ডেস্ক নিউজ
প্রকাশিত: ২৬/০২/২০২৪ ৫:২০ পিএম

ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের সাদিয়া সুলতানা সাথি। পেশায় গৃহিণী। বিদেশ যাওয়ার কোনো স্বপ্ন নেই। নেই পাসপোর্টও। গৃহিণী সাদিয়া সুলতানাকে টার্গেট করে তার এনআইডি কার্ড সংগ্রহ করে দালাল চক্রের সদস্যরা। তার ছবি, ঠিকানা ও এনআইডি কার্ড ব্যবহার করে কক্সবাজারে থাকা উম্মে ছলিমার নামে রোহিঙ্গা নারীর পাসপোর্ট তৈরি করা হয়।

অবৈধভাবে দাগি অপরাধী ও রোহিঙ্গাদের অবৈধভাবে জন্মসনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট বানিয়ে দেওয়া শক্তিশালী একটি প্রতারক চক্রের ২৩ সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর এ তথ্য জানিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ।

ডিবি পুলিশ বলছে, সাদিয়া সুলতানার মতো সাধারণ মানুষের এনআইডি কার্ড সংগ্রহে সক্রিয় রয়েছে দালাল চক্র। সংগ্রহের পর অন্যজনের নামে অবৈধভাবে তৈরি করা হয় এনআইডি কার্ড। বিপুল ডকুমেন্টস ও ডিভাইসসহ গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ, দালাল ও ২ আনসার সদস্যও।

এ কাজে প্রতারকচক্র তিনটি পর্যায়ে কাজ করে। ভুয়া জন্মসনদ তৈরি করে সেটি দিয়ে এনআইডি কার্ড করা হয়। আর সেটি দিয়ে অবৈধভাবে তৈরি করা হচ্ছে রোহিঙ্গা নাগরিকসহ দাগি আসামিদের জন্য পাসপোর্ট।

সোমবার দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদ।

হারুন অর রশীদ বলেন, “ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের একাধিক টিম রাজধানীর আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী ও বাড্ডায় ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে গত শনিবার বিপুল পাসপোর্ট সংক্রান্ত ডকুমেন্টস, পাসপোর্ট এবং কম্পিউটারসহ ৩ রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষ এবং ১০ জন বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করে। তাদের দেওয়া তথ্য ও সংগৃহীত ডকুমেন্টস বিশ্লেষণ করে রবিবার দিনে ও রাতে কক্সবাজার, টাঙ্গাইল এবং ঢাকায় অভিযান চালিয়ে দুই আনসার সদস্যসহ রোহিঙ্গা ও বাঙালি দালাল চক্রের ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।”

গ্রেপ্তারকৃতদের হেফাজত থেকে মোট ১৭টি পাসপোর্ট, ১৩টি এনআইডি, ৫টি কম্পিউটার, ৩টি প্রিন্টার, ২৪টি মোবাইল ফোন এবং পাসপোর্ট তৈরির সংশ্লিষ্ট শত শত দলিলপত্র জব্দ করা হয় বলে জানান অতিরিক্ত কমিশনার হারুন।

গ্রেপ্তারকৃত রোহিঙ্গারা হলেন- উম্মে ছলিমা ওরফে ছমিরা, মরিজান ও রশিদুল, রোহিঙ্গা দালাল আইয়ুব আলী ও মোস্তাকিম।

আনসার সদস্য দুজন হলেন- জামসেদুল ইসলাম ও মো. রায়হান। দেশি দালালরা হলেন- রাজু শেখ, শাওন হোসেন ওরফে নিলয়, ফিরোজ হোসেন, তুষার মিয়া।

আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর, উত্তরায় কম্পিউটারের দোকান খুলে এ কাজে লিপ্ত গ্রেপ্তারকৃত অপর দালালরা হলেন- শাহজাহান শেখ, শরিফুল আলম, জোবায়ের মোল্লা, শিমুল শেখ, আহমেদ হোসেন, মাসুদ আলম, আব্দুল আলিম, মাসুদ রানা, ফজলে রাব্বি শাওন, রজব কুমার দাস দীপ্ত, আল-আমিন, মো. সোহাগ।

অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, “শক্তিশালী এই চক্রটি মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শিশু, নারী ও পুরুষদেরকে লক্ষাধিক করে টাকার বিনিময়ে জন্মসনদ, এনআইডি ও পাসপোর্ট বানিয়ে দেয়।”

তিনি বলেন, “গ্রেপ্তারকৃত চক্রটির একটি দল কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি থেকে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের সংগ্রহ করে ঢাকায় নিয়ে আসে। আরেকটি দল তাদের জন্য জন্মসনদ, এনআইডি বানিয়ে দেয়। সর্বশেষ অন্য দলটি ঢাকাসহ বিভিন্ন আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে আনসার সদস্যদের মাধ্যমে ব্যাংকে এক্সপ্রেস, সুপার এক্সপ্রেস ধরনের টাকা জমা দেওয়া, বায়োমেট্রিক্স করা ও ছবি তোলার ব্যবস্থা করে দেয়।”

ছয় ঘণ্টার মধ্যে জন্মসনদের জন্য এরা ৫ হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা নেয়। তিন দিনের মধ্যে এনআইডি করে নেওয়ার জন্য ২৫ হাজার টাকা এবং পাসপোর্ট তৈরি করার জন্য ১ লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা নিয়ে থাকে বলে প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছে।

গোয়েন্দা প্রধান বলেন, “গ্রেপ্তারকৃত দালালদের মোবাইলে শত শত পাসপোর্ট করে দেওয়ার প্রাসঙ্গিক সফট ডকুমেন্টস, ডেলিভারি স্লিপ পাওয়া গিয়েছে। যার মধ্যে গত তিন মাসে রোহিঙ্গাদের জন্য করা ১৪৩টি পাসপোর্ট ইতোমধ্যে তারা সরবরাহ করেছে। ২০১৯ সাল থেকে চক্রটি রোহিঙ্গাদের, বাংলাদেশি দাগি অপরাধীদেরকে ভিন্ন নাম ও ঠিকানায় হাজার হাজার পাসপোর্ট করে দিয়েছে।”

হারুন বলেন, “গ্রেপ্তারকৃতরা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, রংপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ ও বরিশাল জেলার ঠিকানা ব্যবহার করে জন্মসনদ ও এনআইডি বানিয়ে তার ভিত্তিতে পাসপোর্ট বানিয়ে থাকে।”

তিনি বলেন, “প্রযুক্তি অনুশীলনে অনেক দূর এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ডাটা, ডিজিটাল জন্মসনদ ডাটা, স্মার্ট এনআইডি ডাটা ব্যাংক আছে যেখানে বিভিন্ন বায়োমেট্রিক্স, ছবিসহ নানা তথ্য সংরক্ষিত। এসব তথ্য কোনোরকম ভেরিফাই না করেই ইচ্ছামতো তৈরি করা কাগজপত্রের ভিত্তিতে পাসপোর্ট অফিসে যে কেউ দালালদের মাধ্যমে টাকা জমা দিতে, বায়োমেট্রিক্স দিতে এবং পাসপোর্টের জন্য ছবি তুলতে পারে। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের স্মারক পাসপোর্ট তৈরির জন্য তাৎক্ষণিকভাবে রোহিঙ্গা ডাটা, ডিজিটাল জন্মসনদ ডাটা এবং স্মার্ট এনআইডি ডাটা ভেরিফাই করলেই রোহিঙ্গাসহ নন-বাংলাদেশিদেরকে শনাক্ত করা সম্ভব।”

পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে তো এসবি ভেরিফিকেশনের কাজ করে, তখন কেন ধরা পড়ে না? জানতে চাইলে হারুন বলেন, “ধরা পড়বে কী করে? একজনের হাতে জন্মসনদ, এনআইডি তুলে দেওয়ার পর সে যখন জরুরি ভিত্তিতে পাসপোর্ট করতে দেবে তখন তো পুলিশ দেখে মোবাইল নম্বর। সেই নম্বরে যোগাযোগ করলে সে সব বলে দেয়, কারণ তাকে তো সব শেখানো হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পুলিশ বর্তমান ঠিকানায় যায়। রোহিঙ্গা নাগরিক স্থায়ী ঠিকানা কক্সবাজার দিলেও বর্তমান ঠিকানা সে ব্যবহার করে।”

‘পাসপোর্টসহ হাসপাতাল ও সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে আনসার সদস্যরা কাজ করছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় দালালদের সঙ্গে মিলে প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। এবার দুই আনসার সদস্যকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। তাদের ব্যাপারে তদন্ত করবেন কি না’ এমন প্রশ্নে হারুন বলেন, “আরও কেউ জড়িত আছে কি না তা তদন্ত করে দেখছি। বিষয়টি আমরা আনসারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব।”

পাসপোর্ট জালিয়াতি কিংবা অবৈধভাবে পাসপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কেউ জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন বলেন, “বিষয়টি আমরা তদন্ত করছি। আমার মনে হয় এভাবে হাজার হাজার পাসপোর্ট রোহিঙ্গারা নিয়ে যাচ্ছে, দাগি আসামিরা নিচ্ছে। অথচ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভেরিফিকেশন করা হয় না। তাদের ডাটাবেজে তো দেশি নাগরিক ও রোহিঙ্গাদের সবার বিস্তারিত ডাটা রয়েছে।”

দাগি আসামিদের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অনেক দাগি আসামিও এভাবে পাসপোর্ট করেছে। তাদের নাম-পরিচয়ও আমরা তদন্তের স্বার্থে জানাচ্ছি না। গ্রেপ্তারকৃতদের আদালতে সোপর্দ করে আবেদন করা হলে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে আরও যারা যারা জড়িত তাদের নাম-পরিচয়ও বেরিয়ে আসবে।”

পাঠকের মতামত

উখিয়াবাসীর স্বপ্ন পূরণ করতে চাই – জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর বিবৃতি

গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি সংবাদের প্রেক্ষাপটে নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে বিবৃতি দিয়েছেন উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ...

ইসলামপুরে আটক রোহিঙ্গা যুবককে কুতুপালং ক্যাম্পে হস্তান্তর

জামালপুরের ইসলামপুরে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার মো. রোবেল (২২) নামের সেই রোহিঙ্গা যুবককে কক্সবাজারের কুতুপালংয়ের ট্রানজিট ...