প্রকাশিত: ১৮/০৫/২০১৭ ৯:৩১ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ৬:০২ পিএম

উখিয়া নিউজ ডেস্ক::
ভূমিতে পুঁতে রাখা মাইন নয়। বোমা তৈরি করতে গিয়েই শরীর ঝলসে গেছে রোহিঙ্গা হাফেজ সিরাজ ও হোসেন জোহারের। দু’জনেরই হাত, বুক ও মুখের অংশবিশেষ ঝলসে গেছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৪ মে মারা যান সিরাজ। আহত জোহার হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পুলিশ পাহারায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তাকে দেখাশোনা করছেন আলি আহমদ নামে তার এক সহযোগী। গত ৭ মে কক্সবাজার হাসপাতালে ভর্তি হবার পর আহতরা দাবি করেছিলেন মিয়ানমারের বুচিডংয়ে জঙ্গলে বাঁশ কাটতে যাবার পথে মাটিতে পুঁতে রাখা মাইনে তারা আহত হয়েছেন।
এ ঘটনায় কক্সবাজার সদর থানায় অবৈধভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের অপরাধে পুলিশ বাদি হয়ে একটি মামলাও দায়ের করা হয়েছে। একই ঘটনায় জড়িত ইয়াছিন নামে একজনকে কক্সবাজার থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠিয়েছে।
গতকাল বুধবার চমেক হাসাপাতালের বার্ন ইউনিটে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ৪০ বছর বয়সী হোসেন জোহারের হাত ও বুক ব্যান্ডেজে মোড়ানো। আগুনে ঝলসে উঠে গেছে পুরো মুখম-লের চামড়া। তাকে দেখাশোনা করছেন আলি আহমদ। জোহারের দাবি মিয়ানমারের বুচিডংয়ের ঘোনাপাড়ায় এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। হাত ও মুখ আগুনে ঝলসে যাওয়া প্রসঙ্গে জোহার জানান, আমার বাড়ি মিয়ানমারের বুচিডং থানার কেয়ান্দাং ইউনিয়নের ঘোনাপাড়ায়। বাড়ির অদূরে জঙ্গলে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প রয়েছে। সেখানে দুটি তাঁবু রয়েছে। একটিতে আমরা ১১ জন থাকতাম। অন্যটিতে বোমা তৈরি করা হতো। গত ৪ মে (বৃহস্পতিবার) বেলা সাড়ে তিনটায় তাবুতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। সেখানে সাতজন মারা গেছে। ঘটনার দুইদিনের মাথায় নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্ত পার হয়ে আমাদের লোকজনের সহযোগিতায় একটি সিএনজি ট্যাক্সিতে আমরা কক্সবাজার হাসপাতালে ভর্তি হয়। তুমব্রু খালের এপারে (বাংলাদেশ অংশে) আমাদের লোক ছিল। তারা আমাদেরকে প্রথমে স্যালাইন দেয়। কক্সাবাজার থেকে আমাদের চারজনকে চমেক হাসপাতালে নিয়ে আসা হয় গত ৭ মে। এরমধ্যে শামসুল আলম প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন। তিনি বর্তমানে উখিয়া কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে রয়েছেন। সেখানে তার আত্মীয় স্বজন রয়েছেন। গত ১৪ মে সকালে আহত হাফেজ সিরাজ মারা গেছে।
গত ১৩ মে এ প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় হাফেজ সিরাজের। তিনিও জানিয়েছেন মাইন বিস্ফোরণে তারা আহত হয়েছেন। জোহারের দাবি- বোমা বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলে সাতজন মারা গেছেন। তাবুর ক্যাম্পে তিনি এই প্রথম গিয়েছেন। তবে হাফেজ সিরাজের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। বোমা তৈরির তাবুতে সচরাচর সবার যাতায়াতের অনুমতি ছিলোনা। মাস্টার নাঈম ভাল বোমা বানাতে পারদর্শী। বিস্ফোরণে তিনিও মারা গেছেন। ধারনা করা হচ্ছে, প্রশিক্ষণ শিবিরে বোমা তৈরির করার সময় বিস্ফোরণে আহত হয়ে উক্ত চারজন কক্সবাজার হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্ত পার হয়ে আহত চারজন বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে জোহার এমনটি দাবি করলেও বিজিবির কক্সবাজার সেক্টর কমান্ডার কর্নেল রফিকুল হক জানান, প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে ৬ মের আগে ও পরে সীমান্তে কড়া পাহারা ছিলো। এই কড়াকড়ির মধ্যে গত ৬ মে আহত অবস্থায় একসাথে চারজন মিয়ানমারের নাগরিকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার কোনো সুযোগ ছিলো না। এ ধরনের কোনো তথ্য বিজিবির কাছে নেই।
গতকাল বুধবার বিকালে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফ্রাজুল হক টুটুল বলেন, মিয়ানমারে বোমা বিস্ফোরণে এই ঘটনা ঘটেছে। ওখানে থেকে আহত অবস্থায় নাফ নদী হয়ে অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কক্সবাজার ঢুকে চিকিৎসা নিয়েছে তারা। এতে চারজনকে আটক করা হয়। এরমধ্যে একজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে। তিনি বলেন, কক্সবাজার বা আশপাশের কোনো এলাকায় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেনি। মিয়ানমারে ঘটেছে। ঘটনার বিষয়টি বিজিবিও অবগত রয়েছে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফ্রাজুল বলেন, গত শুক্রবার ঈদগড়ে ‘সন্ত্রাস ও জঙ্গি বিরোধী সমাবেশ’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরপর গত মঙ্গলবার ও বুধবার দুইদিন ঈদগড়, মাঝির কাটা, গিলাতলী ও ব্যাংডেবাসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় অভিযান চালানো হয়েছে। অভিযানে ডাকাত ও অপহরণকারী সন্দেহে চারজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের জিঞ্জাসাবাদ করা হয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির পাইনছড়ি ও দোছড়ির লেইক্রিং মুরং পাড়ার গহীন অরণ্যে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গড়ে তুলেছে রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠি। দুই পাহাড়ের গহীন অরণ্যে আলাদা আলাদা করে রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্টি ‘আরএসও ও আল ইয়াকিং’ এর সদস্যরা ঘাঁটি তৈরি করেছে। এদের মধ্যে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার লোকজন রয়েছে। দুর্গম পাহাড় ও নদী হয়ে তারা কৌশলে যাতায়াত করে রামু ঈদগড় ও বাইশারীর কিছু নির্দিষ্ট এলাকায়।
দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় প্রশিক্ষনও নেন জঙ্গিগোষ্ঠির সদস্যরা। বাঁকখালী এলাকার কামিখাল থেকে বুশি পাহাড়ের উপর দিয়ে যেতে হয় এই ক্যাম্পে। এর কিছু অংশ মিয়ানমারেও পড়েছে। এই গহীন পাহাড়ে জঙ্গিগোষ্ঠি ‘আল ইয়াকিং’র প্রায় ৪০ থেকে ৫০ জন সদস্যও রয়েছে। মুরং পাহাড়ের ছরা হয়ে তারা সপ্তাহে দু’দিন রামুর গর্জনীয়া ও ঈদগড় বাজারে আসেন নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রী কিনতে।
স্থানীয় লোকজন জানান, কৌশলে তারা সবাইকে আয়ত্বে নিয়ে এসেছে। স্থানীয় লোকদের অর্থও সহায়তা করে থাকে এই জঙ্গিগোষ্ঠির সদস্যরা। বিতরণ করা হয় গরু-ছাগলও। ব্যবসার জন্য দেয়া হয় টাকাও। রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠি ‘আল ইয়াকিং’ এর নেতৃত্বে দিচ্ছেন ডাকাত আব্দুল হাকিম। মিয়ানমারের বড়ছড়া এলাকায় আব্দু হাকিমের বাড়ি। তবে দীর্ঘদিন ধরে তিনি অবস্থান করছেন টেকনাফের পল্লান কাটা এলাকায়। নিয়মিত তার আনাগোনা রয়েছে উখিয়া টেকনাফের নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে। বর্তমানে তিনি নাইংক্ষ্যছড়ির দোছড়ি লেইক্রিং মুরং পাড়ায় অবস্থান করছেন এমন খবর পাওয়া গেছে। আব্দুল হাকিমের সাথে রয়েছে ‘আল ইয়াকিং’ এর অন্যতম সদস্য আতাউল্লাহ।
খোঁজনিয়ে জানা যায়, বাঁকখালী নদীর উৎপত্তিস্থল নাইক্ষ্যংছড়ির পাইনছড়িতে রয়েছে নিষিদ্ধ রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠি ‘আরএসও’ এর ক্যাম্প। পাইনছড়ি বিজিবি ক্যাম্পের পূর্বদিকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে তাদের অবস্থান। নদীপথে যেতে হয় এই দুর্গম জঙ্গিগোষ্ঠির ক্যাম্পে। যাতায়াতের পথ দুর্গম হওয়ায় কোনো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যও যেতে পারেন না। তবে জঙ্গিগোষ্ঠির সদস্যরা নাইক্ষ্যংছড়ির বালু খাইয়্যা এলাকা দিয়ে কৌশলে যাতায়াত করে। তারা খাদ্য সরবরাহ করে দোছড়ি কলঘর এলাকার বাজার থেকে। আরএসও এর নেতা মাস্টার আয়ুব দুর্গম পাহাড়ের এই ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। ওখানে প্রায় ৮০ জনের মতো সদস্যও অবস্থান করছে নিয়মিত। জঙ্গি নেতা মাস্টার আয়ুবের তৎপরতার বিষয়েও অবগত রয়েছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।
কক্সবাজার মডেল থানার পরিদর্শক (ওসি) আসলাম হোসেন জানান, গত ৭ মে বিস্ফোরণে আহত চার মিয়ানমার নাগরিক কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়। তাদের মধ্যে একজন অক্ষত ছিল। বাকি তিনজনের মধ্যে দুইজনকে চমেক হাসপাতালে প্রেরণ করেন সদর হাসপাতালের চিকিৎসক। চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাফেজ সিরাজ নামে একজন মারা যায়। আহত জোহার ও তার দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা আলি আহমদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর আগে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ইয়াছিনকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
লোকজন জানান- কয়েকদিন ধরে কক্সবাজার সদর উপজেলার ঈদগাঁও, রামু উপজেলার রশিদনগর, জোয়ারিয়ানালা, গর্জনিয়া ও ঈদগড় এবং চকরিয়ার খুটাখালীতে ‘বন গবেষণার’ কথা বলে বাসা ভাড়া নিতে চেষ্টা করছে অজ্ঞাত যুবকেরা। অজ্ঞাত যুবকদের বাসাভাড়া খোঁজার তথ্যটি জেলা প্রশাসকও নিশ্চিত করেছেন।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন বলেন, বিভিন্ন এলাকার জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে ওই বিষয়টি জানতে পেরেছি। এ যুবকদের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। অনাকাক্সিক্ষত বিষয় থেকে সতর্ক থাকতে এলাকাবাসীর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করার জন্য ঈদগড় ইউনিয়নে গত শুক্রবার (১২ মে) ‘সন্ত্রাস ও জঙ্গি বিরোধী’ সমাবেশ করা হয়েছে। সেখানে ওসব ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, শিক্ষক, মসজিদের ইমাম ও সচেতন মহলসহ সবাই উপস্থিত ছিলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঈদগড় ইউনিয়নের ধুমছাকাটা এলাকার এক কাঠুরিয়া জানান, কিছুদিন আগে একা পাহাড়ে কাঠ কাটতে যান তিনি। ওইদিন পাহাড়ের মধ্যে কয়েকজন যুবককে দেখতে পান। তাদের প্রত্যেকের সাথে বড় বড় ব্যাগ ছিল। তাদের দেখতে উচ্চ পরিবারের মনে হয়েছে তাঁর। তাদের বিষয় নিয়ে মুখ খুলতে নিষেধ করেছেন ঐ যুবকেরা। সুত্র’ পূর্বকোণ

পাঠকের মতামত

মা ও মেয়ের একসঙ্গে এসএসসি পাস

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার চাতলপাড় ইউনিয়ন পরিষদের ১, ২, ৩ ওয়ার্ডের সংরক্ষিত সদস্য নুরুন্নাহার বেগম ৪৪ ...

আরাকান বিদ্রোহীর গুলিতে বাংলাদেশী যুবকের মৃ’ত্যু

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে বিদ্রোহীদের গুলিতে এক বাংলাদেশী যুবকের মৃত্যু হয়েছে। নিহতের ...