প্রকাশিত: ১৩/০৫/২০১৮ ২:৩৮ পিএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ৩:০১ এএম

অনলাইন ডেস্ক : বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা ‘তিন জ্ঞানী বানরের’ সাথে ভালোভাবেই খাপ খাইয়ে নিতে পারে। এই তিন বানরের একটি মিজারু তার চোখ ঢেকে রাখে, কিকাজারু তার কান বন্ধ রাখে এবং ইওয়াজারু মুখ চেপে রাখে।

প্রস্তাবিত ডিজিটিাল সিকিউরিটি অ্যাক্টটির কথায় আসা যাক। কর্তৃপক্ষের প্রায় খোলামেলা হুমকি এবং ক্ষমতাসীন দলের দুর্বৃত্তদের প্রকাশ্য নির্মমতায় সাংবাদিকদের পক্ষে কি ‘কিছু না শোনা, কিছু না দেখা এবং খারাপ কিছু না বলা’ ছাড়া অন্য কিছু করতে পারবে?

এমন অনেকে আছেন যারা মনে করছেন, এই আইনে সাংবাদিকদের জন্য কোনো সমস্যা হবে না। তাদের মতে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি অনেকটাই সামাজিক মাধ্যমের জন্য, সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে না। তাদের কথাই ঠিক, তাদের কথা ভুলও। তাদের উপলব্ধির মধ্যে ব্যবধান রয়েছে। বিষয়টির জটিলতা হলো, সামাজিক মাধ্যম আসলে ‘মূলধারার’ সাংবাদিকতা থেকে আলাদা কিছু নয়, ঠিক একইভাবে সাংবাদিকেরাও সামাজিক মাধ্যমকে ত্যাগ করতে পারে না। আর কোনো বিকল্প না থাকলে কি পেশাদার আত্মমর্যাদাসম্পন্ন পেশাদার কোনো ব্যক্তি কি সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ করতে পারেন? সেলফ সেন্সরশিপ আসলে কী? এটি সত্যিকার অর্থে সাংবাদিককে সত্য প্রকাশ করতে না দেওয়ার ব্যবস্থা। বিষয়টিকে সেলফ সেন্সরশিপ হিসেবে অভিহিত করে সাংবাদিকদের মর্যাদাহানিই ঘটনানো হচ্ছে।

মিডিয়ার স্বাধীনতা কেন গুরুত্বপূর্ণ?

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মিডিয়ার স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা – যে নামেই একে অভিহিত করা হোক না কেন, বিষয়টি সবসময়ই গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও স্বাধীনতার সাথে সম্পর্কিত বিষয়। তুর্কি লেখক ও চিন্তাবিদ মেহমেত মুরাত ইলদান বলেছেন, আপনার দেশে যদি মুক্ত সংবাদপত্র না থাকে, তবে আপনার সংবাদপত্র কেনার কোনো দরকার নেই। মিথ্যা কথা শোনার কোনো প্রয়োজন নেই! শাসকদের কাছ থেকে আপনি পরিকল্পিতভাবে সাজানো তথ্য পেয়ে যাবেন! ওই তথ্যই আপনার জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে!

আর বর্তমান সময়ে মিডিয়া স্রেফ প্রতিবেদন প্রকাশ করা আর সত্য বলার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অনেক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সাংবাদিক বলছেন, তারা নিরপেক্ষ নন, তারা পক্ষপাতদুষ্ট, তারা জনগণের পক্ষে রয়েছেন। তারা জনগণের অধিকার রক্ষার জন্য চেষ্টা চালায়, কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনার প্রয়াস চালায়, অপরাধ উন্মোচন করে।

আর সম্ভবত এ কারণেই কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের পছন্দ করে না।

গণতন্ত্রে প্রাণবন্ত মিডিয়া অপরিহার্য বিষয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটি অপরিহার্য উপাদান। এটি জনগণের কথা প্রকাশ করে। যদিও মনে হয় এটি সরকারের বিরুদ্ধে, আসলে তা নয়। বরং সরকার যেহেতু জনগণের জন্য কাজ করে, কাজেই এটি কার্যত সরকারের সহায়ক শক্তি। সরকার যদি সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়, সংবাদপত্র তাকে সঠিক পথে নিয়ে আসার চেষ্টা চালায়। কিন্তু সরকার সবসময় তা পছন্দ করে না। তখনই দমননীতি পরিচালিত হয়।

নির্মম পরিহাসের ব্যাপার হলো, সামরিক শাসনের সময় সংবিধান স্থগিত হলেও তথাকথিত গণতান্ত্রিক আমলের চেয়ে ওই সময় সংবাদপত্র বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে।

অনেক বছর আগে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বলেছিলেন, ‘চারটি বৈরী সংবাদপত্র সহস্ত্রাধিক বেয়োনেটের চেয়ে বেশি ভীতিকর জিনিস।’ এ কারণেই কর্তৃপক্ষ ‘বৈরী’ সংবাদপত্র বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে।

প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মিডিয়া ও সচেতন জনসাধারণের কাছ থেকে তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েছে। জনগণ গুমকিগ্রস্ত ও ভীত হয়ে পড়েছে। মিডিয়া দমবন্ধকর পরিস্থিতিতে পড়ে গেছে।

চাপ ও হয়রানি সত্ত্বেও সাংবাদিকেরা সব ধরনের অপরাধ ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরেছে। জঙ্গি তৎপরতা, ব্যাংকিং কেলেঙ্কারি, পুলিশের পাশবিকতা, আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি প্রকাশ করছে। এমনকি শক্তিশালী র‌্যাব পর্যন্ত তাদের কোনা কোনো সদস্যের জঘন্য কাজের দায়িত্ব স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে নারায়ণগঞ্জের ঘটনার কথা বলা যেতে পারে।

নতুন আইনটি বলবৎ হলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে গুপ্তচরবৃত্তির সমার্থকে পরিণত করা যাবে সহজেই। কোনো অনুসন্ধানী সাংবাদিক যদি ক্ষমতাসীন কারো দুর্নীতি কিংবা ক্ষমতার সাথে জড়িত কারো মুখোশ উন্মোচন করার চেষ্টা চালায়, তবে তাকে গুপ্তচর হিসেবে অভিহিত করা যাবে। ওই সাংবাদিককে জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি সৃষ্টিকারী হিসেবে অভিহিত করা যাবে।

এমনকি ওই আইনটি ছাড়াই সংবাদপত্র বেশ কঠিন অবস্থায় ছিল। সরকার তাদের শিবিরে না থাকা সংবাদপত্রগুলোর বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়েছিল। এখন অবশ্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বিপুল বিজ্ঞাপনের কারণে সরকারি বিজ্ঞাপনের ওপর তেমন নির্ভরশীল হতে হয় না। কিন্তু সরকার থেমে না থেকে ওইসব বহুজাতিক কোম্পানির লাইফলাইন কেটে দিয়েছে। এসব বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এখন সব পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে পারে না।

সংবাদপত্রকে হয়রানি করার আরেকটি হাতিয়ার হলো আদালতে মামলা ঠোকা। নানা ছলছুতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে মামলা দায়েরের ফলে এসব সংবাদপত্রের সম্পাদকদের দেশের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে যেতে হয়। স্রেফ হয়রানি করার জন্য দায়ের করা এসব মামলার শুনানির জন্য তাদেরকে আদালতে হাজির হতে হয়।

আরেকটি বিষয় হলো গুম। ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে যারা মনের কথা বলতে চান, সরকারের সমালোচনা করেন, প্রধানমন্ত্রী বা তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তাদেরকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, তারা আর ফেরেন না। আর কখনো যদি ফেরেনও, তবুও তারা বাকি সময় সম্পূর্ণ নীরব থাকেন।

গণতন্ত্র বনাম উন্নয়ন

উন্নয়ন ও গণতন্ত্র পরিপূরক। গণতন্ত্রের বিকল্প হিসেবে উন্নয়নের কথা বলা মূর্খতা, জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মইনুল ইসলাম। তিনি বলেন, যারা বলেন যে উন্নয়নের স্বার্থেই ২০১৮ সালের নির্বাচনেও বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রাখা উচিত তারা আসলে প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনার অনিষ্ঠ সাধনই করছেন।

বাংলাদেশ এখন গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে। এটি হলো স্বাধীনতা ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের মধ্যে, দুর্নীতি ও সততার মধ্যে, গুটিকতেক ক্ষমতাধর ও সাধারণ মানুষের সংগ্রামের ব্যাপার। মিডিয়া কোথায় দাঁড়াবে?

মিডিয়াকে অবশ্যই সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে হবে। সত্য বটে, মিডিয়া এখন ভালো অবস্থায় নেই। তবে যত নাজুক অবস্থাতেই থাকুক না কেন, কেউ তাকে দমন করতে পারবে না। বিষয়টি টিকে থাকার ব্যাপার। চাপের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারলে মিডিয়া টিকে যাবে। যদি না পারে তবে তার হবে মৃতপ্রায় মিডিয়া, অপ্রয়োজনীয় মিডিয়া, এই মিডিয়ার টিকে থাকার কোনো অধিকার নেই।

পাঠকের মতামত

গ্রামাঞ্চলে দ্রুত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

গ্রামাঞ্চলে দ্রুত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ...

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির আশা বাংলাদেশ-গাম্বিয়ার

রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে করা মামলার দ্রুত নিষ্পত্তিতে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে বাংলাদেশ ও গাম্বিয়া। ...

কারামুক্ত হলেন মামুনুল হক

হেফাজতে ইসলামের সাবেক কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক কারামুক্ত হয়েছেন। শুক্রবার (৩ মে) সকাল ...

সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উখিয়ায় হবে উন্মুক্ত কারাগার, শিগগির নির্মাণ শুরু

উন্নত দেশের ন্যায় বাংলাদেশে উন্মুক্ত কারাগার নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ...
   
x