প্রকাশিত: ২৬/১২/২০১৭ ৮:০৮ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ৮:৫৯ এএম

নিউজ ডেস্ক::
২০১৭ সাল শুরু হয়েছিল আগের বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ঢল সামলানো এবং তাদেরসহ সব রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর চ্যালেঞ্জ নিয়ে। সেই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো তো দূরের কথা, উল্টো নতুন করে যোগ হয়েছে আরো প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা।

গত ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে শুরু হওয়া নতুন করে নিধনযজ্ঞের কারণে বাংলাদেশে গত চার মাসে আশ্রয় নিয়েছে ছয় লাখ ৫৫ হাজার রোহিঙ্গা। আগস্টে শুরু হওয়া সেই ঢল গতকাল সোমবার পাঁচ মাসে গড়ালেও এখনো তা অব্যাহত আছে।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এ সংকটকে সাম্প্রতিককালের দ্রুততম ও ক্রমবর্ধমান মানবিক সংকট হিসেবে অভিহিত করেছে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বড় অংশই বাংলাদেশে চলে এসেছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা এরই মধ্যে ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়। তাদের টেকসই প্রত্যাবাসনই এখন বাংলাদেশের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক কালের কণ্ঠকে বলেন, আগামী ২২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরুর লক্ষ্য ঠিক করা হলেও রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার বিষয়টি হতে হবে স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও সম্মানজনক। বর্তমান বাস্তবতায় রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা ও জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা ছাড়া ফিরে যেতে কতটা আগ্রহী হবে, তা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। অন্যদিকে মিয়ানমারও রোহিঙ্গাদের ফেরাতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে মোটেও আন্তরিক নয়।

রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার জন্য যে প্রক্রিয়ায় তাদের যাচাই-বাছাই করা হবে, তাও বেশ কঠিন। এর পরও বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে চাচ্ছে।
সংখ্যার হিসাবেও গরমিল : ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপের (আইএসসিজে) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা এখন আট লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ জন। এর মধ্যে গত ২৫ আগস্টের আগে বিভিন্ন সময় আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা দুই লাখ ১২ হাজার ৫০০ জন। তবে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য অনুযায়ী, আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা বেশ আগেই ১০ লাখ ছাড়িয়েছে।

গত ১৩ অক্টোবর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আরিয়া ফর্মুলা মিটিংয়ে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন জানিয়েছিলেন, চলতি বছর ২৫ আগস্ট থেকে ১৩ অক্টোবর সকাল পর্যন্ত পাঁচ লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। তাঁর ভাষ্যমতে, সব মিলিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ৯ লাখে দাঁড়িয়েছে। এরপর গত দেড় মাসে আইএসসিজের হিসাবে আরো প্রায় লাখখানেক রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার তথ্য পাওয়া যায়।

আরিয়া ফর্মুলা মিটিংয়ের ১০ দিন পর গত ২৩ অক্টোবর রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল সংগ্রহের সম্মেলনে জেনেভায় জাতিসংঘ দপ্তরগুলোতে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত শামীম আহসান এ দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ বলে উল্লেখ করেন। তহবিল সংগ্রহের সম্মেলনে আরো প্রায় দেড় মাস পর গত ৫ ডিসেম্বর জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে রোহিঙ্গা ইস্যুতে অনুষ্ঠিত বিশেষ অধিবেশনে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলমও রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা মিয়ানমারের প্রায় ১০ লাখ লোকের বোঝা বহন করছি। তাদের মধ্যে ২৭ হাজার সঙ্গীহীন শিশুসহ ছয় লাখ ২০ হাজারেরও বেশি এসেছে গত তিন মাসে। গত বছর এসেছে ৮৭ হাজার এবং গত আড়াই দশকে প্রায় তিন লাখ। ’

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, রোহিঙ্গার হিসাবে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সংখ্যার সঙ্গে বাংলাদেশের হিসাবের গরমিল রয়েছে। এর মূল কারণ ২৫ আগস্টের আগে থেকে এ দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১-৯২ সালে মিয়ানমার থেকে দুই লাখ ৫০ হাজার ৮৭৭ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছিল। তখন তাদের ‘শরণার্থী’ মর্যাদা বা স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ২০০৫ সাল পর্যন্ত দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জন রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে গেলে এ দেশে অবশিষ্ট রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৩ হাজার ৫৪২ জনে।

সরকারি সূত্রগুলো বলছে, এর বাইরে বিভিন্ন সময় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে প্রতিকূল পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। এ সংখ্যা নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো ধারণা না থাকায় সরকার প্রথমবারের মতো গত বছরের ১ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরের আশপাশে জরিপ চালায়। সেই জরিপের প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা ছিল প্রায় তিন লাখ।

সরকারি সূত্রগুলোর তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ৯ অক্টোবর মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর নির্বিচার হামলা ও নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। এরপর গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর নিপীড়নের কারণে নতুন করে রোহিঙ্গার ঢল নামে বাংলাদেশে, যা এখনো অব্যাহত আছে।

বিশাল চাপে বাংলাদেশ : মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের সামাল দিতে বড় ধরনের চাপে পড়েছে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে কক্সবাজার এলাকায় রোহিঙ্গাদের সংখ্যা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেছে। বিরূপ প্রভাব পড়েছে পর্যটন শহর কক্সবাজারে। সংরক্ষিত বনাঞ্চল বিনষ্ট হচ্ছে ও পরিবেশ বিপর্যয় হচ্ছে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি গত অক্টোবর মাসে রোহিঙ্গাদের কারণে ১৫০ কোটি ৮৭ লাখ টাকার বনজ সম্পদ ধ্বংস হওয়ার কথা জানিয়েছিল। দীর্ঘ মেয়াদে রোহিঙ্গাদের অবস্থানের কারণে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে আবারও ডিপথেরিয়া রোগ ফিরে এসেছে। রোহিঙ্গাদের কারণে প্রশাসনিক ব্যয়, পর্যটন খাত আরো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও উগ্রবাদের ঝুঁকিও বাড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ব্যাহত হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। এর পরও বাংলাদেশ মানবিক দিক বিবেচনায় নিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগ নিয়েছে। আবার মিয়ানমারকে এই সংকট সমাধানে বাধ্য করতে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে।

গণহত্যা ঠেকাতে বৈশ্বিক ব্যর্থতা : জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার যায়িদ রা’দ আল হুসেইন রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার বাহিনীর বর্বরতাকে ‘গণহত্যা’ বলে আশঙ্কা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরতাকে ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞ’ হিসেবে অভিহিত করেছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ ও সাধারণ পরিষদে প্রস্তাব এবং নিরাপত্তা পরিষদের বিবৃতি সত্ত্ব্বেও রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধ করা যায়নি। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বর্বর নিপীড়ন চালিয়ে তাদের বাস্তুচ্যুত করে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে। ঠিক কতসংখ্যক রোহিঙ্গা মিয়ানমারে নিহত হয়েছে তাও জানা যাচ্ছে না। মিয়ানমার এখনো বিদেশিদের রাখাইন রাজ্যে যেতে দিচ্ছে না। চীন এখনো মিয়ানমারের পক্ষে থাকায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দেশটির বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারছে না।

সংকট দীর্ঘতর হওয়ার আশঙ্কা : বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা বোঝা বহন করছে। মিয়ানমারের জনগণের বৃহত্তর অংশই এখন রোহিঙ্গাদের প্রতি বিরূপ মনোভাব সম্পন্ন হওয়ায় এ সংকটের টেকসই সমাধান নিয়ে শঙ্কা আছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য যে তহবিল জোগান দিয়েছে, তাও শেষ হবে আগামী বছরের শুরুর দিকেই। এরপর তাদের চাহিদা পূরণের জন্য নতুন করে তহবিল সংগ্রহ করতে হবে। রোহিঙ্গা সংকটের ক্ষেত্রেও বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর ভূরাজনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে। তাদের স্বার্থের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশেও। কূটনৈতিকভাবে এ সংকটের টেকসই সমাধান আনতে না পারলে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের বোঝা বাংলাদেশকেই টানতে হতে পারে।সুত্র: কালেরকন্ঠ

পাঠকের মতামত

টেকনাফে চিকুনগুনিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব; আতংকিত না হওয়ার পরামর্শ স্বাস্থ্য বিভাগের

জসিম উদ্দিন টিপু,টেকনাফ:: টেকনাফজুড়ে ঘরে ঘরে চিকনগুনিয়া রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। প্রায় বাড়ী-ঘরে শিশু থেকে ...

নিম্নচাপের প্রভাব: কক্সবাজার সৈকতে ভাঙন, লোকালয়ে জোয়ারের পানি

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে জোয়ারের পানি ঢুকে কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, মহেশখালী ও সেন্টমার্টিন দ্বীপের কিছু এলাকা ...

সেন্টমার্টিনে খাদ্য সংকট, লোকালয়ে ঢুকছে জোয়ারের পানি

তিনদিন ধরে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুটে সবধরণের নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে সেন্টমার্টিন দ্বীপে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের তীব্র ...