সাঈদ মুহাম্মদ আনোয়ার, উখিয়া নিউজ ডটকম।
প্রকাশিত: ২২/০৯/২০২৫ ১:২৭ পিএম

বিশ্বের দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার—যা একদিকে প্রকৃতির অমূল্য দান, অন্যদিকে কোটি দেশি-বিদেশি পর্যটকের প্রিয় গন্তব্য। এই সৈকতের বালিয়াড়ি শুধু সৌন্দর্যের বাহক নয়; এগুলো সাগরের ঢেউয়ের ধাক্কা ঠেকিয়ে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলকে রক্ষা করে। অথচ এই অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ রাতের আঁধারে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আগামীতে সম্ভাব্য ক্ষমতায় আসা একটি রাজনৈতিক দলের  সিন্ডিকেটের দখলবাজিতে।

গত শুক্রবার গভীর রাতে সৈকতের সুগন্ধা ও কলাতলী পয়েন্টে রাতারাতি শতাধিক দোকান বসিয়ে ফেলে একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী। শনিবার বিকেলে গিয়ে দেখা যায়, একই রঙ ও নকশায় নির্মিত দোকানগুলো বালিয়াড়ি দখল করে দাঁড়িয়ে আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি ছড়িয়ে পড়তেই দেশি-বিদেশি পর্যটক, পরিবেশবাদী ও সচেতন মহলে ক্ষোভের ঝড় ওঠে।

রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় রাতারাতি শতাধিক দোকান, বিদায়ী ডিসির বিরুদ্ধে কোটি টাকার কার্ড বাণিজ্যের বিস্ফোরক অভিযোগ, হাইকোর্টের জোয়ার-ভাটার লাইন থেকে ৩০০ মিটার এলাকা ‘নো ডেভেলপমেন্ট জোন’ ঘোষণার আদেশও বারবার উপেক্ষিত

রাজধানী থেকে আসা পর্যটক হুমায়ূন আহমেদ হতাশা প্রকাশ করে বলেন, “ভাই, এসব দেখার কেউ নেই? আমরা নিঃশ্বাস ফেলার জন্য সৈকতে আসি, অথচ চারপাশ জঞ্জালে ভরে গেছে। সৈকতের এই রূপ ভয়ঙ্কর।”

রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় দখল মহোৎসব :
স্থানীয়দের অভিযোগ, একটি রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকা সিন্ডিকেট অস্ত্রের মহড়া দিয়ে এই দখল কার্যক্রম চালাচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কেউ বাধা দিতে গেলে গুলির ভয় দেখানো হয়েছে।

সুগন্ধা ঝিনুক মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জয়নাল উদ্দিন বলেন, “যদি বৈধ অনুমতিপত্র থাকে, তবে রাতের আধাঁরে কেন দোকান বসাতে হবে? এটা স্পষ্ট অন্যায়। রাজনৈতিক  সুবিধাভোগী একটি সিন্ডিকেট অবৈধভাবে দোকান বসাচ্ছে।”

স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দাবি, আলোচিত দুই ব্যক্তি—জাকির হোসেন ও নূরুল হুদা ওরফে গুরামিয়া—এই দখলযজ্ঞের মূল নিয়ন্ত্রক। সম্প্রতি তারা নতুন করে ৭৪টি কার্ড কিনে রাতারাতি দোকান বসাচ্ছেন। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন নূরুল হুদা, আর জাকির হোসেন দাবি করেছেন, তার কেবল একটি দোকান আছে।

বিদায়ী ডিসির বিরুদ্ধে ৯ কোটি টাকার বাণিজ্যের অভিযোগ :
পরিবেশ আন্দোলনের নেতা করিম উল্লাহ সরাসরি অভিযোগ করে বলেন, বিদায়ী জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন সৈকতে ৩০০ নতুন কার্ড অনুমোদন দিয়ে প্রায় ৯ কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন। প্রতিটি কার্ডের জন্য নেওয়া হয়েছে ৩ লাখ টাকা। এমনকি অভিনন্দন জানানো রাজনৈতিক নেতা এবং প্রভাবশালীরাও ভাগ পেয়েছেন প্রায় ৯০ লাখ টাকা। তার ভাষ্য, “বিদায়ী ডিসির শেষ ইনকাম ছিল সৈকতের কার্ড ব্যবসা। নতুন ডিসি না আসায় সিন্ডিকেট বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।”

প্রশাসনের বিব্রতকর স্বীকারোক্তি :
জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আজিম খান বলেন, “দোকান বসানো ব্যক্তিদের কাগজপত্র যাচাই করা হচ্ছে। অবৈধভাবে দোকান বসানোর কোনো সুযোগ নেই। অনুমতিপত্রে স্পষ্ট শর্ত আছে—বালিয়াড়ি দখল করা যাবে না।”

অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. শাহেদুল আলম অকপটে স্বীকার করেন, “আমরা অত্যন্ত বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছি। রাতারাতি দেশের এত বড় একটি সম্পদ দখল হয়ে যাবে—এটা কল্পনাও করিনি।”

কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি আপেল মাহমুদ বলেন, “সৈকতের বালিয়াড়িতে দোকান বসানো কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। বৈধ কাগজপত্র থাকলেও বালিয়াড়ি দখল করা যাবে না। এগুলো অবশ্যই সরাতে হবে।”

আইন ও আদালতের নির্দেশনা উপেক্ষিত :
১৯৯৯ সালে সরকার কক্সবাজার সৈকতকে ‘পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ (ইসিএ) ঘোষণা করে। গেজেটে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়—সৈকতের বালিয়াড়ি ও বেলাভূমিতে কোনো স্থাপনা নির্মাণ নিষিদ্ধ।

২০১৭ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) রিট করলে হাইকোর্ট জোয়ার-ভাটার লাইন থেকে ৩০০ মিটার এলাকা ‘নো ডেভেলপমেন্ট জোন’ ঘোষণা করে। কিন্তু সেই আদেশও বারবার উপেক্ষিত হয়েছে।

২০২৪ সালের ডিসেম্বরে হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়নের নোটিশ দিলে জেলা প্রশাসন লোক দেখানো উচ্ছেদ অভিযান চালায়। কয়েক দিনের মাথায় আবারো দোকান বসানো হয়। এবারের দখল কার্যক্রম তারই পুনরাবৃত্তি।

পরিবেশ ও পর্যটন শিল্পের ভয়াবহ হুমকি :
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, বালিয়াড়ি প্রাকৃতিকভাবে তৈরি উপকূলের ঢাল। এগুলো সাগরের ঢেউয়ের ধাক্কা সামলে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে গ্রাম ও শহরকে রক্ষা করে। অথচ এগুলো ধ্বংস করে দোকান বসানো মানে পরিবেশের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া।

পরিবেশবাদী নেতা দীপক শর্মা দীপু বলেন, “নতুন জেলা প্রশাসক যোগদানের আগেই গোপন অনুমতি নিয়ে সিন্ডিকেট বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সৈকতের বালিয়াড়ি দখল মানে কক্সবাজার নয়, পুরো বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করা।”

প্রশ্নের মুখে প্রশাসন :
রাতারাতি সৈকতের বালিয়াড়ি দখলের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সব দায় চাপানো হচ্ছে জেলা প্রশাসনের ওপর। অভিযোগ উঠেছে, প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা গোপনে অনুমতি দিয়েছেন দোকান বসানোর। গত বছরের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর থেকেই এসব অনুমতিপত্র দেওয়া শুরু হয়।

সৈকতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরিবেশ রক্ষায় আদালতের নিষেধাজ্ঞা, সরকারি গেজেট, কিংবা প্রশাসনিক উচ্ছেদ—কোনোটিই কার্যকর হচ্ছে না। এখন প্রশ্ন উঠেছে—বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কি শেষ পর্যন্ত প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের কব্জায় চলে যাবে? নাকি রাষ্ট্র তার অমূল্য সম্পদ রক্ষায় সত্যিই কঠোর পদক্ষেপ নেবে?

পাঠকের মতামত

বিতর্কিত মন্তব্যে আলোচিত মুফতি আমীর হামজা কক্সবাজারে: সতর্ক করলো জামায়াত

 বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে আলোচিত ইসলামী বক্তা মাওলানা মুফতি আমির হামজা’কে সতর্ক করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ...