
স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার ::
দুই দিনের টানা ভারী বর্ষণে সৃষ্ট পাহাড়ী ঢল ও জোয়ারের পানিতে কক্সবাজার জেলার বিস্তুীর্ণ এলাকা পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। বন্যাকবলিত ওসব এলাকার হাজার হাজার নারী-পুরুষ মানবেতর দিনযাপন করছে। মহেশখালীতে পাহাড় ধ্বসে মো: মোনার আলম ও টেকনাফের বাহারছড়া শামলাপুরে মাথায় গাছ পড়ে মঈনুদ্দিন ও ঈদগাঁওতে ঢলের পানিতে উম্মে সালমা নামে এক শিশুসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে পৃথক এসব ঘটনা ঘটে।
সরেজমিনে দেখা যায়, রামু কাউয়াখোপ, চকরিয়া, পেকুয়া ও সদরের বৃহত্তর ঈদগাঁওর ৪০ গ্রাম প্লাবিত এবং প্রায় ২০ হাজারের অধিক পরিবার পানি বন্দি হয়ে পড়েছে। কোমর সমান পানিতে তলিয়ে গেছে ঈদগাঁও পশ্চিম ভোমরিয়াঘোনা, দরগাহ পাড়া, ইসলামাবাদের খোদাইবাড়ী, ওয়াহেদরপাড়া, হিন্দু পাড়ার, জালালাবাদের লরাবাক, মোহনবিলা, পোকখালী, ইসলামপুর এবং চৌফলদন্ডীর প্রায় ২০গ্রাম জোয়ারের পানি ও পাহাড়ি ঢলে নিমজ্জিত।
বৃহত্তম ঈদগাঁও বাজারের রক্ষাবাধেঁর উপর দিয়ে প্রবল বেগে ঢলের পানি উপচে পড়ে বাজারের উত্তর পার্শ্বে বাঁশঘাটা অথৈ থৈ পানিতে প্লাবিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে বাঁশঘাটা ঝুলন্ত ব্রিজটি। ঈদগাঁও নদীর ঢলের পানি জলনাশী দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার ফলে বাঁধ ভেঙ্গে পশ্চিম ভোমরিয়াঘোনা, চৌধুরীপাড়া, দরগাহ পাড়া, ঈদগাঁও বাজার এলাকা বর্তমানে পানিবন্দি।
দুই দিনের টানা ভারী বর্ষণে চকরিয়া মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে পাহাড়ি ঢলের পানি নেমেছে। বেশির ভাগ নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। নদীতে পাহাড়ি ঢলের পানি প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় মঙ্গলবার পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে প্রবাহিত হচ্ছে।
চকরিয়া পৌরসভার মেয়র আলমগীর চৌধুরী বলেন, ভারী বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে পৌরসভার একাধিক নিম্নাঞ্চল। এক নম্বর বাঁধ এলাকা হয়ে লোকালয়ে নদীর পানি ঢুকে পড়ায় মজিদিয়া মাদ্রাসাসহ আশপাশ এলাকার অন্তত শতাধিক পরিবারের বসতঘরে পানি ঢুকে লোকজন দুর্ভোগে পড়েছে।
সুরাজপুর-মানিকপুর ইউপি চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম বলেন, ভারী বর্ষণে মাতামুহুরী নদীতে বেড়ে চলছে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি। ইতোমধ্যে নদীর পানি ঢুকে শতাধিক পরিবারের বসতঘর প্লাবিত হয়ে পড়েছে।
বরইতলী ইউপি চেয়ারম্যান জালাল আহমদ সিকদার বলেন, ভারী বৃষ্টিপাতে মাতামুহুরী নদীতে পানি প্রবাহ বেড়েছে। নদীর শাখা খাল হয়ে গোবিন্দপুর, ডেইঙ্গাকাটা, রসুলাবাদসহ একাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়ে গেছে। এলাকার দুর্গত জনসাধারণ বর্তমানে পানিবন্দি হয়ে পড়ায় চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন তারা।
এদিকে টেকনাফের বাহারছড়া শামলাপুর মাথায় পুরানপাড়ায় গাছ পড়ে মঈনুদ্দিন (৩৫) তিনি স্থানীয় আশ্রাফ আলীর পুত্র। বন বিভাগের লটের জমানো ঘূর্ণিঝড়ে ভেঙ্গে পড়া ঝাউ গাছের টুকরা বিট অফিসে আনার জন্য গাড়িতে গাছ তুলতে গাছসহ পা পিছলে পড়ে গাছটি মঈনুদ্দিনের মাথায় পড়ে।
সদরের ইসলামাবাদ ইউছুপেরখীলে ঢলের পানিতে খেলতে নেমে উম্মে সালমা (৭) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে মুরা পাড়ায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত শিশু স্থানীয় মো: আব্বাসের কন্যা। ঢলের পানি খেলতে নেমেছিল শিশু উম্মে সালমা।
এসময় ঢলের পানির তোড়ে পড়ে সে ভেসে যায়। পরে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে। মঙ্গলবার সকালে মহেশখালীর হোয়ানক মোহরাকাটার মোনার আলম (৩৫) পাহাড় ধ্বসে মারা গেছে।
তিনি স্থানীয় আবদুল ছালামের পুত্র। ঘরের বাইরে কাজ করার সময় পাহাড়ের কিছু অংশ ভেঙ্গে মোনার আলমের গায়ের উপর পড়ে। এতে তিনি ঘটনাস্থলে মারা যান। মহেশখালী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল কালাম ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
চকরিয়া কোনাখালী ইউপি চেয়ারম্যান দিদারুল হক সিকদার ও বিএমচর ইউপি চেয়ারম্যান এসএম জাহাংগীর আলম বলেন, ভারী বর্ষণের নদীর তীরবর্তী নীচু এলাকার লোকালয়ে পানি ঢুকে দুই ইউনিয়নের হাজারো পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। চিরিঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান জসীম উদ্দিন বলেন, দুইদিনের ভারী বৃষ্টিপাতে মাতামুহুরী নদীতে পাহাড়ি ঢলের প্রবাহ বৃদ্ধি ও চিংড়িজোনের শত শত চিংড়ি প্রকল্প পানিতে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
খুটাখালীতে ভারী বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে খুটাখালীর ছড়ার বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে গেছে। ভাঙ্গন এলাকা দিয়ে ছড়ার বন্যার পানি অনুপ্রবেশ করায় পিয়াজ্জ্যাকাটা, হরইখোলা, পূর্বপাড়া, অফিসপাড়া, নাপিতপাড়া, চড়িবিল, দরগাহপাড়া, কিশলয় স্কুল, ফরেষ্ট অফিস, মাইজপাড়া, হাফেজখানা, দক্ষিন পাড়া, খুটাখালী উচ্চ বিদ্যালয়, জলদাশ পাড়া, উত্তর ফুলছড়ি এলাকার শত শত ঘরবাড়ী পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
এদিকে পোকখালীর গোমাতলী এলাকার বাসিন্দারা বলেন, গোমাতলীকে দুর্গত এলাকা ঘোষনা করে- সেখানকার পানি বন্দি মানুষের জন্য দ্রুত ত্রাণ সামগ্রী পাঠানোর জন্য জেলা প্রশাসক- উপজেলা পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তার প্রতি জোর দাবী জানাচ্ছি। দীর্ঘ ১ বছরের বেশি সময় ধরে সাগরের জোয়ার ভাটার সঙ্গে পানিবন্দি হয়ে অমানবিক জীবন যাপন করছে পোকখালীর ১০ হাজার মানুষ। গত বছর রোয়ানোর তান্ডবে গোমাতলীর বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে সাগরের জোয়ার ভাটায় দুর্বিসহ জীবন যাপন করে আসছে এখানকার অসহায় মানুষগুলো।
চৌফলদন্ডী ইউনিয়নের ফরিদুল আলম মেম্বার জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিয়ন্ত্রণাধীন ২৭নং স্লুইচগেইটটি জোর পূর্বক বন্ধ করে রাখায় উজান থেকে নেমে আসা পানি বের হতে না পারায় এ সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে একাধিকবার তাগাদা দিলেও কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
ইসলামাবাদের চেয়ারম্যান নুর ছিদ্দিক জানান, ভারি বর্ষনে ঈদগাঁও নদীতে সৃষ্ট ঢলের পানিতে প্লাবিত হয়েছে নিম্নাঞ্চল। জালালাবাদের চেয়ারম্যান ইমরুল হাসান রাশেদ বলেন, বেড়িবাধ ভাঙ্গনে ও ঢলের পানিতে প্রায় ৮’শ পরিবার পানি বন্দী আছে।
এ ছাড়াও ঈদগাঁও নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকা ৩-৪ ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ঈদগাঁও নদী দিয়ে অতিরিক্ত পানি প্রবাহিত ও রাবারড্যামের স্লুইচ গেইট বন্ধ রাখায়-সোমবার বিকেলে বেড়িবাধের (জালালাবাদ অংশে) রাবার ড্যাম সংলগ্ন এলাকার বিরাট একটি অংশ পানির প্রবল স্রোতে ভেঙ্গে গেছে। ভাঙ্গন এলাকা দিয়ে ঈদগাঁও খালের বন্যার পানি প্রবেশ করায় বৃহত্তর ঈদগাঁও এলাকার লোকজন অত্যন্ত নাজুকঅবস্থায় দিনযাপন করছে। ঈদগাঁও বাজার ফরাজীপাড়া সড়কের পূর্ব লরাবাগের হাফেজখানা পয়েন্ট দিয়ে বন্যার পানি প্রবাহিত হওয়ায় যানবাহন ও জনসাধারণের চলাচলে চরম বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে।
পানির তোড়ে ভেঙ্গে গেছে পালাকাটা এলাকায় অনেকের বসত বাড়ি ও সীমানা প্রাচীরের দেয়াল এবং ভেসে গেছে বহু মুরগীসহ গৃহস্থালী সামগ্রী। সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: নজরুল ইসলাম প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন।
অপরদিকে ঘূর্ণিঝড় মোরার আঘাতে নষ্ট হয়ে পড়া একাধিক সড়ক এখনও সংস্কার হয়নি। বঙ্কিম বাজার থেকে আলমাছিয়া মাদ্রাসা গেট পর্যন্ত সড়কটির অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে। খানা খন্দকে ভরপূর ও মিনি পুকুরগুলোতে জমে থাকা ময়লা পানির ছিটায় প্রতিনিয়ত বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় পথচারীদের।
বিশেষ করে স্কুল কলেজ এবং মাদ্রাসাগামী শিক্ষার্থীদের পোহাতে হচ্ছে অবর্নণীয় দুর্ভোগ। পোকখালী গোমাতলী গ্রাম জোয়ারের পানিতে আবারও তলিয়ে গেছে। বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় কয়েক হাজার মানুষ দীর্ঘদিন ধরে কার্যত পানিবন্দী অবস্থায় জীবন যাপন করছে। এছাড়া ইসলামপুর, চৌফলদন্ডী এবং ভারুয়াখালীর নিম্নাঞ্চলও অতিবর্ষণে ২-৩ ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
পাঠকের মতামত