ডেস্ক নিউজ
প্রকাশিত: ১৬/০৫/২০২৫ ৭:৩৭ এএম

চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রেলপথে বন্যপ্রাণী রক্ষায় গড়ে তোলা হয়েছিল এশিয়ায় সর্বপ্রথম ‘এলিফ্যান্ট ওভারপাস’। উদ্দেশ্য ছিল– বন্যহাতির জীবন বাঁচানো, রেল দুর্ঘটনা কমানো। তবে বাস্তবে দৃশ্যপট ভিন্ন। শুরুর কিছু সময় হাতিদের দেখা মিললেও, এখন ওভারপাস ফাঁকা পড়ে আছে। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে হাতিরা। প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল বন্যপ্রাণীদের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করা, কিন্তু বাস্তবে তা ব্যর্থ হয়েছে। প্রকল্প তখনই সার্থক, যখন প্রাণীও বুঝতে পারে– এটি তাদের জন্যই বানানো হয়েছে।

জানা যায়, লোহাগাড়া উপজেলায় চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের মাঝ দিয়ে গেছে রেললাইন। রেললাইনের প্রায় ১০ কিলোমিটার অংশ অভয়ারণ্যের মধ্যে পড়েছে। ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) চিহ্নিত করেছিল এই অঞ্চলে ১৬টি হাতির করিডোর রয়েছে। তবে প্রকল্পে শুধুমাত্র একটি ওভারপাস ও ২টি আন্ডারপাস নির্মাণ করা হয়েছে। যা হাতিদের নিরাপদ চলাচলের জন্য অপর্যাপ্ত। ‘এলিফ্যান্ট ওভারপাস’ নির্মাণের জায়গা নির্ধারণের জন্য এশিয়ার উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)’র বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ দল প্রায় দুই বছর কাজ করেছে। ভারত–বাংলাদেশ–মিয়ানমারের মধ্যে যাতায়াত করা এশিয়ান প্রজাতির হাতি সবচেয়ে বেশি চলাচল করে চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এলাকা দিয়ে। ওভারপাস দিয়ে হাতিরা এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাতায়াত করতে পারবে। কিন্তু দীর্ঘদিন যাবত বন্যহাতি এলিফ্যান্ট ওভারপাসের বিচরণ এবং ওই করিডোর দিয়ে যাতায়াত করছে না। তবে ২ আন্ডারপাস ও পানি চলাচলের ব্রিজ করিডোর হিসেবে ব্যবহার করছে বন্যহাতি।

এছাড়া বন্যহাতি লবণ পানি পান করতে পছন্দ করে। অভয়ারণ্য এলাকায় বন্যপ্রাণীরা যাতে রেললাইনে আসতে না পারে তার জন্য লবণ পানির লেক করার কথা ছিল। কিন্তু এখনো করা হয়নি। ২০২৩ সালের ৩ নভেম্বর লোহাগাড়া উপজেলায় চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে নির্মিত এলিফ্যান্ট ওভারপাসের উপর প্রথমবার বন্যহাতির বিচরণের ফলে হাতির পায়ের চাপ, মলত্যাগ ও রোপিত কলাগাছ খাওয়ার দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। বর্তমানে ওভারপাস আছে, কিন্তু সেটা বন্যহাতির ব্যবহার উপযোগী নয়। এটা যেমন অবহেলার বিষয়, তেমনি প্রশ্নবিদ্ধ প্রকল্প পরিকল্পনার বিষয়ও।

অপরদিকে, ২০২৪ সালের ১৩ অক্টোবর রাতে চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য রেঞ্জ কার্যালয় এলাকায় ঢাকাগামী কক্সবাজার স্পেশাল ট্রেনের ধাক্কায় প্রায় ১০ বছর বয়সী একটি ফিমেইল হাতি শাবক গুরুতর আহত হয়েছিল। ওই এলাকায় রেলাইনের উভয় পাশে দেয়া সাইড ওয়ালের পকেট গেট অরক্ষিত ছিল। যার ফলে বন্যহাতির দল রেললাইনের উপর চলে এসেছিল। ১৫ অক্টোবর রেলওয়ের একটি রিলিফ ট্রেন ঘটনাস্থলে এসে আহত শাবকটি উদ্ধার করে ডুলাহাজারা সাফারি পার্কের বন্যপ্রাণী হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে একইদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই শাবকের মৃত্যু হয়েছিল। বর্তমানে পকেট গেট সুরক্ষিত হলেও পুরো অভয়ারণ্য এলাকায় রেললাইনের দুই পাশে এখনো সাইড ওয়াল দেয়া হয়নি। অভয়ারণ্যের ভেতর অরক্ষিত রেললাইনে বন্যহাতির আনাগোনা রয়েছে। ফলে যেকোনো সময় দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে হাতিসহ অন্য বন্যপ্রাণী।

কয়েকদিন পর পর গত প্রায় দেড় মাস যাবত সরেজমিনে দেখা গেছে, ৫০ মিটার দীর্ঘ এলিফ্যান্ট ওভারপাসে বন্যহাতির পদচারণার কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ওভারপাসের উপরে হাতির পছন্দের কলা ও বাঁশ গাছসহ প্রায় ৪১ প্রজাতির বিভিন্ন গাছ লাগানো হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সিংহভাগ প্রজাতির গাছের কোনো অস্তিত্বও নেই। ওভারপাসের উপরে প্রায় সময় গরুর বিচরণ দেখা গেছে। যে কয়েকটি গাছ ছিলো তাও গরুগুলো সাবাড় করেছে। পশ্চিম প্রান্তে ওভারপাসের সাথে পাহাড়ের দূরত্ব অনেক বেশি। ওই প্রান্তে দুই পাশ দিয়ে বন্যহাতি ওভারপাসে এসে বিচরণ করার কথা ছিল। কিন্তু এক পাশে বন্যহাতি ওভারপাসে আসার পথও ভাঙাচোরা। এছাড়া ওভারপাসে বন্যহাতির গতিবিধি ধারণ করার জন্য স্থাপিত সিসি ক্যামেরাও নিয়ে গেছে চোরেরা। ইট–পাথরের কংক্রিটের ওভারপাস– যা বলা হয় হাতির জন্য নিরাপদ করিডোর। অথচ এখন সেই ওভারপাস পড়ে থাকে নির্জন। হাতিরা আর আসে না।

পরিবেশবিদরা বলছেন, প্রাণীর আচরণ শুধু অবকাঠামো দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তারা চলে নিজস্ব অভ্যস্ততা, পারিবার্শ্বিকতা ও গন্ধের ভিত্তিতে। ওভারপাস যতই উন্নত হোক, যদি না সেখানে থাকে প্রকৃতির নিজস্ব ছোঁয়া–ছায়া, খাদ্যগাছ, নীরবতা– তবে হাতি ফিরবে না কখনো।

স্থানীয় পরিবেশ কর্মী সানজিদা রহমান জানান, প্রকল্পের পরিকল্পনায় হাতিদের প্রাকৃতিক আচরণ ও চলাচলের পথ বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এছাড়া রেলপথের পাশে পর্যাপ্ত সুরক্ষা দেওয়াল, শব্দ নিরোধক ব্যবস্থা এবং সতর্কতা সংকেতের অভাব রয়েছে। যা বন্যপ্রাণীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। দীর্ঘদিন যাবত এখন কেউ দেখতে পায় না ওভারপাসে বন্যহাতির বিচরণ। এখন তা আছে শুধু কাগজে–কলমে সফলতা, বাস্তবে নীরবতা। একটি প্রকল্প শুধু উদ্বোধন করলেই সফল হয় না। বন্যপ্রাণীর ব্যবহার নিশ্চিত করাই তার প্রকৃত সফলতা। ওভারপাস আছে, হাতি নেই। এটা প্রকৃতির জন্য ব্যর্থতা, আর মানুষের জন্য শিক্ষা। শব্দদূষণ, মানুষের উপস্থিতি, সবুজ কমে যাওয়া এসব মিলেই তারা ওভারপাসকে আর নিরাপদ মনে করছে না। উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে বন্যহাতি পুণরায় ওভারপাস এলাকায় বিচরণ এবং ওই করিডোর দিয়ে চলাচল করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা নুর জাহান জানান, চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে নির্মিত এলিফ্যান্ট ওভারপাস প্রকল্পটি বন্যপ্রাণীদের নিরাপদ চলাচলের উদ্দেশ্যে গ্রহণ করা হলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি। প্রকল্পের পরিকল্পনায় প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বন্যপ্রাণীদের আচরণ যথাযথভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। যার ফলে হাতিরা ওভারপাস ব্যবহার করছে না। তবে বর্তমানে অভয়ারণ্য এলাকায় ২টি আন্ডারপাস ও পানি চলাচলের জন্য নির্মিত ব্রিজ দিয়ে বন্যহাতি চলাচল করতে দেখা গেছে।

চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে নির্মিত এলিফ্যান্ড ওভারপাসের বনায়ন কার্যক্রমের দায়িত্বে থাকা সাবেক উপ–প্রধান বন সংরক্ষক ড. তপন কুমার দে জানান, বৃষ্টি হলে ওভারপাসের উপরে হাতির পছন্দের গাছ লাগিয়ে পুণরায় বনায়ন করা হবে। তবে শেষ কবে বন্যহাতি ওভারপাসে বিচরণ করেছিল সেটার সঠিক কোনো তথ্য জানাতে পারেননি তিনি। এছাড়া মহাসড়কে সওজের বিভিন্ন ধরনের সাইনবোর্ড আর গেট দেয়ার কারণে বন্যহাতির চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানান তিনি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হাতি বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ আবদুল আজিজ জানান, অভয়ারণ্যের ভেতর রেললাইন যাবার কারণে হাতির চলাচলের রাস্তা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর্টিফিসিয়াল যেই ওভারপাসটি করা হয়েছে সেটা হাতির সাথে খাপ খাওয়াতে সময় লাগবে। ওভারপাসের উপর পর্যাপ্ত গাছ–পালা থাকা লাগবে। যাতে এই জায়গা হাতি নিজেদের আবাস মনে করে। যদি ওভারপাসের উপর কোনো ধরনের গাছ–পালা না থাকে, রোপিত গাছের পরিচর্যা করে সংরক্ষণ করা না হয়, ওই জায়গা যদি একেবারে খোলা মাঠের মতো দেখা যায় তাহলে হাতি ওই পথ দিয়ে চলাচল করবে না। হাতি বনাঞ্চলের প্রাণী। তারা খাবারের জন্য বনের বাইরে আসে। মূলত তারা মানুষের উৎপাত থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চায়। রেললাইনে ওভারপাস আর আন্ডারপাস নির্মাণে নানা ত্রুটি রয়েছে। তারপরও সেগুলো যদি সঠিকভাবে পরিচর্যা করা না হয় তাহলে হাতি এসব পথ দিয়ে চলাচল করবে না। ওভারপাসের উপর বনের পরিবেশ ফিরে পেলে হয়তো বন্যহাতি ওই পথ দিয়ে পুণরায় চলাচল করবে।

পাঠকের মতামত

দৈনিক জনকণ্ঠের রিপোর্ট রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকায় প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর সরকারি লাইসেন্স নেই, তদন্ত টিমের পরিদর্শন

রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা উখিয়ায় ১৫টি ক্লিনিক হাসপাতাল ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার চলছে অনুমতি বিহীন। সরকারিভাবে কোন ...

উখিয়ায় র‌্যাব পরিচয়ে অপহরণ, ইউনিফর্ম, অস্ত্র-গুলি ও হাতকড়াসহ আটক ১

কক্সবাজারের উখিয়ায় র‌্যাব পরিচয়ে রোহিঙ্গা যুবককে অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা এবং প্রতারণার অভিযোগে একটি সংঘবদ্ধ ...