
তারা মনে করছেন, বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতিবাদেও যেহেতু মিয়ানমারের গণহত্যা দমন পীড়ন থামছে না, তাই সেখানে ফিরে যাওয়া কঠিন। এদিকে আরাকানের বিদ্রোহী সংগঠন ‘আরসা’ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সৃষ্টি বলে দাবি করছেন রোহিঙ্গারা।
তারা বলছেন, আরসা সৃষ্টি করা হয়েছে রোহিঙ্গাদের চিরতরে তাদের আবাসভূমি থেকে বিতাড়িত করার জন্য। মিয়ানমার সরকার যদিও একবার বলেছে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে, কিন্তু বাস্তব অবস্থা হচ্ছে বাস্তুচ্যুত এই জনগোষ্ঠিকে তারা আর সেদেশে ফিরতে দেবে না। রোহিঙ্গারা তাদের জমিজমা ভিটেবাড়ি, ব্যবসা বাণিজ্য সব ফেলে চলে আসতে বাধ্য হয়েছে। তাই ওসব আর তারা ফিরে পাবেন না বলেই ধরে নিচ্ছেন। এখনও চলছে গণহত্যা ও নিপীড়ন। প্রতিদিন পালিয়ে আসছেন হাজার হাজার রোহিঙ্গা। তবু রোহিঙ্গাদের মাঝে ক্ষীণ আশা যদি বাংলাদেশ কুটনৈতিকভাবে সফল হয় তারা হয়তো ফিরতে পারবেন।
আজ বৃহস্পতিবার উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানরত একাধিক শিক্ষিত রোহিঙ্গার সাথে কথা বলে তাদের এমন হতাশার কথা জানা যায়।
মাস্টার শফিউল্লাহ (৬৫) বুচিদংয়ের টংবাজার হাইস্কুলে অনেক দিন শিক্ষকতা করেছেন। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল শফিউল্লাহ স্ত্রী পুত্রসহ পরিবারের আট সদস্য নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন থাইংখালীর বাগঘোনা ক্যাম্পে।
ভবিষ্যত জীবনের অনিশ্চয়তার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমি নিশ্চিত আরসা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সৃষ্টি। আমি কোনোদিন আরসার নাম শুনিনি। আরসার কথিত হামলার আগে থেকেও রোহিঙ্গাদের দুর্বিষহ জীবন ছিল। সব অধিকার কেড়ে নেয়ার পরও রোহিঙ্গারা কোনোভাবে বসবাস করে আসছিল রাখাইনে। কিন্তু আরসার হামলার অযুহাতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের সমূলে উচ্ছেদ করছে। কাউকে থাকতে দিচ্ছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আমাদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া অনিশ্চিত। তবে কখনো রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হলে সেখানে জাতিসংঘ ও নিজেদের প্রতিনিধিত্ব চান তিনি।
রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে সম্প্রতি বাংলাদেশকে মিয়ানমারের দ্বিপক্ষীয় চুক্তির প্রস্তাব সম্পর্কে উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া মংডু টাউনের রোহিঙ্গা ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইউছুফ বলেন, মিয়ানমারকে বিশ্বাস করা যায় না। তাদের কথা এবং কাজের মধ্যে মিল নেই। ইউছুফ আকিয়াব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছেন এবং নিয়মিত রেডিওর খবর শুনেন। বাংলাদেশে এসেও তিনি মিয়ানমারের এফএম রেডিওর খবর শুনছেন। তিনি এসব খবরের উদ্বৃতি দিয়ে বলেন, দিনে দু’বার খবর প্রচার করছে মিয়ানমার এবং তাতে এখনও ঘোষণা দেয়া হচ্ছে ‘টোয়ে মিলং’ (পালিয়ে যাও, বাড়িতে আগুন দেয়া হবে)। তাদের যদি কোনো সদিচ্ছা অথবা মানবিকতার উদ্রেক হতো তারা এমন ঘোষণা এখনও দিত না। হত্যা ধর্ষণ এবং বাড়িঘরে আগুন দেয়ার ঘটনা বন্ধ করত মিয়ানমার সেনারা।
তিনি আরো বলেন, আসলে আরসার সেই কথিত হামলা ছিল পরিকল্পিত এবং এই হামলার কথা বলে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নই আসল উদ্দেশ্য।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা একেবারে নিরীহ এবং যুগের পর যুগ আরাকানে এক প্রকার বন্দী জীবনই কাটাচ্ছিল। তাদের চলাফেরা সীমিত। মিয়ানমার সেনাদের দাবি করা টাকা পয়সা (কিয়াত) দিয়ে তারা কোনো মতে বসবাস করছিল। ২৫ আগস্টের পর এই নিরিহ রোহিঙ্গাদের জীবনে হঠাৎ নেমে এলো ভয়াবহ দুর্যোগ।
তিনি বলেন, মিয়ানমার ফিরে যেতে চাই। কিন্তু নাগরিকত্ব ও সবধরণের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা ছাড়া ফিরে গেলে রোহিঙ্গাদের শান্তিতে থাকতে দেবে না উগ্রপন্থী বৌদ্ধ গোষ্ঠী ও দেশটির সেনাবাহিনী।
সম্প্রতি মিয়ানমারের এক মন্ত্রী বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়ার পর রোহিঙ্গাদের মাঝে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া নিয়েও আলোচনা চলছে। বাংলাদেশকে দেয়া দ্বিপক্ষীয় চুক্তির প্রস্তাবকে মিয়ানমারের ধোকাবাজি মনে করছেন রোহিঙ্গারা।
তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক চাপ কমানোর জন্য এটা মিয়ানমারের কৌশল। রোহিঙ্গাদের প্রশ্ন- তারা এই প্রেক্ষাপটে বৈধ কাগজ কোথায় পাবেন?
রোহিঙ্গারা যে মিয়ানমারেরই নাগরিক তা ঐতিহাসিকভাবেই সত্য। তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করার পরও মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে তাদের কাছে অনেক প্রমাণপত্র ছিল, কিন্তু সেনারা সেগুলোও কেড়ে নিয়েছে। ১৯৯২ সালের ঘোষণায় বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে নিবন্ধিত রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের বৈধ কাগজপত্রসহ ফিরতে পারবেন রাখাইনে। মিয়ানমার এখনও তাই বলছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, জাতিগত পরিচয় হারানোর কারণে বেশির ভাগ রোহিঙ্গা ‘বাঙালি’ লেখা কার্ড নেননি। সেনা অভিযানের সময় বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়ায় অনেক রোহিঙ্গার নানা কাগজপত্র যেমন বিয়ের কাবিননামা, জমির ট্যাক্স/রশিদ ইত্যাদি আনতে পারেননি। ফলে বৈধ কাগজ তারা পাবেন কোথায়? দীর্ঘদিন ধরেই রোহিঙ্গারা আরাকানে বসবাস করছেন নাগরিকত্বসহ সবধরনের মৌলিক অধিকারহীন হয়ে। এমন পরিস্থিতিতে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো হলে তাদের নির্বিচার হত্যা করবে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা।
মংডুর ডোয়েলতলী ইউনিয়নের সাবেক উক্কাডা (চেয়ারম্যান) হাসান বসরি এখন থাইংখালী হাকিমপাড়া ক্যাম্পের বাসিন্দা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের উদ্যোগে রোহিঙ্গাদের নিবন্ধনে ‘রোহিঙ্গা’ না লেখায় তারা খুশি নন। একারণে নিবন্ধনের প্রতি অনেকের অনীহা।
তিনি বলেন, ‘আমাদের জাতিগত পরিচয় ‘বাঙালি’ লেখায় আমরা মিয়ানমারের কার্ড নিইনি। কিন্তু বাংলাদেশের নিবন্ধনে লেখা হচ্ছে ‘মিয়ানমার’।
নিবন্ধন কার্ডে তিনি তাদের পরিচয় ‘রোহিঙ্গা-মিয়ানমার’ লেখার অনুরোধ করে বলেন, এটি লেখা হলে কয়েক দিনেই সব রোহিঙ্গা নিবন্ধিত হয়ে যাবে।
তিনি আরো বলেন, আমরা মিয়ানমারে জন্মেছি, সেখানেই আমাদের সবকিছু। নিরাপদে অবস্থানের সুযোগ পেলে জন্মভূমিতেই ফিরে যেতে চাই। বর্তমানে বিশ্বের চাপে মিয়ানমার একটু নরম সুরে কথা বললেও তারা ঠিকই নির্যাতন নিপীড়ন অব্যাহত রেখেছে।
তিনি বলেন, মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক কোনো পক্ষকে যুক্ত করতে চাইবে না।
তিনি বলেন, ১৯৮৭ পর্যন্ত আমাদের পরিচয়পত্রে জাতি হিসেবে পরিষ্কার লেখা ছিল ‘রোহিঙ্গা’। ১৯৮৯ সালে আমাদের নতুন ফরম পূরণ করিয়ে জাতি হিসেবে ‘মুসলিম’ লেখা হলেও ১৯৯৫ সাল থেকে লেখা শুরু হয় ‘বাঙালি’। থেইন সেইনের আমলে সব কার্ড কেড়ে নেয়া হয়। তারপর এনভিসির (ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড) কথা বলে যে ফরম পূরণ করা হয় সেগুলো বার্মিজ ভাষায় লেখা থাকলেও পূরণ করতে বলা হয় বাংলায়। আমরা সেটা অস্বীকার করায় নতুন কোনো কার্ড পাইনি। ২০১৫ সালে ফের এনভিসির কথা বলে কিছু রোহিঙ্গাকে জোর করে বাঙালি লেখা কার্ড ধরিয়ে দেয়া হয়। এ কার্ড নিতে অস্বীকার করায় তারা আমাদের নির্মূলের চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেয়। এখন সেটা বাস্তবায়ন করছে মিয়ানমার।
তিনি রোহিঙ্গাদের নির্মূল অভিযান বন্ধ ও মিয়ানমারে নাগরিকত্বসহ ফেরত যেতে জাতিসংঘসহ বিশ্বের কাছে অবেদন জানান।
রাখাইন ভাষায় পূরণ করা নিজের বিয়ের রেজিস্ট্রেশন কার্ড (কাবিননামা) দেখিয়ে মোহাম্মদ সোহাইল বলেন, মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাগজ মিয়ানমার সেনারা কেড়ে নিয়েছে। এখন আমাদের কাছে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব কার্ড চাইলে কেউ তা দিতে পারবেন না।
সোহাইল বলেন, আমার বাবা মিয়ানমারে সরকারি চাকরি করেছেন বহু বছর। আমাদের অনেক জমি-জমা বাড়িঘর ছিল, কিন্তু এখন কিছুই নেই। সব হারিয়ে আমরা এখন পথের ভিক্ষুক। আমরা দেশে ফিরতে চাই।
পাঠকের মতামত