
মৌলভীবাজারের নাসিরপুরে নিহত জঙ্গি ‘সপরিবারে আত্মঘাতী’ মোশারফ ওরফে সোহেল রানা ছিল নব্য জেএমবির মধ্যম-সারির নেতা। সে ছিল ‘আত্মঘাতী সদস্য’ সংগ্রহ ও বোমা বানাতে দক্ষ ছিল। সাংগঠনিক সিদ্ধান্তেই সে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে গিয়ে সদস্য সংগ্রহ শুরু করে। নানা রকম ছদ্মবেশে সে নব্য জেএমবির জন্য সদস্য সংগ্রহ করতো। ধীরে-ধীরে দক্ষ হয়ে ওঠে বোমা তৈরির কারিগর হিসেবেও।
মাস কয়েক আগে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির আস্তানা ছেড়ে চলে আসে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে। নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা মাঈনুল ইসলাম ওরফে মুসার সঙ্গে ছিল নিয়মিত যোগাযোগ। কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, সিলেটে মুসার আস্তানায়ও সোহেল রানার যাতায়াত ছিল। দুই মাস আগে মৌলভীবাজারের নাসিরপুরের বাসায় আস্তানা গাড়ে সে। এ সময় সে নিজের নাম বলেছিল কামরুল তালুকদার ওরফে মাহফুজ, বাড়ি টাঙ্গাইল। গত বুধ ও বৃহস্পতিবার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের এক অভিযানে স্ত্রী ও সন্তানসহ নিহত হয়।
এই আস্তানায় নিহত পুরুষ জঙ্গি যে মোশারফ ওরফে সোহেল ও তার পরিবার, এ বিষয়ে মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ক্রাইম ইউনিট। তারা জানান, নিহত নারীদের মধ্যে একজন সোহেলের স্ত্রী শাহনাজ।
জঙ্গি সোহেলের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে জানিয়ে সিটিটিসির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আব্দুল মান্নান বলেন, ‘তার স্থায়ী ঠিকানা বের করার চেষ্টা চলছে। পরিবারের সদস্যদের পেলে সোহেলের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে।’
সিটিটিসি ইউনিট সূত্র জানায়, জঙ্গি মোশারফ হোসেন ওরফে সোহেল রানা বছর দুয়েক আগে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে যায়। সেখানে সেলিম নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে প্রথমে কিছুদিন রাবার বাগানে চাকরিও করে। এছাড়া ভ্রাম্যমাণ কাপড়ের ব্যবসাও ছিল তার। পরবর্তী সময়ে স্থানীয় একটি মসজিদের ইমাম হিসেবেও নিযুক্ত ছিল কিছুদিন।
তার হাত ধরেই মূলত ৭ মার্চ কুমিল্লার চান্দিনায় গ্রেফতার হওয়া নাইক্ষ্যংছড়ির সুরত আলম ওরফে হাসান, ১৬ মার্চ চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের প্রেমতলার ছায়ানীড় নামে জঙ্গি আস্তানায় নিহত জঙ্গি দম্পতি কামাল উদ্দিন ও জোবাইদা, পাশের আমিরাবাদ এলাকার সাধনকুটির থেকে গ্রেফতার হওয়া জোবাইদার ভাই জহিরুল ইসলাম ওরফে জসিম ও জহিরুলের স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা এবং রাজিয়ার বোন মরজিয়া ওরফে মর্জিনা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে।
সিটিটিসি’র কর্মকর্তারা জানান, মোশারফ ওরফে সোহেলের একটি পারিবারিক ছবি তারা হাতে পেয়েছেন। এই ছবির সঙ্গে নাসিরপুরের নিহত নারী, পুরুষ ও শিশুদের চেহারা ও বয়সের মিল রয়েছে। একমাত্র দুই থেকে তিন মাসবয়সী শিশুটি ছবিতে নেই। সিটির কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, ছোট্ট শিশুটি জন্ম নেওয়ার আগেই তোলা হয়েছিল।
তারা জানান, সোহেলের বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার জন্য তারা পরিবারের অন্য সদস্যদের সন্ধান করছেন। কিন্তু সীতাকুণ্ডের আস্তানায় সোহেল রানা নামে একটি জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া গিয়েছিল। সেখানে সোহেল রানার বাবার নাম নূরুল ইসলাম ও গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ উল্লেখ রয়েছে।
এদিকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির রাবারবাগানে কাজ করার সময় কাগজপত্রে নিজের স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে দিনাজপুরের ঘোরাঘাট উপজেলার হাসেমগঞ্জের ডাঙ্গাপাড়া গ্রাম উল্লেখ করা হয়। এখানেও বাবার নাম হিসেবে উল্লেখ কররা হয় নূরুল ইসলাম। এছাড়া সিটিটিসির কর্মকর্তারা সোহেল রানার একটি জন্ম নিবন্ধন পরিচয় হাতে পায়। ওই জন্ম নিবন্ধনে মোশারফ ওরফে সোহেল রানার পিতার নাম নূরুল ইসলাম ও গ্রামের বাড়ি চাপাইনবাবগঞ্জের ইসলামপুর ইউনিয়নের চরবারসিয়া উল্লেখ রয়েছে।
অভিযানে অংশ নেওয়া একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, জঙ্গিরা নিজেদের প্রকৃত পরিচয় আড়াল করার জন্য ভুয়া পরিচয়পত্র তৈরি করে। তারা সোহেলের তিনটি ঠিকানাতেই খোঁজ নিয়ে দেখছেন। তবে তাদের কাছে চাপাইনবাবগঞ্জের ঠিকানাটি আসল বলে মনে হয়েছে। এ কারণে চাপাইনবাবগঞ্জের ঠিকানায় তার পরিবারের সদস্যদের খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।
মাদ্রাসা পড়ুয়া সোহেল মানুষকে ‘মোটিভেটেড’ করায় দক্ষ ছিল উল্লেখ করে সূত্র জানায়, এই দক্ষতার জন্যই তাকে সদস্য সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তার হাতে মোটিভেটেড হওয়া জঙ্গিদের সে আত্মঘাতী হিসেবে তৈরি করে। একইসঙ্গে সে নব্য জেএমবির বোমা তৈরির কারিগর হিসেবে নিজেকে দক্ষ করে তোলে। তারা আরও বলেন, মৌলভীবাজারের বড়হাটের আস্তানায় আরেকজন দক্ষ বোমা তৈরির যে কারিগর আছে বলে ধারণা করছেন, তার কাছ থেকেই সোহেল বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ নেয়।
সিটির কর্মকর্তারা বলছেন, সোহেল রানার বিষয়ে তারা বিস্তারিত তথ্য এখনো হাতে পাননি। তবে যেটুকু তথ্য পাওয়া গেছে তাতে সোহেল আরবি লাইনে পড়াশুনা করেছে বলে জানতে পেরেছেন তারা। তার স্ত্রীর নাম শাহনাজ। ১৬ মার্চ সীতাকুণ্ডে অভিযানের ঘটনায় যে মামলা দায়ের হয়েছে তাতেও সোহেলের স্ত্রীর নাম শাহনাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সোহেল নব্য জেএমবির আরেক শীর্ষ নেতা পলাতক আব্দুস সামাদ ওরফে আরিফ ওরফে মামুর হাত ধরে কয়েকবছর আগে জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।
পাঠকের মতামত