এম ফেরদৌস, বিশেষ প্রতিবেদক, উখিয়া নিউজ ডটকম
প্রকাশিত: ১৬/১১/২০২৫ ৭:১৬ এএম

উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন মোড়, বাজার এবং রাস্তায় স্থাপন করা হয়েছে অসংখ্য চেকপোস্ট। কিন্তু তবুও রোহিঙ্গারা এসব চেকপোস্ট অতিক্রম করে নির্বিঘ্নে প্রবেশ করছে লোকালয়ে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) এর উপস্থিতি থাকলেও কার্যত তাদের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে স্থানীয়দের মনে।

প্রতিদিনই বাজারে, পরিবহনে কিংবা বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যে রোহিঙ্গাদের সক্রিয় উপস্থিতি দেখা যায়। অনেকে আবার লোকালয়ে বাসা ভাড়া নিয়ে জড়িয়ে পড়ছে নানা অপকর্মে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঝেমধ্যেই তাদের আটক করলেও পরিস্থিতির তেমন পরিবর্তন হচ্ছে না। এতসব অপরাধ-অপকর্মের পরও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এগোচ্ছে না, বরং দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়িত হচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট। এতে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন সামাজিক ও নিরাপত্তা জনিত সমস্যা এমনটাই দাবি করছেন স্থানীয় সচেতন মহল

স্থানীয়দের অভিযোগ, চেকপোস্টে দায়িত্বে থাকা কিছু পুলিশ সদস্যের উদাসীনতা ও অবহেলার কারণেই রোহিঙ্গারা এভাবে বের হয়ে পড়ছে। ফলে নানা অপরাধ, চুরি, ছিনতাই ও মাদক ব্যবসার ঘটনাও বেড়ে চলেছে। এ অবস্থায় চেকপোস্টের কার্যকারিতা ও এপিবিএনের তৎপরতা নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

গত ১২-১৩ নভেম্বর দুইদিন সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের সামনে দিয়েই রোহিঙ্গারা অবাধে যাতায়াত করছে। এসময় তাদের থামানো বা তল্লাশি করার কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। এতে যেমন নিরাপত্তা ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি বেড়েছে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড।

রোহিঙ্গারা শুধু ক্যাম্পে সীমাবদ্ধ নেই, বিভিন্ন ধরণের ব্যবসা-বাণিজ্যেও সক্রিয় হয়ে উঠেছে তারা। যদিও তাদের বসবাস আশ্রয়শিবিরে, তবে ব্যবসার পরিসর বিস্তৃত হয়েছে লোকালয় পর্যন্ত। অনেক রোহিঙ্গা কৌশলে স্থানীয়ভাবে ট্রেড লাইসেন্স পর্যন্ত সংগ্রহ করেছে। শুধু তাই নয়, কেউ কেউ সড়কে গাড়িও চালাচ্ছে, যার বেশিরভাগেরই নেই বৈধ লাইসেন্স বা ফিটনেস। কুতুপালং ও বালুখালী এলাকায় এ ধরনের চিত্র চোখে পড়েছে।

অনুসন্ধান ও সূত্র বলছে, রোহিঙ্গাদের অপরাধ প্রবণতা এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। মাদক ব্যবসা, অপহরণ, খুন, অস্ত্র ও মানবপাচার, সবখানেই রয়েছে রোহিঙ্গা সিন্ডিকেটের সক্রিয় উপস্থিতি। প্রায় প্রতিদিনই উখিয়া ও টেকনাফে এ ধরনের অপরাধের খবর পাওয়া যাচ্ছে, তবুও কার্যকর ব্যবস্থা চোখে পড়ছে না সংশ্লিষ্টদের।

স্থানীয় একাধিক জনপ্রতিনিধি বলছেন, চেকপোস্ট বসানো হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটা কাগজে কলমে। বাস্তবে সেখানে দায়িত্বে থাকা সদস্যদের তৎপরতা খুবই কম। রোহিঙ্গারা দল বেঁধে লোকালয়ে যাচ্ছে, ব্যবসা করছে, এমনকি অপরাধ সংঘটিত করেও নির্বিঘ্নে ফিরে যাচ্ছে ক্যাম্পে।

উখিয়া রাজাপালং ইউনিয়নের ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘রোহিঙ্গারা এখন অবাধে চলাফেরা করছে, যেন এ দেশই তাদের নিজস্ব জায়গা। তারা যে শরণার্থী, তা বোঝা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। চেকপোস্টগুলোতে তাদের চলাচলে কঠোর বাধা দিলে এই পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ১৪ এপিবিএন পুলিশের এক কর্মকর্তা এসব ঘটনা স্বীকার করেন এবং বলেন, ‘রোহিঙ্গা জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় এবং এলাকায় প্রবেশপথ অসংখ্য থাকায় শতভাগ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না।’

১৪ এপিবিএন-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জানে আলম বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের তল্লাশি ও তাদের চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আনতেই চেকপোস্ট স্থাপন করা হয়েছে। তবে নানা অজুহাতে তারা অনেক সময় চেকপোস্ট পার হয়ে বেরিয়ে যায়। এ বিষয়ে কার্যকর ও বড় ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ এখন অত্যন্ত জরুরি।’

৮-এপিবিএন পুলিশের অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ বলেন, ‘চেকপোস্টে রোহিঙ্গাদের চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দেওয়া আছে। তবে অনেক সময় কিছু পুলিশ সদস্যের গাফিলতির কারণে সমস্যা দেখা দেয়। এ ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি—অনেকজনকেই ইতোমধ্যে ক্লোজ করা হয়েছে। আমরা চাই চেকপোস্টসহ সর্বত্র রোহিঙ্গা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ আরও কার্যকর ভূমিকা রাখুক। এজন্য সবার সহযোগিতা কামনা করছি।’

এদিকে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, ‘চেকপোস্ট কার্যকর না হলে বা দায়িত্বে অবহেলা থাকলে রোহিঙ্গা অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।’

তারা মনে করেন, প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি, গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় জোরদার করা এখন সময়ের দাবি।

পাঠকের মতামত