সন্ত্রাস, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, চোরাচালান, জমি দখল, হত্যা, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, টিআর-কাবিখা প্রকল্পে লুটপাটসহ নানা অভিযোগ
প্রায় দেড় ডজন সংসদ সদস্য (এমপি) ও তাদের আত্মীয়-স্বজন- ক্যাডার বাহিনীর নানা অপকর্মে বিব্রত শাসক দল আওয়ামী লীগ। এমনকি তাদের অনেকের অতিকথনেও কখনও কখনও অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের। ক্ষমতার টানা দ্বিতীয় মেয়াদের পৌনে তিন বছরেরও বেশি সময়ের মাথায় যখন বাংলাদেশ সারা বিশ্বে উন্নয়নের রোলমডেল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে, ঠিক তখনই এ সব এমপির এমন কর্মকাণ্ডে এ অর্জনকে কিছুটা হলেও ম্লান করে দিচ্ছে। এতে ক্ষমতসীনদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা।
এ ছাড়া গরিবের চাল আত্মসাৎ, টিআর-কাবিখা প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে লুটপাট, অনিয়মসহ দলের ভেতর কোন্দল জিইয়ে রাখারও অভিযোগ রয়েছে অনেক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে। সর্বশেষ গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লীতে হামলা ও লুটপাট এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বসতবাড়িতে হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনায় উঠে এসেছে তিন সংসদ সদস্যদের নাম।
সংশ্লিষ্টদের মতে, সংসদ সদস্য এবং তাদের পোষা ক্যাডারদের এসব অপকর্মে ক্ষুব্ধ হলেও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে নিতে পারছে না কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ। এ সব ঘটনা যদি মিডিয়ায় প্রচার হয় এবং সরকারের ওপরমহলের সবুজ সংকেত মেলে, শুধু সে ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয় কর্তৃপক্ষ। তবে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে নানা চাপে ‘ধীরে চল নীতি’ অনুসরণ করতে হয় সংশ্লিষ্টদের। বিষয়টি ক্ষমতাসীন দলের কোনো পর্যায়েরই নীতিনির্ধারকরা ভালো চোখে দেখছেন না। এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সংসদীয় দলের একাধিক সভায় এসব বিতর্কিত সংসদ সদস্যকে সতর্ক করেছেন। ভবিষ্যতে তাদের মনোনয়ন দেয়া হবে না বলে হুশিয়ার করেছেন তিনি। এরপরও অনেক এমপি ও তাদের ঘনিষ্ঠরা অপকর্ম অব্যাহত রেখেছেন।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, অপরাধী যেই হোক না কেন আইন সবার জন্য সমান। এখানে কে মন্ত্রী, কে সংসদ সদস্য কিংবা কে মন্ত্রী-এমপির আত্মীয়স্বজন, তা দেখার বিষয় নয়। অপরাধীর ক্ষেত্রে আইন সমানভাবেই কার্যকর হবে। কাউকে ছাড় দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’
বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, ‘বেপরোয়া সংসদ সদস্যদের লাগাম টেনে না ধরতে পারলে তা সরকারের জন্যই বুমেরাং হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখনও সময় আছে, সরকারের উচিত বিতর্কিতদের বিরুদ্ধে কার্যকর ও দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সংসদ সদস্যদের মূল কাজ হচ্ছে আইন প্রণয়ন। সংসদ ও সংসদীয় কমিটিতে সরকারের কর্মকণ্ডের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাই হচ্ছে তাদের কাজ। এগুলো না করে তারা যুক্ত হয়েছেন স্থানীয় সরকারের কর্যক্রমে। এতে অনেক সংসদ সদস্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। এদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক, দলীয় ও সংসদীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ তারা দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণœœ করছেন, আইন ভাঙছেন, এমনকি সংসদকেও অবমাননা করছেন।
বর্তমান সরকারের পৌনে তিন বছর মেয়াদে যে সব সংসদ সদস্য নিজেদের অপকর্ম অথবা তাদের আত্মীয়স্বজন ও নিজস্ব ক্যাডার বাহিনীর সন্ত্রাসী কার্যকলাপে বিতর্কিত হয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী এবং চাঁদপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ছায়েদুল হক, একই মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও খুলনা-৫ আসনের সংসদ সদস্য নারায়ণচন্দ্র চন্দ, কক্সবাজার-৪ আসনের আবদুর রহমান বদি, টাঙ্গাইল-৩ আসনের আমানুর রহমান খান রানা, ফেনী-২ আসনের নিজাম উদ্দিন হাজারী, পিরোজপুর-১ আসনের একেএমএ আউয়াল, সিলেট-৩ আসনের মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী কয়েস, সিলেট-৪ আসনের সংসদ সদস্য ইমরান আহমদ, যশোর-১ আসনের শেখ আফিল উদ্দিন, যশোর-৪ আসনের রণজিতকুমার রায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের গোলাম রব্বানী, রাজশাহী-৪ আসনের মো. এনামুল হক, গাইবান্ধা-১ আসনের সংসদ সদস্য মনজুরুল ইসলাম লিটন, ঠাকুরগাঁও-২ আসনের সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলাম, ফেনী-৩ আসনের সংসদ সদস্য রহিম উল্যাহ, গাইবান্ধা-৪ আসনের সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এবং সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য পিনু খান।
এদের বাইরে অতিকথনের কারণে গত বছর দলকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছিলেন টাঙ্গাইল-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। হজ ও ইসলাম ধর্ম নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে দল থেকে ছিটকে পড়েন। মন্ত্রিত্ব হারান, পদত্যাগে বাধ্য হন সংসদ থেকেও। গত সপ্তাহে ‘সুযোগ পেলে সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাদ দেয়া হবে’ বলে মন্তব্য করে বিতর্ক উস্কে দেন সদ্য আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য পদে আসা টাঙ্গাইল-১ আসনের সংসদ সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক। তার এমন স্পর্শকাতর মন্তব্যের পরদিনই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সংবিধান থেকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাদ দেয়ার কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই।’ আদালত নিয়ে অতিকথনের কারণে খাদ্যমন্ত্রী ও ঢাকা-২ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী ও গাজীপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য আকম মোজাম্মেল হককে উচ্চ আদালত কর্তৃক শাস্তি পেতে হয়। এ ছাড়া বিদেশ থেকে পচা গম আমদানি করে বেকায়দায় পড়েছিলেন খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম।
চট্টগ্রাম-১১ আসনের সংসদ সদস্য এম আবদুল লতিফ কম্পিউটার প্রোগ্রামের ফটোশপের মাধ্যমে ‘নিজের শরীরের অংশের’ সঙ্গে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর মুখমণ্ডল লাগিয়ে তুমুল বিতর্কের জন্ম দেন। সরকারি কর্মকর্তাকে হুমকি ও অস্ত্রসহ উত্তরার একটি বাড়িতে হামলা চালাতে গিয়ে নেত্রকোনা-২ আসনের সংসদ সদস্য এবং যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয় এবং স্কুল বন্ধ রেখে শিক্ষার্থীদের দীর্ঘক্ষণ রাজপথে দাঁড়িয়ে রেখে ভূমিমন্ত্রী ও পাবনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামসুর রহমান শরীফ ডিলু এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও রাজশাহী-৬ আসনের সংসদ সদস্য শাহরিয়ার আলম নিজেদের বিতর্কিত করেছেন।
সম্প্রতি নাসিরনগরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বসতবাড়িতে হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আলোচনায় উঠে আসেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ছায়েদুল হক ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। জেলার নাসিরনগরের ঘটনায় দু’জনের বিরোধ উঠে আসে আলোচনায়। এছাড়াও গাইবান্ধার সাঁওতাল পল্লীতে হামলার ঘটনায় উঠে আসে গাইবান্ধা-৪ আসনের সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ এবং তার ক্যাডার বাহিনীর নাম। এ দুই ঘটনায় দেশের ভেতর ও বাইরে ক্ষমতাসীন দলকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছে।
আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলেই কোনো না কোনোভাবে আলোচনায় চলে আসেন মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং বর্তমানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। আওয়ামী লীগের গত মেয়াদে চাঁদপুর-২ আসনের এই সংসদ সদস্য তার মেয়ের জামাইকে নিয়ে বেশ অস্বস্তিতে পড়েছিলেন। নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত সাত খুনের ঘটনায় তার মেয়ের জামাইয়ের জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনা সারা দেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াও এ ঘটনায় দলের ভেতরে এবং সরকারে বেশ কোণঠাসা হয়ে পড়েন। তার ছেলে দিপু চৌধুরীর বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিযোগ। আওয়ামী লীগ সরকারের বর্তমান মেয়াদে বাবার রাজনৈতিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসাসহ নানা ঘটনায় জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ রয়েছে দিপুর বিরুদ্ধে।
এছাড়াও দুর্নীতির একটি মামলায় সাজা থাকায় মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার মন্ত্রিত্ব নিয়ে সাংবিধানিক জটিলতা তৈরি হয়েছে। এর আগে তাকে দুর্নীতির একটি মামলায় খালাস দিয়ে হাইকোর্ট একটি রায় দেন। কিন্তু ১৪ জুন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ ওই রায় বাতিল করে দিয়েছেন। ফলে ঢাকার বিশেষ আদালতের দেয়া ১৩ বছরের সাজা বহালই রয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এর ফলে সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার মন্ত্রিত্ব ও সংসদ সদস্য পদ খারিজ হয়ে যাওয়ার কথা।
খুলনার ফুলতলা ডুমুরিয়ার সংসদীয় এলাকার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী এবং খুলনা-৫ আসনের সংসদ সদস্য নারায়ণ চন্দ্র চন্দ ও তার পরিবারের সদস্যরা- এসব অভিযোগ স্থানীয়দের। ফুলতলা ডুমুরিয়ায় সব হয় তাদের কথাতেই। দুই উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ বাণিজ্য থেকে শুরু করে জমি দখল, বিভিন্ন দফতরে চাকরি বাণিজ্য সব ক্ষেত্রেই তাদের প্রভাব রয়েছে। মামলার ভয়ে এ নিয়ে মুখ খোলেন না এলাকার লোকজন। যদিও নারায়ণ চন্দ্র চন্দ যুগান্তরের কাছে দাবি করেছেন, ‘এসব তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার, মিথ্যা ও বানোয়াট।’
গত বছর ১৩ এপ্রিল রাতে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ছেলে বখতিয়ার আলম রনি কর্তৃক দুই নিরীহ ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যা করার ঘটনায় আলোচনায় উঠে এসেছেন সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য ও মহিলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক পিনু খান। নিউ ইস্কাটন রোডে মায়ের প্রাডো জিপে থাকা অবস্থায় নির্বিচারে গুলি চালান বখতিয়ার আলম রনি। এতে সিএনজিচালক ইয়াকুব এবং রিকশাচালক হাকিম গুরুতর আহত হন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তারা দু’জনই মারা যান। বিষয়টি ধামাচাপা দিতে মা পিনু খান সব ধরনের চেষ্টা তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রায় দেড় মাস ঘটনাটি কেউ প্রকাশ করেনি। কিন্তু মিডিয়ায় খবরটি প্রকাশ হওয়ায় পিনু খানের সব তদবির আপাতত ভেস্তে গেছে। তবুও হাল ছাড়েননি তিনি। ছেলেকে রক্ষায় দল ও সরকারের নানা মহলে দৌড়ঝাঁপ অব্যাহত রেখেছেন এই সংসদ সদস্য।
বছরজুড়েই কোনো না কোনোভাবে আলোচনায় রয়েছেন কক্সবাজার-৪ আসন থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি। অবৈধ সম্পদ উপার্জনের অভিযোগে তার এবং তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এই মামলায় নিু আদালত তাকে তিন বছর কারাদণ্ড দেন। উচ্চ আদালত এই রায় বহাল রাখলে সদস্য পদ হারাতে হবে আবদুর রহমান বদিকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সন্ত্রাসী তৎপরতা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা, চোরাচালান, জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে বদির বিরুদ্ধে। সম্প্রতি মানব পাচারের ভয়াবহ চিত্র উদ্ঘাটিত হলে এ চক্রেরও গডফাদার হিসেবে উঠে আসে তার নাম। ইয়াবাসহ মাদক ব্যবসা এবং চোরাচালানও একচ্ছত্রভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন বলেও স্থানীয়দের অভিযোগ। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ প্রশাসনের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা তার ভয়ে তটস্থ থাকেন সব সময়। একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেও আলোচনায় এসেছেন তিনি।
গত বছর ২০ মে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ফেনী শহরের বিলাসী সিনেমা হল সংলগ্ন এলাকায় প্রকাশ্যে খুন হন ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান একরামুল হক একরাম। অভিযোগ রয়েছে, এ হত্যাকাণ্ডে সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীর লোকজন সরাসরি নেতৃত্ব দেয়। বিষয়টি নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠলেও তিনি থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। মাঝখানে কিছুটা নীরব থাকলেও আবার আলোচনায় চলে আসেন নিজাম উদ্দিন হাজারী। ৬ জুন সন্ধ্যায় ফেনী শহরতলির লালপুল এলাকায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্রসহ ২৬ জনকে আটক করে র্যাব। তারা সবাই নিজাম উদ্দিন হাজারীর লোক বলে পরিচিত। আটককৃতদের রাতেই যাতে মুক্তি দেয়া হয়, সেজন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, রেলপথ, আঞ্চলিক মহাসড়ক বন্ধ করে দেয় নিজাম উদ্দিন হাজারীর অনুসারীরা। কিন্তু র্যাব সদস্যরা অনড় থাকায় তা আর সম্ভব হয়নি।
এ অভিযোগ অস্বীকার করেন নিজাম উদ্দিন হাজারী। তিনি যুগান্তরকে বলেন, একরামুল হক একরাম হত্যায় তার কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই। রাজনৈতিকভাবে হেয় করার জন্যই একটি কুচক্রী মহল তাকে এ ঘটনায় জড়ানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সফল হয়নি। তিনি বলেন, ‘আমি নিজেও বারবার এ ঘটনায় যারা জড়িত তাদের খুঁজে বের করার দাবি জানিয়েছি।’
টাঙ্গাইল-৩ আসনের সরকারদলীয় সদস্য আমানুর রহমান খান রানার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা ছাড়াও রয়েছে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জমি দখলসহ বিভিন্ন অভিযোগ। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক আহম্মেদ হত্যাকাণ্ডে গ্রেফতারকৃতরা এ ঘটনায় আমানুর রহমান রানার সম্পৃক্ততা রয়েছে দাবি করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, টাঙ্গাইলের সব ধরনের উন্নয়নমূলক কাজের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি ও তার লোকজন। সম্প্রতি ফারুক আহম্মেদ হত্যাকাণ্ড মামলায় জামিন নিতে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন আমানুর রহমান খান রানা। আদালত জামিন না দিয়ে তাকে জেল হাজতে প্রেরণ করে। সেই থেকে কারাগারেই রয়েছেন তিনি।
পুরো জেলা নিয়ন্ত্রণ করেন পিরোজপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য একেএমএ আউয়াল। এ জেলায় যা হয় সবই তার ইশারায়, তার নির্দেশে। বিরোধিতা করলেই তার ওপর খক্ষ নেমে আসে। সম্প্রতি একেএমএ আউয়ালের এই একচ্ছত্র আধিপত্যের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন তার আপন দুই ভাই।
যদিও এ অভিযোগ অস্বীকার করে একেএমএ আউয়াল যুগান্তরকে বলেন, ‘স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি আমার বিজয় সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। তাই তারা প্রথম থেকেই আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ আমার সঙ্গে আছে।’
সরাসরি চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে যশোর-১ আসনের সদস্য শেখ আফিল উদ্দিনের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি গোয়েন্দা সংস্থাও তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ এনে প্রতিবেদন দিয়েছে। যদিও তিনি এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, এসব তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।
হত্যাকাণ্ডে মদদ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে যশোর-৪ আসনের সংসদ সদস্য রণজিত কুমার রায়ের বিরুদ্ধে। অভিযোগ রয়েছে, যশোরের অভয়নগরে কাউন্সিলর মোল্লা ওয়ালিয়ার রহমান হত্যাকাণ্ডের পেছনে মদদ রয়েছে তার। এ ঘটনায় রণজিত কুমার রায়ের বিচার দাবি করে সম্প্রতি স্থানীয় আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের একটি অংশ প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিয়েছে।
অভিযোগ অস্বীকার করে রণজিত কুমার রায় যুগান্তরকে বলেন, ‘এটি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। স্বার্থান্বেষী একটি মহল রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য এ ধরনের অপপ্রচার চালাচ্ছে।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য গোলাম রব্বানীর বিরুদ্ধেও অভিযোগের শেষ নেই। একসময়ের কানসাট আন্দোলনের এ নেতা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে সংসদ সদস্য হন। এর পরপরই বদলে যেতে থাকে তার আচরণ। সন্ত্রাস, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগ বাণিজ্য, টিআর ও কাবিখা প্রকল্পে নানা অনিয়ম ও দলের ভেতরে কোন্দল সৃষ্টিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে গোলাম রব্বানীর বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘সবকিছুই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও ভিত্তিহীন।’
বিতর্কিত সংসদ সদস্যদের বেপরোয়া আচরণে প্রায়ই দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই যেন সংবাদের বড় বড় শিরোনাম দখল করে নতুন করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে পছন্দ করেন এই বিতর্কিতরা। গত বছর এ রকম আলোচনায় ছিলেন শিশু সৌরভের পায়ে গুলি করে গাইবান্ধা-১ আসনের সরকারদলীয় সদস্য মনজুরুল ইসলাম লিটন। খোদ প্রধানমন্ত্রী লিটনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন। ২ অক্টোবর ভোরে চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র সৌরভের পায়ে গুলি চালিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করেন মনজুরুল ইসলাম লিটন। ওই শিশুটির দুই পা গুলিবিদ্ধ হয়। লিটন শুধু গুলি করেই ক্ষান্ত হননি, শিশুটির চিকিৎসা যাতে না হয় সেজন্য তার বাহিনী দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখেন; পরে পুলিশ গিয়ে শিশুটিকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। এ ঘটনায় করা মামলায় তিনি গ্রেফতারও হয়েছিলেন। বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। মামলাটি বিচারাধীন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লিটনের বিরুদ্ধে শুধু শিশু সৌরভকে গুলি করা নয়, তার বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অভিযোগ। ২২ সেপ্টেম্বর ভোরে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ঢুকে ওয়ার্ডবয় মাহমুদুল হাসান মামুনকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন লিটন। দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ায় প্রাণে রক্ষা পান মামুন। ওই সময় লিটনের এমন কর্মকাণ্ডে হাসপাতালে থাকা রোগী, ডাক্তার ও কর্মচারীরাও আতংকিত হয়ে ছোটাছুটি করেন।
ঠাকুরগাঁও-২ আসনের সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় কয়েকটি সংখ্যালঘু পরিবারের জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। জমি ফেরত চাইতে গেলে ওই পরিবারের লোকজনের ওপর এমপির বাহিনী হামলা করে। এ নিয়ে সারা দেশে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। নিজ দলের মন্ত্রী-এমপিরাও ওই দবিরুল ইসলামের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। দবিরুল ইসলাম তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত সব অভিযোগ যুগান্তরের কাছে অস্বীকার করেছেন।
ফেনী-৩ আসনের সংসদ সদস্য রহিম উল্যাহর বিরুদ্ধে নিজ দলের কর্মী আজিজুল হককে গুলি করে হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীরা তার কুশপুত্তলিকা দাহ করে এবং শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন করেন। এ ঘটনায় ওই এমপির বিরুদ্ধে একটি মামলাও হয়। সুত্র দৈনিক যুগান্তর
পাঠকের মতামত