প্রকাশিত: ০৬/১০/২০১৬ ৭:৩২ এএম

image-1672রোকেয়া লিটা::

আজ থেকে ১৬ কি ১৭ বছর আগের কথা। আমাদের বাসার পাশেই একটি একান্নবর্তী পরিবারে বউ হয়ে আসে এক প্রতিবেশি মেয়ে। প্রেম করে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করছিলো তারা। তখন খুব ছোট ছিলাম, খুব বেশি হিসেব নিকেশ করে ভাবার মত জ্ঞান ছিলো না। তাই পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার কথা শুনে ভেবেছিলাম, নিশ্চয়ই একজন আরেকজনকে খুব বেশি পছন্দ করে, তাই হয়তো বাবা-মায়ে বা পরিবারের সম্মতির কথা ভাবেনি তারা। বিয়ের পর বেশ কিছুদিন ভালোই চলছিলো।

হঠাৎ একদিন গভীর রাতে, পাশের বাড়িতে কিছু মানুষ খুব জোড়ে জোড়ে কথা বলছে। আমরা বাড়িতে বসেই বুঝতে পারছিলাম, পাশের বাড়িতে সম্ভবত সালিশ বসেছে। রাতে আর বেশি কিছু জানা গেল না। পরের দিন সকালবেলা জানতে পারলাম, সেই দম্পতিকে নিয়ে বিচার বসেছে।

আমি খুব অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, ‘ওদের আবার কি হইলো?’ দেখি, আমার সামনে বড়রা কিছু বলে না। পরে, অনেক কষ্টে জানতে পারলাম, স্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বামীর অভিযোগ, চাহিবা মাত্রই স্বামীর যৌন কামনায় সাড়া দেয় না স্ত্রী। এর প্রতিবাদে স্বামীটি ওই বাড়ির কাজের মেয়েকে বিয়ে করতে চায়। পরিবার কাজের মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দেবে না, তবে স্ত্রীর স্বামীর প্রতি মনযোগী হতে হবে। মেয়েটি কেন তার স্বামীর কাছে সব সময় যেতে চায় না, সেটি জানার কোনো সুযোগ ছিল না। তবে, মেয়েটিকে বাধ্য করার বিষয়টি আমার ভালো লাগেনি। খুব অবাক হয়েছিলাম বিষয়টা শুনে। একটা মানুষের তো সবকিছু সব সময় ভালো না লাগতেই পারে, তাই বলে বিচার বসাতে হবে!

আমার কৈশোর থেকে শুরু করে আজ অবধি, ওই একটিমাত্র ঘটনাই আমার কানে এসেছিলো যেটাকে স্বামীর দ্বারা যৌন নির্যাতন বলা যায়। এতোদিন ভেবেছি, হয়তো এসব ঘটনা খুব বেশি নয়। হয়তো দুই-একজন অসুস্থ ও বিকৃত মানসিকতার পুরুষ থাকতেই পারে, যাদের পাল্লায় পড়লে, মেয়েদের এভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। কিন্তু, গতকাল ভয়াবহ রকমের একটি তথ্য পেলাম।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, প্রায় ২৫ শতাংশ বিবাহিত নারী এমন নির্যাতনের শিকার হন। জরিপে শারিরীক, অর্থনৈতিক, নিয়ন্ত্রণমূলক, বিভিন্ন ধরণের নির্যাতনের হার তুলে ধরা হয়েছে। আর এসব নির্যাতনের ক্ষেত্র নির্যাতনকারী হিসেবে দায়ী করা হয়েছে মূলত স্বামীকেই। মুশকিল হলো, স্বামীর দ্বারা শারিরীক, অর্থনৈতিক, নিয়ন্ত্রণমূলক নির্যাতনের সাথে আমরা সবাই কম-বেশি পরিচিত। নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে বা আমাদের আশপাশেই এসব ঘটনা ঘটছে। কিন্তু স্বামীর দ্বারা এমন নির্যাতন, ভাবতে পারেন এই সমাজে এ ধরণের নির্যাতন নিয়ে কথা বলা কতটা কঠিন!

আমাদের দেশে যৌন নির্যাতনকারীর সংজ্ঞাই আলাদা। সবাই ভাবে বহিরাগত ধর্ষক বা উত্ত্যক্তকারীরাই নির্যাতনকারী। যৌন নির্যাতনকারীর ভূমিকায় যে কখনও নিজের স্বামীও অবতীর্ণ হতে পারেন, সেই ধারণাই নেই আমাদের সমাজে। এই সমাজ ভেবে নেয়, একজন নারী একজন পুরুষকে বিয়ে করলো, মানে সে ওই পুরুষের সম্পত্তি হয়ে গেলো। স্বামী যখন তার স্ত্রীকে বাবার বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি দেবে, তখন সে বাবার বাড়িতে যেতে পারবে, স্বামী যখন তার স্ত্রীর সাথে শুতে চাইবে তখনই স্ত্রীকে রাজি হতে হবে। স্ত্রীর ভালো লাগা, মন্দ লাগা, ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো দাম নেই। সে কারণেই হয়তো, এ সব বিষয় নিয়ে মুখ খুলছে না মেয়েরা।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেব তো বলে, আমার একশ বান্ধবীর মধ্যে ২৫ জনই বিবাহিত জীবনে এমন নির্যাতনের শিকার। বান্ধবীদের অন্যান্য অনেক সমস্যার কথা জানতে পারলেও, নির্যাতনের কথা তো বলে না কেউ। তার মানে, সত্যিই মেয়েরা মুখ খুলতে পারছে না এসব সমস্যা নিয়ে।

এই প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়েছে স্বামীর দ্বারা নির্যাতিত নারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নির্যাতনের কথা কাউকে জানায়নি। আর জানালেই বা কি? যদি কোনো মেয়ে আভিযোগ করে যে, তার স্বামী রোজ রাতে তাকে ধর্ষণ করে, সমাজের কয়টা মানুষ সে কথা বিশ্বাস করবে? আমাদের সমাজের একটা বিরাট অংশ ধর্ষণ বিষয়টাই বোঝে না।

ধর্ষণ নিয়ে কথা বললে, কেউ কেউ বলে নারীরা পর্দা করে বেড়ায় না তাই ধর্ষিত হয়। আবার কেউ কেউ বলে, যেসব মেয়ে বিয়ের আগে পুরুষের কাছে গিয়ে শোয়, তাদের কথা তো কিছু বলেন না। অর্থাৎ বিয়ের আগে পুরুষের কাছে গিয়ে শোয়া আর ধর্ষিত হওয়াকে তারা একই পাল্লায় মাপছে। এখানে যে মেয়েটির সম্মতি আর অসম্মতির একটা ব্যাপার আছে, সেটা বেশিভাগ মানুষই বোঝে না। সেই মেয়েটা কি করে তারা স্বামীর দ্বারা ধর্ষিত হলে অভিযোগ করবে এই সমাজের কাছে? কার কাছে গিয়ে অভিযোগ করবে?

প্রায় প্রতিদিনই পত্রিকার পাতার ধর্ষণের খবর বের হয়, কয়জন ধর্ষকের বিচারের খবর দেখা যায় পত্রিকায়? বহিরাগত ধর্ষকের বিচার পাওয়াই যেখান কঠিন ব্যাপার, সেখানে স্বামীর দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হলে, সে কোনো সমাধান পাবে সেটা আশা করাই ভুল।

বরং পদে পদে নারীর ভূল ধরাটাই এই সমাজের গোপন অভিলাষ। বিবাহিত জীবনে পুরুষের বহিগামীতাকেও দেখা হয় নারীর অপারগতা হিসেবে। অনেকেই বলে, যে স্ত্রী তার স্বামীর সাথে থাকতে চায় না, সেই স্ত্রীর স্বামী তো অন্য নারীর কাছে যাবেই। অথচ স্ত্রী কেন স্বামীর কাছে থাকতে চাইছে না, সেটি ভেবে দেখার কোনো চিন্তাও করে না তারা। এমন কি হতে পারে না, ওই স্বামী নিয়মিতই তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করে! আর এজন্যই হয়তো মেয়েটি, তার স্বামীর কাছে থাকতে চায় না। ঢাকাটাইমস্২৪

লেখক: সাংবাদিক

পাঠকের মতামত

নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোই যখন বড় চ্যালেঞ্জ!

মিয়ানমারের তিনটি প্রধান এথনিক রেজিস্ট্যান্ট গ্রুপ—তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল এলায়েন্স (এমএমডিএ) এবং ...

একটি ফুল—

একটি ফুল, একটি ফুলের জন্যে কতো নিষ্পাপ গাছ প্রাণ হারালো, এই বর্বর শুকোনের দল বারংবার ...