গত বছর পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঈদ করলেও এবার রাঙামাটির কাউখালি উপজেলার কাশখালি গ্রামের দিনমজুর মো. জাকিরের মনে বিষাদের কালো ছায়া। পাহাড় কেড়ে নিয়েছে মা আর দুই ভাই-বোনকে। পাহাড়ি ঢলে হারিয়েছেন বাড়ির ধ্বংসাবেশষটুকুও। জাকিরকে এবার তাই ছুঁতে পারছে না ঈদের আনন্দ।
শুধু জাকিরই নন, উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের ঘিলাইছড়ি গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ইছহাক, কচুখালির কারবারি পাড়ার রিজিয়া বেগমের মতো অনেকেই এবার ঈদ করবেন স্বজন আর সহায়-সম্বল হারানোর বেদনা নিয়ে।
গত ১২ জুন রাতে প্রবল বর্ষণে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামসহ দেশের ছয় জেলায় দেড় শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১২০ জন মারা যায় রাঙামাটিতে। জেলা প্রশাসনের হিসাবে শুধু রাঙামাটিতেই পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা প্রায় দুই হজারের মতো।
স্থানীয় প্রশাসনের হিসাবে, পাহাড় ধস ও ঢলে কাউখালি উপজেলায় ১৩ জন আদিবাসীসহ মারা গেছে ২১ জন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সহস্রাধিক বাড়িঘর।
জাকিরের মতো পাহাড় ধসে ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকজন রোববার কাউখালি উপজেলা সদরে এসেছিলেন চট্টগ্রামে কর্মরত সংবাদকর্মীদের উদ্যোগে সংগৃহিত অর্থ সহায়তা নিতে। সেখানে তারা ভয়াবহ সেই দিনটির কথা বলেন, জানান স্বজন হারানোর বেদনার কথা।
দিনমজুর জাকির বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “১৩ জুন রাতে যখন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল তখন থেকে কেমন যেন ভয় হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল বড় কোনো বিপদ ঘটতে যাচ্ছে।
“রাতে খাওয়া শেষ করে ভাবছিলাম সকাল হলেই সরে যাব। কিন্তু শেষ রাতের দিকে পাহাড় ধসে পড়ে। আমি সামনের কক্ষে থাকায় পেছন থাকা ধসে পড়া পাহাড় আমার রুম পর্যন্ত আসেনি, তাই বেঁচে গেছি।”
ঈদের চিন্তা তিনি করছেন না। সহায়তা হিসেবে পাওয়া পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে আগে পাহাড় ধসে আহত বাবার চিকিৎসা, তারপর সংসারের অন্য প্রয়োজন মেটাবেন বলে জানান তিনি।
মাকে হারিয়ে এবারের ঈদ বিবর্ণ হয়ে গেছে উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের ঘিলাইছড়ি গ্রামের কিশোরী শারমিন আক্তারের। অনেক বলেও তাকে ঈদের নতুন জামা কেনাতে পারেননি বাবা ইছহাক।
“ঈদের আনন্দ চাই না, আল্লাহ যেন পাহাড়ে এমন দুর্যোগ আর না দেন সেটাই চাই,” বলেন এই ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী।
মানুষের ঘরে কাজ করে এক নাতি ও এক নাতনিকে ভালেই ছিলেন উপজেলার কচুখালির কার্বারি পাড়ার রিজিয়া বেগম। পাহাড় ধসে মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে এখন অসহায় তিনি। ধসের পর অনেকের সঙ্গে আশ্রয় কেন্দ্রে উঠলেও কয়েকদিন পর তাদের সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় ।
তিনি বলেন, “আশ্রয়কেন্দ্রে তিনদিন ছিলাম। এরপর আমাদের বের করে দিয়েছে। এখন মানুষের ঘরে থাকি। এভাবে আর কয়দিন থাকব? দুই নাতি নিয়ে এ ঘর ও ঘর করে দিন কাটাচ্ছি। সামনে ঈদ। এখনো দুই নাতির জন্য কিছু কিনতে পারিনি।”
তবে সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পাওয়ায় কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়েছে বলে জানান তিনি।
রাঙামাটি শহর ও ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলাগুলোতে প্রতিদিনই নানা সামাজিক সংগঠন, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ত্রাণ সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা কমল বরণ সাহা জানান, পাহাড় ধসের পর তাৎক্ষণিকভাবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে ২০ কেজি চাল, শুকনো খাবার দিয়েছেন।
“এছাড়াও নিহত ২১ জনের ১২ পরিবারের জন্য তিন বান্ডিল করে ঢেউটিন ও ঘর তৈরির জন্য নয় হাজার টাকা আমাদের কাছে পৌঁছেছে। ঈদের পরই আমরা তাদেরকে এসব টাকা আর ঢেউটিন দেব।”
এছাড়াও যারা বাড়িঘর হারিয়েছে তাদের প্রত্যেকের জন্য দুই বান্ডিল করে করে ঢেউটিন ও ছয় হাজার টাকা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান তিনি।
পাঠকের মতামত