
গ্রেপ্তার এড়াতে প্রতিনিয়ত কৌশল বদলাচ্ছে মাদক পাচারকারীরা। এক কৌশল ধরা পড়ে গেলে ব্যবহার করা হচ্ছে আরেক কৌশল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে নেয়া কৌশলগুলো ক’দিন পরেই অভিযানে বা তল্লাশিতে ধরা পড়ছে। সর্বশেষ শুক্রবার পিকআপ ভ্যানের জ্বালানি তেলে ট্যাংকের ভেতরে রেখে ইয়াবা পাচারের সময় পুলিশ সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। এর আগে বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম নগরীতে বাসের ক্যাসেট প্লেয়ার বক্সে করে ইয়াবা পাচারের সময় ৫ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের উপপরিচালক মো. আলী আসলাম হোসেন বলেন, ধরা পড়ার ভয়ে মাদক ব্যবসায়ীরা প্রাণঘাতী কৌশলসহ নিত্য নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। কিন্তু তাতেও লাভ নেই। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর অভিযানে তাদের নেয়া কৌশলগুলো মাঠে মারা যাচ্ছে।
সূত্র জানায়, প্রায় দিনই স্থল ও জল সীমান্তসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন ধরনের মাদক জব্দ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ইয়াবাই সবচেয়ে বেশি। আর মাদক পাচারে বাহকদের অদ্ভুত কৌশলে বিস্মিত সংশ্লিষ্টরা। পায়ুপথ, কনডম, মাছ, সবজি, ফ্রিজ, ওভেন, মাথায় নকল চুলের ভাঁজ, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন সেট, লাশের কফিন, গাড়ির বিভিন্ন অংশ, অন্তর্বাস, লিপস্টিকের কৌটা, ভ্যানিটি ব্যাগ, জুতার হিল, জুতার সুকতলা, গাছের খোড়ল, চানাচুরের প্যাকেট, আসবাবপত্রের জয়েন্ট, এলপি গ্যাস সিলিন্ডার, সুপারি, ক্যামেরার ভেতর বিভিন্ন পদ্ধতিতে মাদক বহন করছে পাচারকারীরা। নতুন কৌশল বিশেষ করে দেহের অভ্যন্তরে ইয়াবার প্যাকেট বহনের কারণে তা অনেক সময়ই প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে, তাতে পাচারকারীরাও বিপদে পড়ছে।
পিকআপের জ্বালানি তেলের ট্যাংকে ইয়াবা : গত শুক্রবার ভোররাতে চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁওয়ের এক কিলোমিটার নামক এলাকায় পিকআপের জ্বালানী তেলে ট্যাংক থেকে ৫ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে পুলিশ। চান্দগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ আবু মোহাম্মদ শাহজাহান কবির আজাদীকে জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শুক্রবার ভোররাতে এক কিলোমিটার এলাকার রিদম স্কয়ার কমিউনিটি সেন্টারের সামনে একটি পিকআপকে পুলিশ চ্যালেঞ্জ করে। এরপর পিকআপে তল্লাশি চালিয়ে জ্বালানি তেলে ট্যাংক থেকে পাঁচ প্যাকেট ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। সেগুলোর ভেতর আরও ২৫ প্যাকেট ছিল প্রতি প্যাকেটে ২০০টি করে ইয়াবায় মোট ৫ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধারা করা হয়। এ ঘটনায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়েছে বলে জানান ওসি শাহজাহান কবির। এর আগে বৃহস্পতিবার ভোরে নগরীর ফিরিঙ্গীবাজার এলাকায় শ্যামলী পরিবহনের একটি বাসের ক্যাসেট প্লেয়ারে তল্লাশি চালিয়ে ৫ হাজার পিট ইয়াবা উদ্ধার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সদস্যরা।
‘পাকস্থলীতে প্যাকেট সংরক্ষণ’ পদ্ধতি : ‘পাকস্থলীতে প্যাকেট সংরক্ষণ’ পদ্ধতি সাম্প্রতিক সময়ে ইয়াবা পাচারের নিরাপদ পদ্ধতি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। বেকারত্ব এড়াতে বা অল্প পরিশ্রমে দ্রুত লাভের আশায় এমন প্রাণঘাতী কৌশলে ইয়াবা পাচারে জড়িয়ে পড়েছে অসংখ্য যুবক-যুবতী। তাতেও থামছে না এ কৌশল প্রয়োগ। গত ১৮ আগস্ট বিশেষ কায়দায় পাকস্থলিতে করে চার হাজার ২০০ পিস ইয়াবা নিয়ে ঢাকায় আসার পর ইমাম হোসেন নামের এক ব্যক্তিকে আটক করেন শুল্ক গোয়েন্দারা। মাত্র ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে সে এ কাজ করতে রাজি হয়েছিল। সে জানায় ২০টি করে ইয়াবা ট্যাবলেট পলিথিনে মুড়িয়ে ‘অ্যাম্পুল’ চকলেট আকৃতির একেকটি প্যাকেট তৈরি করা হয়। এসব প্যাকেট কলার ভেতরে ভর্তি করে গিলে ফেলা হয়। পলিথিন হজম না হওয়ায় গন্তব্য পৌঁছে টয়লেট করে এসব ইয়াবা বের করা হয়।
কক্সবাজারের উখিয়ায় ইনানী এলাকায় কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশে ১৯ জুন পাওয়া যায় দিলদার নামে ১৪ বছরের এক কিশোরের মরদেহ। লাশটি ময়নাতদন্তের পরই ওই কিশোরের পেটে পাওয়া যায় পাঁচটি ছোট পুঁটলিতে ভরা ইয়াবা! মাদক ব্যবসায়ীরা দিলদারের মুখ দিয়ে ইয়াবা ঢোকায়। বের করার সময় সে মারা যায়। ওই কিশোরকে প্রলোভন দেখিয়ে পাচারের উদ্দেশ্যে পেটের ভেতর ইয়াবার পুঁটলিগুলো ঢোকানো হয়েছিল।
শুকনো মরিচের ভেতর ইয়াবা : গত ৫ এপ্রিল টেকনাফের দমমমিয়া চেকপোস্টেই যাত্রীবাহী একটি বাসে তল্লাশি চালাচ্ছিলেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরা। এক যাত্রীর বড়সড় একটি ব্যাগ দেখে সন্দেহ হয় বিজিবির। এর ভেতর কী আছে? জিজ্ঞেস করতেই ইসমাইল নামের যাত্রী বলেন, শুকনো মরিচ। খটকা লাগে ব্যাগের ওজন বেশি হওয়ায়। এরপর মরিচগুলো নেড়েচেড়ে বিস্মিত হন বিজিবি সদস্যরা। মরিচের ভেতর বীজের জায়গায় রয়েছে ইয়াবা বড়ি! সেই মরিচগুলো থেকে বের করা হয় সাড়ে সাত হাজার পিস ইয়াবা।
এনার্জি বাল্বের কার্টনে ইয়াবা : গত ১৯ নভেম্বর নগরীর কদমতলী এলাকায় দুটি পরিবহন কোম্পানির কার্যালয়ে তল্লাশি চালিয়ে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকার ৯০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে র্যাব। এ সময় দুই মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়। র্যাবের চট্টগ্রাম জোনের সহকারী পরিচালক অ্যাডভোকেট চন্দন দেবনাথ বলেন, এনার্জি বাল্বের কার্টনে নতুন আঙ্গিকে নতুন কৌশলে ইয়াবাগুলো পাচারের জন্য রাখা হয়েছিল। অভিযানে ১৬টি এনার্জি বাল্বের কার্টন জব্দ করা হয়। এর দুটি কার্টনের মধ্যে ইয়াবার ৩৫টি প্যাকেট পাওয়া যায়। প্যাকেটগুলো থেকে ৭০ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়েছে। এরপর আরেকটি অফিসে অভিযান চালিয়ে ১২টি এনার্জি বাল্বের কার্টন জব্দ করা হয়। এর দুটি কার্টন থেকে ইয়াবার ১০টি প্যাকেট পাওয়া যায়, যেখানে ২০ হাজার পিস ইয়াবা ছিল। এ সময় দুই মাদক ব্যবসায়ীকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করা হয়।
সুপারির ভেতরে ইয়াবা : গত জুন মাসে নগরের আগ্রাবাদ এলাকার ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর মার্কেটের সামনে থেকে সুপারির ভেতরে বিশেষ কৌশলে রাখা ৯০০ পিস ইয়াবাসহ ফাতেমা জান্নাত (৪০) ও নাসির আহমেদকে (২৪) গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৯টি সুপারি উদ্ধার করা হয়। সুপারির ভেতরে প্যাকেটে ভর্তি ইয়াবাগুলো পাওয়া যায়। ৯টি সুপারি থেকে ৯টি প্যাকেট উদ্ধার করা হয়। প্রতিটি প্যাকেটে ১০০ করে ইয়াবা ছিল।
বইয়ের ভেতর ইয়াবা : বইয়ের ভেতর পাতা কেটে বিশেষ কায়দায় চার হাজার ৭০০ ইয়াবা পাচারের সময় শাহ আমানত সেতু এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হয় হুমায়ুন লিটন (২০)। লিটন বইয়ের ভেতরে গর্ত করে এক হাজার আট’শ ইয়াবা সেখানে রাখে। পুলিশ তার কাছ থেকে ইয়াবাভর্তি দু’টি বই উদ্ধার করেছে।
বার্মিজ স্যান্ডেলের তলায় ইয়াবা : ১০ জুন বিজিবি সদস্যরা টেকনাফে যাত্রীবাহী বাসে অভিযান চালিয়ে রঙিন বার্মিজ স্যান্ডেল উদ্ধার করে। এরপর স্যান্ডেলগুলোর তলা কেটে বিশেষ কায়দায় রাখা এক হাজার ৮৯৫ পিস ইয়াবা, ১৪ হাজার একশ’ কিয়াট (মিয়ানমারের মুদ্রা) উদ্ধার করা হয়। ওই স্যান্ডেলের মালিক মিয়ানমারের নাগরিক ইউনুস আলী অভিনব কায়দায় ইয়াবা বহনের তথ্য দেন। এর আগে ৪ জুন টেকনাফের হোয়াইকং চেকপোস্টে একই কায়দায় স্যান্ডেলের তলায় পাওয়া যায় ইয়াবা।
পাতিলের ছাঁচে ইয়াবা : ১৭ মে সকালে টেকনাফের দমদমিয়া চেকপোস্টে ১১ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে বিজিবি। এসব ইয়াবাও বহন করা হয়েছিল বিশেষ কায়দায়। অ্যালমিনিয়ামের দুটি পাত্রের মধ্যে বিশেষ ছাঁচে রাখা হয়েছিল ইয়াবাগুলো। ওই ঘটনায় বিজিবি সাদ্দাম হোসেন ও আহাম্মদ হোসেন নামের দু’জনকে আটক করে।
আমের ভেতরে ইয়াবা : রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে এক যাত্রীর ব্যাগ তল্লাশি করে আমের মধ্যে লুকানো এক হাজার ৮০০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে রেলওয়ে পুলিশ। ঢাকা রেলওয়ে থানার ওসি আবদুল মজিদ বলেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাকে আটক করে তল্লাশি করা হয়। শরীর ও সঙ্গে থাকা ব্যাগ বারবার তল্লাশি করেও ইয়াবা পাওয়া যায়নি। পরে তার ব্যাগে থাকা আম কেটে দেখা যায়, ইয়াবার প্যাকেট। সাতটি আম কেটে নয়টি প্যাকেটে এক হাজার ৮০০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। আমের ভেতরে ইয়াবা রাখার কৌশল সম্পর্কে তিনি বলেন, আম কেটে ভেতরের অংশ ফেলে দিয়ে ইয়াবা ঢুকিয়ে তা স্কচটেপ দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছিল। আমগুলো দেখে বোঝার উপায় ছিল না এরমধ্যে ইয়াবা লুকানো রয়েছে।
অভিনব কায়দায় ইয়াবা পাচার প্রসঙ্গে বায়েজিদ থানার ওসি মো: মোহসিন আজাদীকে বলেন, আমি বাকলিয়া থানার ওসি থাকাকালীন কর্ণফুলি শাহ আমানত সেতু চেকপোস্টে যানবাহনে তল্লাশি চালাতে গিয়ে দেখেছি, কতভাবে ইয়াবা পাচার করছে অপরাধীরা। তাই আগের চেয়ে বাড়তি সতর্কতায় যাত্রীদের তল্লাশি করতে হচ্ছে। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, আব্দুল আউয়াল (৩৭) নামে একজনের ল্যাপটপের ভেতরে তল্লাশি চালিয়ে তিন’শ পিস ইয়াবা পেয়েছিলাম। শুধু তাই নয়, জুতোর তলায়, ছাতার ভেতর ইয়াবা পাচারের ঘটনাও ঘটেছে। ইউনূস ও সৈয়দ ইসলাম নামের ঐ দুই রোহিঙ্গা অস্থায়ী পাশ নিয়ে মিয়ানমার থেকে টেকনাফে প্রবেশ করে। এক হাজার পিস ইয়াবা নিয়ে রাতে বাসে করে শাহ আমানত সেতু এলাকায় আসেন। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ দু’জনের শরীরে তল্লাশি চালায়। এদের একজন জুতোর তলায় ও অন্যজনের ছাতার ভেতর সুকৌশলে লুকিয়ে রাখা অবস্থায় ইয়াবা ট্যাবলেটগুলো উদ্ধার করে পুলিশ।
মাদক পাচারের আরেকটি অভিনব কৌশল সম্প্রতি ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে। প্রশাসনের চোখে ধূলো দিতে গাড়ির সিএনজি সিলিন্ডারে ভরে মাদক আনা নেওয়া করতো চক্রটি। গ্যাস সিলিন্ডারের ভেতরে নিয়ে পাচারের সময় ১৫ হাজার পিস ইয়াবাসহ দু’জনকে গ্রেপ্তার করে কর্ণফুলি থানা পুলিশ। কৌশলটি সম্পর্কে গ্রেপ্তারকৃত দুজন পুলিশকে জানান, সিলিন্ডারের একটি অংশে ছিদ্র করে তাতে ইয়াবা খুব সহজেই ঢুকানো হয়। পরে তা থেকে গ্যাস কাটারের সাহায্যে কেটে বের করে নেয়া হয় মাদক। পুনরায় ঝালাই করে দেয়া হয় সিলিন্ডারগুলো। এতোটা দক্ষভাবে রঙ করা হয়, কেউ সহজে বুঝতে পারে না যে সিলিন্ডারগুলো ফাঁপা কিংবা ফুটো করা। ফুটো করা কিংবা ঝালাই করা কাজও তারাই করে থাকেন।
পাঠকের মতামত