উখিয়া নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ২৭/০৪/২০২৫ ১০:৩৬ এএম

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ ও ফ্যাসিবাদের তকমা লাগানো শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয় ৫ আগস্ট। পতনের দিনই কক্সবাজার জেলা,উপজেলা,ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভাংচুর চালায় বিক্ষুক্ষব্ধ ছাত্র-জনতা। দেওয়া হয় আগুনও।

দীর্ঘ ১৬ বছর দাপটের সঙ্গে রাজনীতির মাঠ চষে বেড়ানো কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা এখন লাপাত্তা। এরই মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন সাবেক এমপি,উপজেলা চেয়ারম্যান সহ বর্তমান ও সাবেক অনেক নেতা-কর্মী। খোঁজ নেই সাবেক চার এমপি সাইমুম সরোয়ার কমল,আশেক উল্লাহ রফিক,জাফল আলম,জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এড.ফরিদুল ইমলাম,সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান সহ বিভিন্ন উপজেলার চেয়ারম্যান, পৌর মেয়রসহ শতাধিক জনপ্রতিনিধির। পালিয়ে বেড়াচ্ছেন দলটির সহযোগী সংগঠনের নেতারাও। অথচ আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে কক্সবাজার জেলায় প্রায় ৬ লক্ষ কোটি টাকার যখন বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছিল তখন তারা ছিল মধ্যমণি।

গত বছর ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর টানা সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা দলটির নেতারা নিখোঁজ হলেও এতদিন যাদের দমিয়ে রাখা হয়েছিল সেই বিএনপি-জামায়াত সক্রিয় হয়ে উঠেছে জেলার রাজনীতির মাঠে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে কক্সবাজার শহরসহ পুরো জেলাই বিএনপি-জামায়াত ও ছাত্র-জনতার দখলে চলে যায়। ওই দিনই পালিয়ে যান আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার পর থেকে আর দেখা মেলেনি জেলার শীর্ষ নেতাদের। এরপর থেকে পর্যায়ক্রমে দায়ের হওয়া হত্যা মামলা ও একাধিক বিস্ফোরক মামলার আসামি হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর হাজার হাজার নেতাকর্মী।

পালিয়ে থাকা নেতাদের কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় থাকলেও অনলাইন ও অফলাইনে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ প্রভাবশালী অনেক নেতার খোঁজ মিলছে না। এমন অবস্থায় জেলার রাজনৈতিক অঙ্গনে দলটিকে নিষ্ক্রিয় বলা যায়। তবে বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যেও বিভিন্ন জেলায় মাঠে নামতে শুরু করেছে বিপর্যস্ত ও সংকট অবস্থায় তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। সম্প্রতি বিপর্যস্ত দলটি আকস্মিক ঝটিকা মিছিল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভর করে এগোতে চাচ্ছে। কিন্তু বিপরীত অবস্থা কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনগুলোর।

সংকটে থাকা তৃণমূলের অনেকেই বলেছেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময় প্রথমে তাদের কাছে জীবন বাঁচানোই প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদের অনেকে জেলার ভেতরে ও বাইরেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। সরকারের পতনের আট মাস পার হলেও দেশে থাকা তাদের কোনো নেতাই হাল ধরতে বা ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। তবে জেলার ভেতরে ও বাইরে অবস্থানকারী নেতাদের অনেকে নিয়মিত কর্মী–সমর্থকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন।

তাঁদের দাবি, কক্সবাজার শহর ও বিভিন্ন উপজেলায় অপারেশন ডেভিল হান্টে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ ও মহিলা লীগের অন্তত ১০০ নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। এ ছাড়া গ্রেপ্তার এড়াতে অনেকেই আত্মগোপনে আছেন। বেশির ভাগই ফেসবুকে দলের পক্ষে এবং দেশে সংঘটিত বিভিন্ন অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সরব আছেন।

জেলা আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা মনে করেছে, ‘৫ আগস্টের আগে আমাদেরও ভুলত্রুটি ছিল। তবে কক্সবাজার জেলায় আওয়ামী লীগ সরকার প্রায় ৬ লক্ষ কোটি টাকার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের ভুল ভাঙতে শুরু করেছে। পরিবেশ পাল্টে যাচ্ছে, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষগুলো অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে শুরু করেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নেতা-কর্মী কক্সবাংলাকে বলেন, ৩ ও ৪ আগস্টের ছাত্র-জনতার ওপর সশস্ত্র হামলার অভিযোগে কক্সবাজারে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের ৫২০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে, যার মধ্যে জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতারা রয়েছেন। এছাড়াও, সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের অনেক নেতাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। এই ব্যাপক মামলা ও গ্রেফতারের কারণে কক্সবাজারের আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা হয়তো প্রকাশ্যে আসতে ভয় পাচ্ছেন।

সরকার পতনের পর সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মাঠে নামলেও কক্সবাজারে তাদের তেমন কোনো সক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে না। এর পেছনে বেশ কিছু কারণ ও প্রেক্ষাপট রয়েছে বলে তারা মনে করেন। যেমন- কক্সবাজারে শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক চাঁদাবাজি-দখলবাজির রাজত্ব ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এ ধরনের নেতাদের কার্যকলাপ হয়তো স্থানীয় পর্যায়ে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে, যা নেতাকর্মীদের মাঠে নামতে নিরুৎসাহিত করছে। খুলনা বা শরীয়তপুরের মতো অন্যান্য জেলায় আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল দেখা গেলেও কক্সবাজারে প্রশাসন সম্ভবত বেশি সতর্ক রয়েছে। বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর থেকে কক্সবাজারে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিয়ে প্রশাসনের কঠোর নজরদারি থাকতে পারে, যা নেতাকর্মীদের প্রকাশ্যে আসতে বাধা দিচ্ছে।

এছাড়া কক্সবাজারের অনেক শীর্ষ নেতা এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন বা আত্মগোপনে রয়েছেন। হয়তো এই নেতৃত্বের শূন্যতা বেশি প্রকট, যার ফলে স্থানীয় নেতাকর্মীরা সংগঠিত হতে পারছেন না। জেলার রাজনৈতিক পরিস্থিতি অন্যান্য জেলার চেয়ে ভিন্ন হতে পারে। কক্সবাজারে আওয়ামী লীগ বিরোধী শক্তিগুলো হয়তো বেশি সক্রিয় বা সংগঠিত, যা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মাঠে নামতে নিরুৎসাহিত করছে। পাশাপাশি সরকার পতনের পর জেলায় দলের ভেতরে নেতৃত্ব নিয়ে বিভ্রান্তি বা পুনর্বিন্যাস চলতে পারে, যার ফলে নেতা-কর্মীদের কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্তিমিত। নতুন প্রশাসন বা রাজনৈতিক শক্তির উত্থানে স্থানীয় নেতারা হয়তো প্রকাশ্যে কম সক্রিয় বা সতর্ক অবস্থানে থাকতে পারেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কয়েকজন নেতাকর্মী কক্সবাংলাকে বলেন,বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ প্রায় ৭৬ বছর বয়সে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এবার বেশি সংকটে পড়েছে। ক্ষমতায় থাকতে ত্যাগী কর্মীদের মূল্যায়ন না করে হাইব্রিডদের প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। টাকার বিনিময়ে অযোগ্য, অদক্ষদের কাছে পদ বিক্রি করে দলটির বারোটা বাজিয়ে জেলার শীর্ষ নেতারা পালিয়ে গেছেন। আমরা যারা বঞ্চিত ছিলাম, তারাই বেশি বিপদে রয়েছি। তাদের দাবী,যদি ডিসেম্বর বা জানুয়ারীতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাহলে দ্রুত আমাদের ভবনগুলো আবার খুলে দেওয়া হবে। আবারও নেতা-কর্মীদের পদচারণে জেলার দলীয় কার্যালয়গুলো সরগরম হয়ে উঠবে। আমরা আরও বৃহত্তর দলীয় কর্মসূচি পালন করব। সে পরিকল্পনা নিয়ে আওয়ামী লীগ এগোচ্ছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়াবে।

এ ব্যাপারে জেলা বিএনপির তৃণমূলের নেতারা বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ১৬ বছর ধরে আমাদের নামে শত শত মিথ্যা মামলা দিয়েছে। মামলা, হামলা আর হুলিয়ার মধ্যে আতঙ্ক নিয়েই আমরা দলের কর্মসূচি পালন করেছি। কর্মসূচির মধ্যেও হামলা চালানো হয়েছে। তারপরও আমরা ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলন করেছি। এতে দলের নেতাকর্মীদের মামলা-হামলার শিকার হতে হয়েছে। আমাদের অনেক কেন্দ্রীয় নেতাকে মিথ্যা মামলায় সাজা দেওয়া হয়। তিনি দুই বছর এলাকায় আসতে পারেননি। তবে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর দীর্ঘ ১৬ বছর পর প্রাণ খুলে রাজনীতি করছি। জেলার উন্নয়নের লক্ষ্যে সভা-সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করতে পারছি। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে, যোগ করেন তিনি। সুত্র: কক্সবাংলা

পাঠকের মতামত