প্রকাশিত: ০৩/০৩/২০২০ ৮:৩২ এএম

আবদুর রহমান, টেকনাফ ::
খুন, ধর্ষণ, ইয়াবা কারবার, মানব পাচার, অপহরণ-এমন কোনো অপরাধ নেই ‘এডরা পাহাড়ে’ হচ্ছে না। এই পাহাড়টি কক্সবাজারের টেকনাফের জাদিমোরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রধান সড়ক থেকে তিন দুই কিলোমিটার ভেতরে। এই ক্যাম্পের ত্রাস কুখ্যাত জকির ডাকাত ওরফে জকির আহমদ। সেখানে আশ্রয়স্থল বানিয়ে গড়ে তুলেছে অপরাধ জগত। তার ক্যাম্প জুড়ো রয়েছে অপরাধের শক্ত নের্টওয়াক।
(২ মার্চ) সোমবার ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত টেকনাফের জাদিমোরা ও শালবনের মাঝামাঝি ‘এডরা পাহাড়ে’ র‌্যাবের সঙ্গে গোলাগুলিতে ৭ ডাকাত নিহত হয়েছেন। তারা সবাই জকির ডাকাত দলের সদস্য ছিল। তারা হলেন, টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের জাদিমোরা ও শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসান্দিা মোহাম্মদ ফারুক (৩০), মোহাম্মদ আলী (২৫), নুর হোসেন ওরফে নুর আলি ও ইমরান (৩২)। বাকি তিন জনের পরিচয় পাওয়া যায়নি।

শীঘ্রই শুভ উদ্বোধন! ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এজেন্ট ব্যাংকিং কুতুপালং শাখা

এসবত তথ্য নিশ্চিত করে কক্সবাজার র‌্যাব-১৫ অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ বলেন, ‘এডরা’ নামক গভীর পাহাড়ে কুখ্যাত রোহিঙ্গা ডাকাত জকির গ্রæপের সদস্যরা অবস্থানের খবরে তার নেতৃত্বে র‌্যাবে আরও একটি বিশেষ বড় টিম চিহ্নিত পাহাড়ের ভিন্ন পথে একে একে চারটি পাহাড় ডিঙ্গিয়ে আস্থানায় পৌছলে স্বশস্ত্র ডাকাতদলের সদস্যরা র্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে এলোপাতারি গুলি করতে থাকে। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে থেমে থেমে চার বন্দুকযুদ্ধ চলতে থাকে। এতে র‌্যাব সদস্যা তল্লাশি চালিয়ে ৩টি বিদেশী পিস্তল, ১২ রাউন্ড গুলি, ৭টি ওয়ার সুটার গ্যান ও ১৩ রাউন্ড কার্তুজের গুলি উদ্ধার করা হয়। এসসময় রোহিঙ্গা ডাকাত গ্রæপের সাত সদস্যের গুলিবিদ্ধ মরদেহ পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, ঘটনার সময় কুখ্যাত রোহিঙ্গা ডাকাত জকিরও ছিল। তবে সে পালিয়ে যায়। তবে এই পাহাড়ের থাকতে পারে। নিহতদের মধ্যে চার জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তাদের ক্যাম্পের লোকজন ডাকাত হিসেবে শনাক্ত করেছে। এ ঘটনায় ৩টি মামলা রুজুর প্রক্রিয়া চলছে।
এডরা ঝুপড়িতে ডাকাতের আশ্রয়স্থল
টেকনাফের জাদিমোরা ও শালবনের মাঝামাঝি পাহাড়ে আশপাশে যেসব রোহিঙ্গাদের ঝুপড়ি রয়েছে সেগুলো নির্মাণ করেছিল অ্যাডভেন্টিস্ট ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড রিলিফ এজেন্সি (এডরা) নামে একটি এনজিও। তারই সেই জায়গায়টি রোহিঙ্গাদের কাছে এডরা নামে পরিচিত। তবে রোহিঙ্গাদের সেই বিশাল সমাবেশের পেছনে স¤পৃক্ততা পাওয়ায় কানাডাভিত্তিক এনজিও এডরা কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে সরকার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টেকনাফ শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝি বলেন, ‘এডরা পাহাড়ে ছড়া পাশে যে ঝুপড়ি ঘর রয়েছে সেখানে জকির ডাকাত বাহিনীরা আশ্রয় নিতো। তারা কয়েকদিন পর পর সেখানে এসে থাকেন। মাঝে মধ্যে আশের পাশের লোকজন সেই ঘর থেকে চিৎকারের শব্দ পেতো। কিন্তু ভয়ে কেউ কিছু বলতে সাহস পায়নি। কেকনা তারা ধর্ষণ, খুন ও মুক্তিপন আদায় করে আসছিল। এই ক্যাম্পের বেশির ভাগ মানুষ খুশি হলেও ভয়ে ভয়ে মুখ খুলছে না। ’
আবদুর করিম নামে আরেক রোহিঙ্গা বলেন, ‘এই ক্যাম্পে সংলগ্ন পাহাড়ে ডকির ডাকাত এর শক্ত অপরাধ নেটওয়ার্ক রয়েছে। পুরো ক্যাম্পের মানুষ তার জিম্মি হয়ে রয়েছে। কিন্তু এখন একটু পরিস্থিতি শান্ত হতে পারে। আবার অনেকে জকির অধরা থাকায় ভয়ের মধ্যে রয়েছে। এখানকার পরিবেশে শান্ত করতে হলে তাকে গ্রেফতারের বিকল্প নেই।’
কে এই জকির
স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, টেকনাফের নয়াপাড়ার সি বøকের আমিনের ছেলে জকির (২৮)। একাধিক বিয়ে করেছে সে। জকিরের নেতৃত্বে ২০-২৫ জনের একটি গ্রæপ রয়েছে। তাদের হাতে দেশি অস্ত্র ছাড়াও অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে। কোনো কোনো জায়গায় জকির বাহিনী ‘সালমান শাহ বাহিনী’ নামেও পরিচিত।
যেভাবে উত্থান জকিরের:
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, একসময় রোহিঙ্গা ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ করত নূরে আলম ডাকাত। তার গ্রুপ একজন আনসার সদস্যকে হত্যা করে তার অস্ত্র লুট করেছিল। ২০১৮ সালে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয় সে। এরপর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ নেয় সলিম বাহিনী। নূরে আলম ও সলিম দু’জনের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক ছিল জকিরের। কিন্তু ইয়াবার মুনাফার ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্বে সলিমকে হত্যা করে জকির বাহিনী। ফলে ক্যাম্পে জকির প্রায় একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পায়।
আয়ের উৎস ইয়াবা, মানব পাচার ও চাদাঁবাজি:
জকির বাহিনীর অর্থের জোগানের একটি বড় উৎস ইয়াবা ও মানব পাচারের। বাংলাদেশ-মিয়ানমারের যেসব সিন্ডিকেট ইয়াবা ও মানব পাচার করছে, তাদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোয়ারা নেয় তারা। এমনকি সাগরপথে মানব পাচারের আগে ওইসব পাহাড়ে যাত্রীদের আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অনেক সময় জকির বাহিনীর সদস্যরা ইয়াবা ও মানব পাচারে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়। ইয়াবা ছাড়াও ক্যাম্পে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় তারা নিয়মিত মহড়া দেয়। রোহিঙ্গা নারীদের অপহরণেও জড়িত তারা। রোহিঙ্গাদের অন্যখানে পাচার করেও অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে এই বাহিনী।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, নয়াপাড়া ক্যাম্পের পেছনের পাহাড়ে রোহিঙ্গা ডাকাতদের আস্তানা গড়েছে। দিনে পাহাড়ে আর রাতে ক্যাম্পে চষে বেড়ায় তারা। খুন, ধর্ষণ, ইয়াবা কারবার, মানব পাচার, অপহরণ- এমন কোনো অপরাধ নেই যা তারা করছে না
এদিকে গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরের পাশে জকির বাহিনীর আস্তানায় অভিযানে গেলে র‌্যাবের ওপর গুলি চালায় এই বাহিনী। এতে কক্সবাজার র‌্যাব-১৫ এর সিপিসি-২ হোয়াইক্যং ক্যাম্পের সদস্য সৈনিক ইমরান ও করপোরাল শাহাব উদ্দিন গুলিবিদ্ধ হন।
খুশি রোহিঙ্গা
সত্তরে উর্ধ্বে একই ক্যাম্পের বাসিন্দা হাফেজ আহমদ বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের জলুমকারিদের মৃত্যুর খবর শুনে আমরা সবাই খুশি। তবে ভয়েও আছি কেননা এখনও বড় ডাকাত জকির ধরা পড়েনি। জানিনা সে এসে ক্যাম্পের মানুষদের উপর কি চালায়। এই ক্যাম্পে প্রতিদিন রাতে গুলির শব্দ শুনা যায়। ফলে ভয়ে প্রতিদিন নির্ঘুম রাত কাটে আমাদের। এ ঘটনার পরে এখানকার বাসিন্দারা খুবিই ভয়ের মধ্যে রয়েছে।’
জাসতে চাইলে টেকনাফ সিপিসি-১ ক্যাম্পের ইনচার্জ মির্জা শাহেদ মাহাতাব বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখে রোহিঙ্গা জকির ডাকাত ক্যাম্পের অন্যতম টপ মোস্ট ক্রিমিনাল। দীর্ঘদিন ধরে তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। কিন্তু এখনও অধরাই রয়ে গেছে সে। শক্তিশালী নেটওয়ার্ক থাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পৌঁছানোর আগেই সে পালিয়ে যাচ্ছে। তাকে দ্রæত গ্রেপ্তার করা হবে।
টেকনাফ মডেল থানার অফিসার ইনর্চাজ (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, ‘র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত সাত রোহিঙ্গা ডাকাতের মরদেহ উদ্ধার করে লাশ ময়না তদন্তের জন্য কক্সবাজার মর্গে পাঠানো হয়েছে। ডাকাতদের আস্তানায় পুলিশের বড় অভিযান চলবে।’

পাঠকের মতামত

কারাগার থেকে বের হয়ে আবারো রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ ও ইয়াবা নিয়ন্ত্রণে নবী হোসেন গ্রুপ

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আলোচিত নবী হোসেন কারাগার থেকে বের হয়ে ফের বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তার বাহিনীর ...

শিবিরের প্যানেলে জায়গা পেয়ে যা বললেন সর্ব মিত্র চাকমা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্যানেল ঘোষণা করেছে ইসলামী ছাত্রশিবির। ...