
ডেস্ক রিপোর্ট ::
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ঢলের দুই বছর পূর্ণ হয়েছে ২৫ আগস্ট। মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে কক্সবাজারের সীমান্ত এলাকায় পালিয়ে আসতে শুরু করে রোহিঙ্গারা। অনেকটা ‘এক কাপড়ে পাড়ি দিয়েছিল লাখ লাখ রোহিঙ্গা। উদ্বাস্তু হয়ে আসা এসব রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে অস্থায়ীভাবে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছেন। তবে উদ্বাস্তু এসব রোহিঙ্গাদের অনেকেই এখন ওই এলাকায় ক্যাম্পের ভেতরে হরেক রকমের দোকানসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। অনেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিও জুটিয়ে নিয়েছেন। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দেওয়া ত্রাণে ভরছে পেট, ব্যবসা-চাকরির টাকায় ভরছে পকেট।
এভাবে দুই বছরের মাথায় কক্সবাজারে অনেকটা জেঁকে বসেছে লাখ, লাখ রোহিঙ্গা। বর্তমানে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে।আর এ দুই বছরেই গলার কাঁটা হয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে স্বদেশে ফেরার কোনো তাড়াই নেই।
এটি পরিলক্ষিত হয় ২৫ আগস্ট উখিয়ার কুতুপালং মেগা ক্যাম্পের বর্ধিত-৪ নং ক্যাম্পের মাঠে বর্ষপূর্তি সমাবেশের আয়োজন করে মাস্টার মহিবুল্লাহর আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস বা (এআরএসপিএইচ)।
হাজার হাজার রোহিঙ্গার অংশগ্রহণে ওই সমাবেশে সংগঠনটির পক্ষ থেকে ঘোষনা দেয়া হয়, কক্সবাজারে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গারা নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা ছাড়া মিয়ানমার ফেরত যাবে না।
সমাবেশে রোহিঙ্গা নেতা মুহিব উল্লাহ আরো বলেন রোহিঙ্গারা এখন ঐক্যবদ্ধ হয়েছে শুধু অধিকার ফিরে পেতে। আমরা নিজেদের দেশে ফিরতে চাই।কিন্তু অধিকার ও নিরাপত্তার নিশ্চিয়তা ছাড়া কখনো ফিরে যাবে না।মিয়ানমার সরকারের উপর আস্হা রাখা বোকামি।
এরআগে গত ২২ আগস্ট সরকারের সব ধরনের প্রস্তুতির পরও শেষ মুহূর্তে এসে বহুল প্রত্যাশিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কার্যক্রম আবারও স্থগিত করা হয়েছে।এর আগে গত বছরের ১৫ নভেম্বর একই রকমের একটি প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ রোহিঙ্গাদের অনাগ্রহের কারণেই ভেস্তে যায়।এ খবরে স্থানীয় লোকজনকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেলেও ওই এলাকার রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গ্রুপ ও কতিপয় এনজিওগুলোর মাঝে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে।
এতেই বোঝা যায় রোহিঙ্গাদের স্থায়ী করে রাখতে কক্সবাজারকে ঘিরে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও আইএনজিওদের গভীর ষড়যন্ত্র। যা মিয়ানমার সরকারেরও পরম চাওয়া।
এছাড়া মিয়ানমারে মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার ইয়াংহি লি চলতি বছর ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, কক্সবাজারের সীমান্ত এলাকায় আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা শিগগিরই ফিরে যাবে না।
মিয়ানমারের ভেতরে রোহিঙ্গাদের জন্য ‘সেফ জোন’ (নিরাপদ অঞ্চল) গড়ার প্রস্তাব ও কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গাদের ভাসান চরে নেওয়ার পরিকল্পনার ব্যাপারেও তিনি উদ্বেগ জানান। আর ইয়াংহি লি’র মত রোহিঙ্গাদের কথাতেও মিল পাওয়া যায়।
সম্প্রতি কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং,বালুখালী এলাকার কয়েকটি ক্যাম্পে ঘুরে বিভিন্ন বয়সী শতাধিক রোহিঙ্গার সঙ্গে আলাপকালে তাদের ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে তাদের একজনও ফেরার আগ্রহ দেখায়নি। সবাই বলেছে, মিয়ানমারে তাদের ফেরার পরিবেশ নেই। তাদের ওপর যে নিপীড়ন হয়েছে তার বিচার, ক্ষতিপূরণ, নিরাপত্তা, নাগরিকত্ব—এসব পাওয়ার পরই ফেরার প্রশ্ন আসবে। কেউ কেউ তাদের জন্য ‘স্বাধীন দেশ’ করে দেওয়ার কথাও বলেছে।
মা-বাবা মিয়ানমারের হলেও জুনায়েদের জন্ম কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে। শুদ্ধ বাংলা বলায় অনেক বাংলাদেশিকেও হার মানাবে এই কিশোর।
ব্যাটারিচালিত রিকশা চালিয়ে সে উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবির এবং বালুখালীসহ নতুন শিবিরগুলো ঘুরিয়ে দেখানোর সময় জানায়, শরণার্থী পরিচয়পত্রও আছে তার। রোহিঙ্গা শিবির ছেড়ে নারায়ণগঞ্জে গিয়ে বাসে বাসে আচার বিক্রিও করে সে। এক বোনকে বিয়ে দিয়েছে বগুড়ায়।
মিয়ানমার কবে ফিরবে জানতে চাইলে জুনায়েদ জানায়, মিয়ানমার কোনোভাবেই তার দেশ নয়। তার জন্ম এ দেশেই। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে অন্য এক বন্ধুর সঙ্গে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মিয়ানমারের ভেতরে কিছু দূর গিয়েছিল সে। কিন্তু ঘরবাড়ি আগুনে জ্বলতে দেখে আর গুলির শব্দ শুনে ফিরে এসেছে।
এদিকে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগকে অগ্রাধিকার দিতে উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাগুলো (আইএনজিও)। চলতি বছর জেনেভায় রোহিঙ্গাদের জন্য এ বছরের তহবিল ঘোষণার অনুষ্ঠান ঘিরে ওই আহ্বান জানিয়েছে অক্সফাম, সেভ দ্য চিলড্রেন এবং ওয়ার্ল্ড ভিশন।
উন্নয়ন সহযোগী অনেক দেশ ও সংস্থাও এরই মধ্যে বাংলাদেশের কাছে বিষয়টি তুলে ধরেছে।কানাডা সরকারের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত বব রে চলতি বছর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে রোহিঙ্গাদের শিক্ষা ও কাজের সুযোগ দেওয়ার বিষয়টিও তুলেছিলেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি অ্যালেক্স নেভি ও সাদ হামাদি ঢাকায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকালেও এ দেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের শিক্ষা ও কাজের সুযোগ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন।
এক টুইট বার্তায় রোহিঙ্গাদের পড়ালেখা ও কাজের সুযোগের পাশাপাশি অবাধ বিচরণের প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরেন।
অক্সফাম তার ওয়েবসাইটে সেভ দ্য চিলড্রেন এবং ওয়ার্ল্ড ভিশনকে নিয়ে এক যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে। সেখানে তারা রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থ সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানায়।
ওয়ার্ল্ড ভিশনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘শিক্ষা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি মানবাধিকার। রোহিঙ্গা শিশু ও তাদের অভিভাবকরা আমাদের বলেছেন যে শিক্ষাই তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।’
সেভ দ্য চিলড্রেনের রোহিঙ্গা সংকটে সাড়া দান বিষয়ক দলনেতা বলেন, ভয়ংকর নিপীড়নের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হওয়ার মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা শিশুদের অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে। এখন বাংলাদেশে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে দ্বিতীয়বার তাদের অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়া উচিত নয়।
অক্সফাম এর এক কর্মকর্তা বলেন, বয়ঃসন্ধিতে উপনীত হলেই রোহিঙ্গা কন্যাশিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। বাংলাদেশ সরকার ও দাতা সংস্থাগুলোর উচিত রোহিঙ্গা শিবিরে নারী ও কন্যাশিশুদের শিক্ষা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টি করা। এতে তারা নিপীড়ন থেকে সুরক্ষা পাবে।
এ কারণে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে আসা ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসনের কোনো লক্ষণ নেই। ফিরিয়ে নিতে প্রস্তুত বলে জানালেও মিয়ানমার গত ২৩ মাসে এমন কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেয়নি যাতে রোহিঙ্গারা ফিরতে উৎসাহী হয়। বরং ফেরার অনিশ্চয়তার মধ্যে রোহিঙ্গারা এ দেশে বাঁচার জন্য যে সংগ্রাম করছে, তাতেই ধীরে ধীরে তাদের শিকড় গাড়ছে এ দেশে।
আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ঘিরে তৎপরতা বাড়ছে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও তাদের সহযোগী দেশি-বিদেশি বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও, আইএনজিও)। যেন এ দেশে রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব আর এনজিওগুলোর তৎপরতা এক সূত্রে মিলেছে।
রোহিঙ্গাদের ফিরতে নিরুৎসাহিত করা, প্রত্যাবাসন বিরোধী সমাবেশে ব্যানার, ফেস্টুন সরবরাহের অভিযোগও আছে কিছু এনজিও ও তাদের কিছু কর্মীর বিরুদ্ধে। আবার রোহিঙ্গা শিবিরে ও বিদেশে অবস্থানরত শিক্ষিত ও অবস্থাসম্পন্ন রোহিঙ্গারাও ব্যানার, ফেস্টুন তৈরিতে উৎসাহ দিয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া নিষেধ অমান্য করে আশ্রয় শিবিরের কিছু স্কুলে রোহিঙ্গা শিশুদের বাংলায় পাঠদান ও পরীক্ষা নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশে সই হওয়া প্রত্যাবাসন চুক্তিতে প্রথম পর্যায়ে ২০১৬ সালের অক্টোবর মাস থেকে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাই সাপেক্ষে স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনের কথা বলেছে। তাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসের আগে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার বিষয়ে আলোচনার কথা রয়েছে।
২০১৬ সালের অক্টোবর মাসের আগে বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত প্রায় ৩০ হাজার এবং অনিবন্ধিত প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা ছিল বলে ধারণা করা হয়।
মংডুর উত্তরে নেশং থেকে আসা ফাইয়াজুর রহমান (২০) এখন বালুখালী-২ (ক্যাম্প ১১)-এর বাসিন্দা। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কক্সবাজারে আসার চার-পাঁচ মাস পরই আশ্রয়শিবিরের মধ্যে একটি দোকান খুলেছেন তিনি। ১১ সদস্যের পরিবারের জন্য তিনটি কার্ড পেয়েছেন। মাথাপিছু মাসিক সহায়তা মিলে ৭৭০ টাকা করে।
মিয়ানমারে ফিরবেন কি না জানতে চাইলে ফাইয়াজুর রহমান বলেন, ‘সবাই বলে মুসলমানদের অধিকার দেবে, শান্তি দেবে। কিন্তু ধোঁকাবাজ। ধোঁকাবাজের কাছে যেতে হলে বাংলাদেশ যে রকম রক্ত ঢেলেছে, এ রকম রক্ত ঢালতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘বর্মীরা কোনো দিন আমাদের অধিকার দেবে না। পৃথিবী যদি অস্ত্র দিয়ে স্বাধীন করে দেয় তাহলে দেবে। এমনিতে গেলে দুই বছর, তিন বছর হয়তো শান্তি দেবে। ১৯৯১ সালে রোহিঙ্গা এসেছে। অনেকে দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বার এসেছে। এবার শেষবার। এবারও যদি ফেরত যাই তাহলে আমাদের কী হালত হবে?’
ফাইয়াজুর রহমান বলেন, ‘ওইটায় ঠ্যাংয়ের তলে মাটি নাই। আমাদের কথা কেউ শুনবে না। আমরা তো ভাসা (ভাসমান)। আল্লাহ সমাধান চায় না। তাই আমাদের এভাবে শাস্তি দিছে।’
তিনি জানান, ২০১৭ সালে মিয়ানমার বাহিনী রাখাইনে রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান শুরু করলে তাঁরা আর বাঁচতে পারবেন না বলেই ধরে নিয়েছিলেন। সেই সময় মিয়ানমার বাহিনী রোহিঙ্গা নারীদের যৌন নির্যাতনও করেছিল। এমন প্রেক্ষাপটে মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে তাঁদের গ্রামের উপযুক্ত সব নারী ও পুরুষ বিয়ে করেছিলেন। এরপর পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন তাঁরা।
তবে ফাইয়াজুরের এটিই প্রথম বাংলাদেশে আসা নয়। কয়েক বছর আগে তিনি বাংলাদেশে ঢুকে চট্টগ্রামের পটিয়ায় একটি মাদরাসায় পড়ালেখাও করেছেন। তাঁর মতো আরো অনেকে এভাবে এসে পড়ালেখা এবং পরে এ দেশে বিয়েও করেছেন। তিনি আরো জানান, মিয়ানমারে থেকে যাওয়া তাঁর স্বজনরা সেখানে আর কত দিন থাকতে পারবেন তা নিয়ে এখনো ঘোর অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন।
উখিয়ার পশ্চিম বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরের এক নম্বর সড়কের পাশে গড়ে ওঠা জমজমাট বাজারে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে দেদার বার্মিজ ও বাংলাদেশি পণ্যের বেচাকেনা চলছে।
মংডুর বলিরবাজার থেকে আসা জাফর সওদাগর সেখানে তিনটি দোকান খুলেছেন। এখন দিনে অন্তত ৫০ হাজার টাকার পণ্য বিক্রি হয় বলে জানান তিনি।
বালুখালী পান বাজারে এক রোহিঙ্গা কিশোরকে তার বাড়ির বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে সে আশ্রয় শিবির দেখায়। আগে বাড়ি কোথায় ছিল জানতে চাইলে সে উত্তর দেয়, ‘বার্মা’। ওই কিশোর জানায়, মিয়ানমারে তাদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার কোনো আগ্রহই তার নেই।
বালুখালী শিবিরের আরো ভেতরে লুৎফর রহমান নামে এক রোহিঙ্গা জানান, মংডু থেকে ১২ মাইল দূরে উডং গ্রামে তাঁদের বাড়ি ছিল। সব ফেলে আজ তাঁরা এখন বাংলাদেশে। তিনি বলেন, ‘সবাই ফিরে গেলে আমিও ফিরে যাব। তবে আমি জানি, সবাই যাবে না। সব হারিয়ে আমরা এ দেশের দয়ায় ঠাঁই পেয়েছি। আমরা এখানেই মরতে চাই।’
বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরের একটি মসজিদে জুমার নামাজের সময় খুতবার আগে রোহিঙ্গা ইমাম বলছিলেন, আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বাদশাহ বানিয়ে দেন, আবার যাকে ইচ্ছা নিঃস্ব করে দেন। এ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গাদের চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে? কত বিত্তবান রোহিঙ্গা নিঃস্ব হয়ে এ দেশে এসেছে।
তিনি মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতেরও উদাহরণ দেন। নামাজের পর ইমাম সাহেব দোয়া করছিলেন, মুসলমান হিসেবে মুসলমানের দেশে যাতে তাদের মৃত্যু হয়। এরপর সবাই সমস্বরে বলে, ‘আমিন’।
সেদিন বিকেলে বালুখালীর আরেকটি আশ্রয়শিবিরে বয়োবৃদ্ধ এক রোহিঙ্গা শরীরে মিয়ানমার বাহিনী ও রাখাইনদের নির্যাতনের ক্ষত দেখিয়ে জানান, ‘আঁরা না যাইমু। বর্মাত মারি ফালাইবো। জায়গাও নাই, কিছু নাই। আঁরা গিয়া কি কত্তাম’ (আমরা যাব না। মিয়ানমারে আমাদের মেরে ফেলবে। জায়গা-জমি কিছুই নেই। ফিরে গিয়ে কী করব?)
বুথিডং থেকে আসা সুলতান মাহমুদ (৬০) জানান, তাঁর পা মিয়ানমার বাহিনীর দোসররা কেটে ফেলেছে। আহত অবস্থায় পরিবারের লোকজন তাঁকে গামছায় বেঁধে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছে। মিয়ানমারে ফিরে যাবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মরি গেলে অনিক ভালো হইবো’। তিনি জানান, রোহিঙ্গা নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের মিয়ানমার বাহিনী ঘরে আটকে আগুন দিয়ে মেরেছে। তিনি আর সেখানে ফিরতে চান না।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, রোহিঙ্গাদের জন্য বিদেশি সহায়তার পরিমাণ আগের চেয়ে কমছে। এই সংকটের রাজনৈতিক সমাধান না হলে এটি ফিলিস্তিনের মতো ভয়াবহ সংকটে রূপ নেবে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে বিশ্ব সম্প্রদায়কে সংকটের ভয়াবহতার বিষয়ে সতর্ক করেছে।
জানা যায়,২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার ঘটনার পর পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোগত সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। তাদের সঙ্গে রয়েছেন ১৯৮২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত নানা অজুহাতে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্যে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়া আরও অন্তত সাড়ে তিন লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলে বাংলাদেশে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তি সম্পন্ন হয়। একই বছরের ৬ জুন নেপিদোতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মধ্যেও সমঝোতা চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী, গত বছরের ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। তবে আবারও হামলার মুখে পড়ার আশঙ্কায় রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরতে অস্বীকৃতি জানানোয় ব্যর্থ হয় ওই উদ্যোগ।
সর্বশেষ চলতি বছরের জুলাই মাসে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে নতুন করে উদ্যোগের অংশ হিসেবে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব মিন্ট থোয়ের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধি দল। ১৫ সদস্যের দলটি দুই দিন ধরে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনা ও বৈঠক করে। এসব বৈঠকে রোহিঙ্গাদের তরফে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব ও চলাফেরায় স্বাধীনতার দাবি পুনর্ব্যক্ত করা হয়।
তবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মঙ্গলবার (২০,২১ ও ২২ আগস্ট) তিনদিনে ৩১৬ রোহিঙ্গা পরিবারের মতামত নেওয়া হয়। মিয়ানমারে ফেরার ব্যাপারে কোনও আগ্রহ দেখা যায়নি তাদের মধ্যে। সাক্ষাৎকারদাতারা জানান, রোহিঙ্গা স্বীকৃতি ও ভিটেমাটি ফিরে না পেলে ফেরত যাবেন না তারা।
পাঠকের মতামত