প্রকাশিত: ২৯/১০/২০১৭ ৮:৫৩ পিএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ১১:৪৩ এএম

হাসান নাসির/এইচএম এরশাদ ::

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার সরকারের নানা ছলচাতুরি থাকলেও রাখাইন রাজ্যে এখন নির্যাতন নেই। কিন্তু এপারের নিরাপদ জীবনের হাতছানি ঠিকই তাদের ডেকে নিয়ে আসছে। এখন তারা আসছে ছোট ছোট দলে সপরিবারে। উখিয়া এবং টেকনাফের বিভিন্ন পয়েন্টে তাদের জড়ো হয়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে নৌকার অপেক্ষায়। এখন যারা আসছে তাদের মধ্যে রয়েছে অনেক সচ্ছল পরিবারও। এদের অনেকেই তাদের সহায়-সম্পদ বিক্রি করে যৎসামান্য অর্থকড়ি নিয়ে বাংলাদেশে আসছে সুখী জীবনের প্রত্যাশায়। এপারে এসে নানা নির্যাতনের অভিযোগ আনলেও সে অভিযোগগুলো আগের মতো বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। শুধুমাত্র খাদ্যাভাবের কথাই প্রধানত তারা বলছে। স্থানীয়রা বলছেন, এ অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কেননা, তারা তো শ্রমজীবী মানুষ হিসেবেই সেখানে বসবাস করছিল। মূলত এখানে রোহিঙ্গারা আসছে পরিশ্রম না করে ত্রাণনির্ভর জীবনযাপনের আশায়।

উখিয়া এবং টেকনাফের জনসাধারণের মাঝে এখন রোহিঙ্গা নিয়ে আবেগ কিংবা সহানুভূতির ছিটেফোঁটাও আর নেই। অথচ এরা প্রথমদিকে বাড়তি জনসংখ্যার চাপ সহ্য করেও তাদের প্রতি মানবিক আচরণ প্রদর্শন করেছিলেন। তাদের বক্তব্য হলো, সারাদেশ আবেগে থাকলেও বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দাদের চাপ এবং কষ্টের বিষয়টি এখন বিবেচনায় নেয়া উচিত। সীমান্তে এখন আর শৈথিল্য থাকা উচিত নয় বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বিতাড়িত এ জীবিকাহীন রোহিঙ্গারা ক্রমেই অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। রাখাইন রাজ্য থেকে আসা তরুণীরাও অসামাজিক পথে পা বাড়াচ্ছে। সেখানে অনেক দালালের আনাগোনাও বাড়ছে। পর্যটন শহর কক্সবাজার পর্যন্ত চলে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। বিশেষ করে নারীদের অসামাজিক কার্যকলাপে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সুনাম নষ্ট হওয়ার উপক্রম। থাকতে থাকতে এরা বাংলাদেশের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছে। ফলে মিয়ানমার সরকার কোন পর্যায়ে তাদের ফেরত নিতে সম্মত হলেও তারা ফিরতে রাজি হবে কি-না তা নিয়ে সংশয় জোরালো হচ্ছে।

নিরাপত্তা ঝুঁকিতে উৎকণ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

রাখাইন থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের দেখভাল এবং সামগ্রিক শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বটিই পালন করে আসছিল পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মানবিক আচরণ প্রদর্শনের মাধ্যমে অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে এ কাজটি চলছিল। কিন্তু এখনকার দায়িত্ব শুধুমাত্র আর শৃঙ্খলা রক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করেছিল আরও আগেই। কিন্তু এখন তা আর ক্যাম্পে সীমিত নয়। তারা বাইরে স্থানীয় স্থায়ী বাসিন্দাদের ওপরও নানা অজুহাতে চড়াও হচ্ছে। যে পুলিশ শৃঙ্খলার কাজে দায়িত্ব পালন করছে, সে পুলিশের ওপর আক্রমণ হয়েছে। দোকান বসাতে না দেয়ায় এক রোহিঙ্গা দম্পতির হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন পুলিশের এক এসআই। রোহিঙ্গারা এখন নিরীহ ভাব কাটিয়ে আসল চেহারায় প্রকাশিত হচ্ছে। এতে স্থানীয়দের মাঝে অসন্তোষ এবং ভীতির পাশাপাশি নিরাপত্তা ঝুঁকিও দিন দিন বাড়ছে।

জন্ম নিয়ন্ত্রণে স্থায়ী পদ্ধতি প্রয়োগের চিন্তাভাবনা

বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে অন্তত ৬০ ভাগই শিশু। এমন পরিবারও রয়েছে যে পরিবারে সন্তানের সংখ্যা ১৯টি পর্যন্ত পাওয়া গেছে। তাছাড়া বাংলাদেশে আসা নারীদের মধ্যে অন্তত ২০ হাজার নারী সন্তানসম্ভবা। সীমান্ত অতিক্রমের পর সন্তান প্রসব করেছেন প্রায় ৭শ’ নারী। রোহিঙ্গাদের এ উচ্চ জন্মহার ভাবিয়ে তুলেছে সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে। কেননা, জন্মহার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ এখন বেশ সফল। সে জায়গায় উটকো একটি জনগোষ্ঠীর অধিক সন্তানগ্রহণের প্রবণতা নতুন সঙ্কট সৃষ্টি করতে পারে। ফরাসী বার্তা সংস্থা এএফপি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বরত পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা পিন্টু কান্তি ভট্টাচার্যের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, জন্মহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পুরুষের বন্ধ্যাকরণ এবং নারীদের নির্বীজন পদ্ধতির কথা ভাবা হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারের অনুমোদন চাওয়া হয়েছে। তিনি জানান, রোহিঙ্গাদের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা তথা উচ্চ জন্মহার রোধের কোন মানসিকতা নেই। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে কর্মসূচি চালালেও তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এ পর্যন্ত তারা মাত্র ৫৪৯টি কনডম বিতরণ করতে সক্ষম হয়েছেন। যাদের এর মধ্যেই অধিক সন্তান হয়ে গেছে তাদের জন্য জন্ম নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী পদ্ধতি প্রয়োগ করা প্রয়োজন বলে অভিমত ব্যক্ত করেন এ কর্মকর্তা।

নাফ নদীতে মাছ শিকার বন্ধ থাকায় মানবেতর জীবন জেলেদের

রোহিঙ্গা ঢলের কারণে টেকনাফের নাফ নদীতে মাছ শিকার বন্ধ থাকায় অর্ধাহারে-অনাহারে জীবন কাটাচ্ছে জেলে পরিবারগুলো। মিয়ানমারের রাখাইন থেকে রোহিঙ্গারা দলে দলে এ দেশে পালিয়ে আসার প্রেক্ষিতে প্রশাসন গত দুই মাস ধরে অঘোষিতভাবে বন্ধ রাখে মাছ শিকার। এরপর ১ থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত সরকারীভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। ২৩ অক্টোবর থেকে দেশের বিভিন্ন নদ-নদী ও সাগরে মাছ শিকার শুরু হলেও টেকনাফের নাফ নদীতে মাছ শিকার বন্ধ রাখা হয়েছে। টানা মাছ শিকার বন্ধ থাকায় স্থানীয় জেলে পরিবারগুলোতে নেমে আসে দুর্দশা। তাদের জীবন কাটছে অর্ধাহারে-অনাহারে। বিকল্প কোন আয়ের উৎস না থাকায় জেলে পরিবারগুলোতে এখন হাহাকার। অনেকেই দু’বেলা খাদ্য যোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন। নাফ নদীর পার্শ¦বর্তী বাজারগুলোতেও মাছের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। হ্নীলার আক্কাছ উদ্দিন, নাটমুরা পাড়ারের ধর্মেন্দ্র, জেলেপাড়ার মিলন বড়ুয়া, লেদা এলাকার জামাল উদ্দিন, নয়াপাড়ার ইসমাইল ও জাদীমুরার নুরুল আমিন জানান, পেশায় আমরা মৎস্যজীবী। নদীতে মাছ শিকার ও বছরের পর বছর ধরে বিহিন্দি জাল পেতে জীবিকা নির্বাহ করে আসছি। কোন সময়ে এভাবে একটানা দীর্ঘদিন মাছ শিকার বন্ধ থাকেনি। রাখাইনে সহিংসতা শুরুর প্রভাব পড়েছে আমাদের ওপর। মাছ শিকার করতে না পারায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে মানবেতর জীবন কাটাতে হচ্ছে।

টেকনাফ-উখিয়ায় শিক্ষা কার্যক্রম বিঘিœত

টেকনাফ এবং উখিয়ায় ছয় লক্ষাধিক রোহিঙ্গার চাপে সেখানকার শিক্ষা ব্যবস্থাও ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম। রোহিঙ্গা অধ্যুষিত উখিয়া-টেকনাফের ১৪টি মাধ্যমিক ও ১৩টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অভিভাবকরা নিজেদের ছেলেমেয়েদের পরীক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। আগামী ১ নবেম্বর শুরু হচ্ছে জেএসসি পরীক্ষা। এরপরই শুরু হবে পিইসি পরীক্ষা। রোহিঙ্গা জনসংখ্যার বাড়তি চাপে পরিবহন সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। টেকনাফ এবং উখিয়ার প্রধান সড়কে এখন যানবাহন পাওয়াও কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়াও প্রায় দু’মাস ধরে অনেক শিক্ষা ্রতিষ্ঠান ব্যবহৃত হচ্ছে খাদ্যগুদাম হিসেবে। এছাড়া অনেক স্কুলকক্ষ ব্যবহার করতে হচ্ছে রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে নিয়োজিত প্রশাসন এবং বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসন হিসেবে। কক্সবাজার জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ছালেহ আহমদ চৌধুরী বিষয়টি স্বীকার করে জানান, রোহিঙ্গাদের কারণে উখিয়া ও টেকনাফের অন্তত ১৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে।

সামাজিক বনায়ন দখল করে রোহিঙ্গা বসতি

উখিয়া ও টেকনাফে রোহিঙ্গা বসতি গড়তে ধ্বংস হয়েছে দেড় হাজার একর জমির সামাজিক বনায়ন। এতে ক্ষতি হয়েছে প্রায় দেড় শ’ কোটি টাকার। স্থানীয় জনগণের সহায়তায় এসব বনায়ন করেছিল বন বিভাগ। মিয়ানমার থেকে আসা নতুন ও পুরাতন মিলে রোহিঙ্গার সংখ্যা এখন ১০ লাখের বেশি। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার আশ্রয়ের জন্য উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালীতে তিন হাজার একর জমি নির্ধারণ করে সরকার। কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা আলী কবির জানান, উখিয়া ও টেকনাফে নতুন নতুন বনাঞ্চল দখল করে নিচ্ছে রোহিঙ্গারা। সরকার নির্ধারিত জমিতে স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় রোহিঙ্গারা সামাজিক বনায়নের জমিতেও বসতি গড়ে তুলছে।

রোহিঙ্গা হামলায় গ্রামবাসী নিহত

স্টাফ রিপোর্টার জানান, কক্সবাজারে পৃথক ঘটনায় রোহিঙ্গাদের হামলায় এক গ্রামবাসী নিহত ও স্থানীয় চার ব্যক্তি আহত হয়েছে। শুক্রবার রাত ১২টায় উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পুরাতন খেলার মাঠে ও রাত ১১টায় রামু খুনিয়াপালং এলাকায় পৃথক এ ঘটনা ঘটে। স্থানীয়রা রোহিঙ্গা খুনি জিয়াবুলকে আটক করে পুলিশে দিয়েছে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নলকূপ স্থাপন করা নিয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে গ্রামবাসীদের বিরোধ সৃষ্টি হয়। শুক্রবার রাতে রোহিঙ্গারা ডাকাত পড়েছে বলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাইকে প্রচার করে সংঘবদ্ধভাবে স্থানীয়দের উপর হামলা চালায়। খবর পেয়ে উখিয়া থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ৪ জন স্থানীয় ব্যক্তিকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে। আহতদের শরীরের দা’র কোপের চিহ্ন রয়েছে। তাদের হাসপাতাল ভর্তি করা হয়েছে।

এদিকে রামু খুনিয়াপালংয়ে রোহিঙ্গা যুবকের দায়ের কোপে আব্দুল জব্বার নামে স্থানীয় এক যুবক নিহত হয়েছে। শুক্রবার রাতে খুনিয়াপালং এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত আব্দুল জব্বার ওই এলাকার বশীর ফকিরের পুত্র। খুনিয়াপালং ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মাবুদ জানান, হেডম্যান পাড়ার শামসুল আলমের স্ত্রী রোহিঙ্গা দিলারা বেগমের দুঃসম্পর্কের ভাইয়ের পুত্র জিয়াবুল হক। আর দিলারার সঙ্গে নিহত আব্দুল জব্বারের পরকীয়া ছিল। মঙ্গলবার রাতে আব্দুল জব্বারের সঙ্গে গোপনে কথা বলছিল দিলারা। সেটা দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে জিয়াবুল ধারালো দা দিয়ে কুপিয়ে আহত করে আব্দুল জব্বারকে। উদ্ধার করে কক্সবাজার সদর হাসপাতাল ও পরে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে জব্বার মারা যায়। পালিয়ে যাওয়ার সময় রোহিঙ্গা যুবক জিয়াবুলকে আটক করে রামু থানায় সোপর্দ করেছে স্থানীয়রা।  সুত্র: জনকন্ঠ

পাঠকের মতামত

শেখ মুজিবকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করে পোস্ট, এসিল্যান্ড প্রত্যাহার

শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সিরাজুম মুনিরা ...

আলোচিত স্কুলছাত্রী টেকনাফের তাসফিয়া হত্যা: এবার তদন্ত করবে পুলিশ

চট্টগ্রামের আলোচিত স্কুলছাত্রী তাসফিয়া আমিন হত্যা মামলায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদনের ...