘বোমাটি মনে হয় পোঁতা ছিল। আমি জানতাম না গুলির ভয়ে দৌড়ে পালানোর সময় বিকট বিস্ফোরণে আমার পায়ের কিছু অংশ থেতলে যায়।’

‘রাতে আমার মতো আরো কয়েকজনকে একইভাবে আহত হতে দেখেছি, এখানে যে বোমা অথবা মাইন রাখা হয়েছিল তা গ্রামবাসীর কেউ জানত না। রাতের আঁধারে এসে তারা এসব রেখে গেছে,’ যোগ করেন তিনি।

একই ধরনের বিস্ফোরণে আহত হয়ে এ হাসপাতালে পাশের সিটে চিকিৎসাধীন মংডু এলাকার জুবায়েরের বাম পায়ের বড় একটি অংশে পচন ধরেছে।

তিনি জানান, গুলির ভয়ে পালানোর সময় বোমায় পায়ের মাংস ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে। এলাকাবাসী কোনো মতে ধরে সীমান্ত অতিক্রম করে এখানে নিয়ে এসেছে। মেমোরিযাল খ্রিস্টান হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন গুরুতর আহত আরো কয়েকজন রোহিঙ্গা।

এর মধ্যে হাবিবুল্যা ও জোবায়ের পুঁতে রাখা মাইন অথবা বোমায় আহত হয়েছেন উল্লেখ করে হাসপাতালের জেনারেল সার্জন স্টিফেন কেলি জানিয়েছেন, এখানে আসার আগে তারা প্রথমে ভুল চিকিৎসার শিকার হয়েছিলেন।

‘অনেক কষ্ট পেয়েছে তারা, হাবিব উল্যার পায়ের আগুল কেটে ফেলতে হলেও তার পা রক্ষা করা গেছে। জুবায়েরের বাম পায়ে পচন ধরেছে। চিকিৎসায় অবস্থার উন্নতি হলেও ভবিষ্যতে তাদের নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগতে হবে,’ উল্লেখ করেন তিনি।

এদিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে গেছেন কমপক্ষে শতাধিক গুরুতর আহত রোহিঙ্গা।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর পুঁতে রাখা ভূমি মাইন অথবা বোমা আতঙ্কে রয়েছেন দেশে ফেরার অপেক্ষায় থাকা রোহিঙ্গারা।

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের বসতিগুলোর আশপাশে মাইন ও ‘ববি ট্রেপ’ হিসেবে পরিচিত হাতে তৈরি বোমা পুঁতে রেখেছে। কয়েক দশকের চলমান অস্থিরতায় থাকা রোহিঙ্গারা জানে মাইন বিস্ফোরণের অবশ্যম্ভবী পরিণতি হচ্ছে আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাওয়া।

বান্দরবানের তমব্রু সীমান্তের জিরো পয়েন্টে দেশে ফেরার অপেক্ষায় থাকা পার্শ্ববর্তী ঢেকিবুনিয়ার দ্বীন মোহাম্মদ জানিয়েছেন, তাদের গ্রামের বিভিন্ন স্থানে মাইন পোঁতা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে নিজেদের বসতভিটায় ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও পুঁতে রাখা বোমা নতুন করে দুশ্চিন্তায় ফেলেছে তাদের।

‘গত শুক্রবার পালিয়ে এসেছিলাম, এখন ফিরে যেতে চাচ্ছি, কিন্তু সেখান থেকে খবর দিয়েছে গ্রামের চার পাশে মাইন বসিয়ে রেখে গেছে। কীভাবে সেখানে বসবাস করব,’ প্রশ্ন রাখেন দ্বীন মোহাম্মদ।

ভূমি মাইন উৎপাদন, মজুত ও বিক্রি নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতে বিশ্বের যে ৩৫টি দেশ স্বাক্ষর করেনি তাদের একটি হচ্ছে মিয়ানমার। শুধু তাই নয়, ইন্টারন্যাশনাল ক্যাম্পিং টু ব্যান ল্যান্ডমাইন আইসিবিএলের তথ্য অনুযায়ী একমাত্র এ দেশটি সরকারিভাবে মাইন উৎপাদন, মজুত ও বসানোর কাজ করে যাচ্ছে।

গত দশকগুলোতে বিভিন্ন সময় মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের বসতি ছাড়াও বাংলাদেশ সীমান্তের জিরো পয়েন্টে মাইন বসিয়েছিল। সীমান্তবর্তী এলাকার অনেকেই এখনো সেই মাইনের ছোবলের চিহ্ন বহন করছেন।

আন্তর্জাতিক ভূমি মাইন নিষিদ্ধের দাবিতে প্রতিষ্ঠিত সংগঠন আইসিবিএল মতে, বিশ্বের প্রতিদিন এখনো গড়ে ১৮ জন মানুষ মারা যায় ভূমি মাইন বিস্ফোরণে। মাইন বসানো এলাকায় ব্যাপক হারে মানুষকে পঙ্গুত্ববরণ করতে হয়। পাশাপাশি মাইন বসানো এলাকার ভূমি কৃষি অথবা অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যায় না। মাইনের মারাত্মক প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার কারণে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশ এ অস্ত্র উৎপাদন, ব্যবহার ও মজুত করা থেকে বিরত থাকছে।

এরপর নতুন করে আরো ছোট আকারের বোমা ইমপ্রুভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস আইইডির প্রচলন হয়। যা ববি ট্রেপ হিসেবেও পরিচিত। মাইনের পাশাপাশি প্রতিপক্ষকে দমনে অথবা প্রতিপক্ষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ অথবা নিজদের সীমানায় প্রতিপক্ষের অনু প্রবেশ ঠেকানোর জন্য আইইডি অথবা ববি ট্রেপ ব্যবহার করা হয়।

তবে সরকারি বাহিনীকে মাইন বা বোমা পুঁতে রাখার স্থানে বিশেষ সতর্কতামূলক চিহ্ন সংবলিত সাইন বসানো বাধ্যতামূলক হলেও আক্রান্ত রোহিঙ্গারা বলেছেন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এ রকম কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা স্বশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা পুলিশ পোস্ট ও সীমান্ত চৌকিতে হামলা চালালে বৃহস্পতিবার (২৪ আগস্ট) মধ্যরাত থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে শতাধিক রোহিঙ্গা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য নিহত হন।

এরপর নিরাপত্তা বাহিনী সদস্যরা অভিযান শুরু করলে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশের সীমান্তে জড়ো হতে থাকে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু। সুত্র: পরিবর্তন ডটকম

পাঠকের মতামত

মিয়ানমারের আরেক গুরুত্বপূর্ণ শহর বিদ্রোহীদের দখলে

মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা দেশটির আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের দখল নিয়েছে। মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠী তা’আং ...

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ও দূরপাল্লার ট্রেন পটিয়া স্টেশনে যাত্রা বিরতির দাবি

চট্টগ্রাম–কক্সবাজার ও দূরপাল্লার ট্রেন পটিয়া স্টেশনে যাত্রা বিরতিসহ বিভিন্ন দাবিতে রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিমকে স্মারকলিপি দিয়েছেন ...