
ইব্রাহিম খলিল মামুন, কক্সবাজার
কক্সবাজারের অঞ্জারঘোনার সংরক্ষিত বন। এর মধ্যে প্রায় এক একর বনভূমিতে টিনের বাউন্ডারি দিয়ে বসতি স্থাপন করেছেন নাছির উদ্দিন নামে একজন। এর দক্ষিণ পাশে পাহাড় কেটে বসতি নির্মাণ করেছেন জাফর আলম নামের আরেকজন। শুধু নাছির উদ্দিন ও জাফর আলম নন, কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের পানেরছড়া রেঞ্জে এভাবে সংরক্ষিত বনের পাহাড় ও গাছ কেটে গড়ে তোলা হয়েছে
তিন শতাধিক ঘর। অভিযোগ, স্থানীয় বনকর্মীদের ঘরপ্রতি ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা দিলেই মেলে বনের জমি।
রামু উপজেলার দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের অঞ্জারঘোনার এলাকায় সরেজমিন দেখা যায়, প্রায় ২০ একরের পাহাড়ের বিভিন্ন অংশ কেটে নির্মাণ করা হয়েছে নতুন বসতি। এখনও ঘর নির্মাণ চলছে। অনেকে আবার বনভূমি দখল করে তা বিক্রি করেছেন। এমনকি পানেরছড়া বনবিট কার্যালয়ের আশপাশে বনভূমি দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে অন্তত ৫০টি বসতি।
স্থানীয় ফরিদুল আলম, ওসমানসহ একাধিক বাসিন্দা জানান, পানেরছড়া রেঞ্জ এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বনভূমিতে অবৈধভাবে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। তবে গত কয়েক মাসে স্থাপনা নির্মাণের হার বেড়ে গেছে। স্থানীয় বনকর্মীদের ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা দিলেই পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন পরিমাণে বনভূমি। পরে সেখানে থাকা গাছ ও পাহাড় কেটে ঘরসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করছেন স্থানীয়রা। তারা আরও জানান, স্থানীয় ১০ জনের একটি দলের মাধ্যমে বন বিভাগের লোকজন ওই টাকা তোলে।
বন বিভাগের একটি সূত্র জানায়, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে (২০০৯-২০১৩) পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কমন্ত্রী ছিলেন ড. হাছান মাহমুদ। ওই সময় তাঁর আশীর্বাদে নিয়োগ পাওয়া বন কর্মকর্তাদের একজন শরিফুল আলম বর্তমানে পানেরছড়া রেঞ্জ কর্মকর্তা। তিনি এখানে যোগ দেওয়ার পর থেকে বেপরোয়া আচরণ করছেন। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে আগেও টাকার বিনিময়ে বনভূমি বিক্রির অভিযোগ রয়েছে।
অবশ্য পানেরছড়া রেঞ্জ কর্মকর্তা শরিফুল আলমের দাবি, তিনি যোগ দেওয়ার পর পর পানেরছড়া রেঞ্জে বনভূমিতে নতুন কোনো ঘর ওঠেনি। অঞ্জারঘোনা এলাকায় যে ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দেওয়া হয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে এমন পরিস্থিতি চলতে থাকায় কক্সবাজারে দিন দিন বনভূমি কমছে। ‘রোহিঙ্গা রিফিউজি ক্যাম্প অ্যান্ড ফরেস্ট লস ইন কক্সবাজার, বাংলাদেশ’ শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত তিন দশকে কক্সবাজারে বনভূমি উজাড়ের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা বসতি গড়ার পর এর পরিসর আরও বেড়েছে। কক্সবাজারের মোট বনভূমি ছিল ৫২ হাজার ৬২৯ হেক্টর। স্যাটেলাইট ইমেজ ও রিমোট সেনসিং ডাটা ব্যবহার করে দেখা গেছে, ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তিন বছরে ১২ হাজার ৮০৭ হেক্টর বনভূমি উজাড় হয়েছে। এর মধ্যে রোহিঙ্গাদের কারণে বনভূমি উজাড় হয়েছে ১ হাজার ৩৩৭ হেক্টর। অর্থাৎ, বাকি ১১ হাজার ৪৭০ হেক্টর বনভূমিই উজাড় হয়েছে স্থানীয়দের মাধ্যমে।
২০১৭ সালে ৭ লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য যে ক্যাম্প করা হয় তার এক থেকে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে বনভূমি উজাড়ের চিত্র উল্লেখ করে গবেষণাটিতে বলা হয়, শরণার্থী শিবিরের এক থেকে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে ২ হাজার ৬০০ হেক্টর বনভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর বাইরে আরও ৭ হাজার ৭০০ হেক্টর বনভূমি উজাড় হয়। কিন্তু এটি রোহিঙ্গাদের জন্য হয়নি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাইরে স্থানীয়রা বসতি গড়তে শুরু করায় তাদের হাতেই এক-তৃতীয়াংশ বনভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বনভূমি অবৈধ বসতি নির্মাণের বিষয়ে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা নুরুল ইসলাম বলেন, বনভূমি দখলের বিষয়ে আমরা জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছি। বনভূমি দখল করে কেউ স্থাপনা নির্মাণ করলে তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সমকাল
পাঠকের মতামত