ডেস্ক নিউজ
প্রকাশিত: ২৭/০৪/২০২৪ ৯:৩১ এএম
ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দাম (বাঁয়ে), ইউপি সদস্য শাহজাহান সিরাজ শাকিল (ডানে)। ছবি : সংগৃহীত

পার্বত্য বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্ত দিয়ে নিয়মিত অবৈধ পথে প্রবেশ করছে গরু। রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি এবং ব্যবসায়ীরা এসব গরু চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত বলে উভিযোগ উঠেছে। আর পাহাড়ে অবস্থান করা ডাকাত দলের পাহারায় এসব গরু সীমান্ত পার করিয়ে পৌঁছে দেওয়া হয় গন্তব্যে। এতে মিলছে কাড়ি কাড়ি নগদ টাকা।

ফলে চোরাচালানে যোগ দিচ্ছেন শ্রমজীবী, বেকারসহ অপরাধীরা। এসব টাকার ভাগ যাচ্ছে শৃংখলা বাহিনীর হাতেও। গরু চোরাচালানের টাকার ভাগকে কেন্দ্র করে পাহাড়ি ডাকাত দলের দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে বাবা ছেলেসহ তিনজন নিহত হয়েছে। এসব ঘটনায় পৃথক মামলা হলেও এখনো গ্রেপ্তার হয়নি কেউ। এতে একদিকে যেমন অপরাধ বাড়ছে, তেমনি সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। সীমান্তে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখতে গরু চোরাচালান বন্ধের পাশাপাশি ডাকাত দলের সদস্যদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন সচেতন মহল।

নিহতরা হলেন- স্থানীয় বাসিন্দা আবু তালেব, জাফর আলম এবং তার ছেলে সেলিম।

তথ্য মতে, মিয়ানমারের ওপার থেকে প্রতিদিন কয়েকশ গরু অবৈধভাবে বাংলাদেশে সরবরাহ করছে চোরাকারবারি দলের সদস্যরা। বান্দবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ফুলতলা, লেবুছড়ি, চাকঢালাসহ কয়েকটি সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে আনা এসব গরু বুঝে দেওয়া হয় গর্জনিয়া পাহাড়ের শীর্ষ ডাকাত ও ডজন মামলার পলাতক আসামি শাহীন গ্রুপকে।

শাহীনের নিজস্ব বাহিনী দিয়ে এসব গরু ফুলতলা, লেবুছড়ি হয়ে ব্যঙডেবা, থোয়াইঙ্গাকাটা, মাঝিরকাটা এবং বড়বিল হয়ে বাইশারি সীমান্ত কিংবা জোয়ারিয়ানালা পর্যন্ত গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া হয়। আবার বাইশারী সীমান্ত দিয়ে কালিরছড়া, ঈদগাঁও পর্যন্ত পৌঁছে দিতে থোয়াইঙ্গাকাটা এলাকার শীর্ষ ডাকাত শাহীন বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড আবছার ডাকাত এবং ঈদগড়ের রুস্তম আলী ডাকাত ওরফে রুস্তম মেম্বার। পরে এসব গরু ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রতিটি গরুর পেছনে ৮-১০ হাজার টাকা পায় ডাকাত দল। যেখানে দিনমজুর থেকে শুরু করে শৃংখলা বাহিনীর সদস্য এবং অন্য স্তরের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়।

অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, এসব গরু চোরাচালানের সঙ্গে ঢাকার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি জড়িত স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তাদের সঙ্গে জেলা থেকে নাম উঠে এসেছে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এসএম সাদ্দাম হোসেন ও তার ভাই আব্দু শুক্কুরের।

প্রথম দিকে সাদ্দামের হয়ে মাঠে কাজ করতেন ছাত্রলীগ নেতা ইমাদ সিকদার, শাকিল আদনান, তারেক উদ্দিন মিশুক। এখন তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন সোহেল সিকদার, শাহজাহান সিরাজ শাকিল ওরফে শাকিল মেম্বার এবং ডাকাত সর্দার শাহীন। ব্যবসায়ী হিসেবে আরও যাদের নাম সামনে এসেছে তারা হলেন, কচ্ছপিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৪নং ওয়ার্ড সদস্য জসিম উদ্দিন, ১নং ওয়ার্ডের সদস্য নজরুল মেম্বার, ৭নং ওয়ার্ডের সদস্য জসিম উদ্দিন, নাইক্ষ্যংছড়ি রূপনগর এলাকার বাসিন্দা ও যুবদল নেতা আনোয়ার ইসলাম রাশেল, গর্জনিয়া বাজার সমিতির সভাপতি এরশাদ উল্লাহ, ইউনিয়ন যুবলীগের সাবেক নেতা জহিরুল ইসলাম, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা ইয়াছিন আরফাত রিশাদ, মাদকের বিভিন্ন মামলার আসামি জহির উদ্দিন, মো. আলী ওরফে মাতালি, নজরুল ইসলাম (তার বিরুদ্ধে মাদক মামলাও রয়েছে)।

অনুসন্ধানে আরও ওঠে আসে, সীমান্ত পারের পর পাহাড়ি যেসব পথ দিয়ে গরু পাচার করা হয় সেখানে রাত জেগে পাহারা বসিয়েছে পুলিশ। থোয়াইঙ্গাকাটা এলাকায় পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করেন কচ্ছপিয়া ইউনিয়ন কৃষকদলের সভাপতি তিতারপাড়া গ্রামের বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন এবং বিএনপি নেতা জাহাঙ্গীর আলম। এ ছাড়া সপ্তাহে যে দুইদিন গর্জনিয়া বাজার বসে সেদিন এসব সোর্সদের নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করেন জামায়াত নেতা বেলাল সিকদার। পুলিশের হয়ে টাকা উত্তোলন করেন সোহেল নামে আরেক যুবক। তার সঙ্গে থাকেন পুলিশ সদস্য আজমির।

গেল রমজানে টাকার ভাগবাটোয়ারা নিয়ে শাহীন বাহিনীর প্রধান শাহীনের সঙ্গে তার সেকেন্ড ইন কমান্ড আবছারের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এরপর আলাদা বাহিনী গড়ে তোলে আবছার। পরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ২৮ রমজান থোয়াইঙ্গাকাটা এলাকায় দুই গ্রুপের মাঝে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে আবছার বাহিনীর সদস্য আবু তালেব নিহত হন। এ ঘটনার পর আবছার ঈদগড় ও আশপাশের চিহ্নিত ডাকাতদের একত্র করে বাড়ান নিজের বাহিনীর আকার।

এরপরই শাহিনী বাহিনীর ওপর প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে আবছার গ্রুপ। এরই জেরে ২১ এপ্রিল রাতে থোয়াইঙ্গাকাটা এলাকায় সশস্ত্র হামলা চালিয়ে শাহীনের বিশ্বস্ত শ্রমিক হিসেবে পরিচিত সেলিমকে কুপিয়ে হত্যা করে আবছার বাহিনী। ওই রাত ১২টার দিকে সেলিম একটি দোকানে আড্ডা দিচ্ছিলেন। এ সময় মুখোশধারী ২৫-৩০ জনের গ্রুপ অতর্কিত হামলা চালিয়ে কুপিয়ে তাকে হত্যা করে। ছেলেকে বাঁচাতে এগিয়ে এলে পিতা জাফর আলমকে গুলি করে হত্যার পর পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।

চোরাচালানে সম্পৃক্ততার বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এসএম সাদ্দাম হোসেন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এসব কাজে আমি কখনো জড়িত নই। এক বছর আগে থেকে আমার নাম ব্যবহার করার বিষয়টি আমি জেনেছি। সে সময় কেউ আমার নাম ব্যবহার করে থাকলে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনকে আগে থেকেই বলা ছিল। সে যদি আমার ভাইও হয়ে থাকে।

তার দাবি, চোরাচালানে আমার অনুসারি যাদের নাম আসছে তারা স্থানীয় এমপিরও অনুসারি।

কচ্চপিয়া ইউপি সদস্য শাহজাহান সিরাজ শাকিল সিকদার ওরফে শাকিল মেম্বার ও যুবলীগ নেতা নাছির উদ্দিন সোহেল সিকদার তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, হয়তো কেউ কেউ আমাদের নাম ব্যবহার করে থাকতে পারে। অথচ আমরাই অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যাচ্ছি।

গরু চোরাচালানে জড়িত নয় দাবি করলেও নিজেকে গাছ ব্যবসায়ী বলে দাবি করেছেন শাকিল মেম্বার।

পুলিশের অভিযান শুরুর পর মোবাইল ফোন বন্ধ রাখায় শাহীন বাহিনীর প্রধান শাহীনের এবং আবছার বাহিনীর প্রধান আবছারের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

এসব ঘটনার বিষয়ে জানতে গর্জনিয়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের আইসি সাইফুল ইসলামকে ফোন করা হলে তিনি অভিযানে আছেন উল্লেখ করে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

রামু থানার ওসি আবু তাহের দেওয়ান বলেন, বাবা-ছেলে হত্যার ঘটনায় আবছার ও জাহাঙ্গীর নামে দু’জন ডাকাতের নামে উল্লেখ করে ২০-২৫ জনকে অজ্ঞাত দিয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন নিহত জাফরের ছেলে রুম্মান উল্লাহ। অভিযুক্তদের ধরতে অভিযান চলছে।

পাশাপাশি চোরাচালানিদের কাছ থেকে গরু প্রতি টাকা পাওয়ার বিষয় অস্বীকার করে ওসি বলেন, পাচারকারীদের সহযোগিতার প্রশ্নই আসে না। পুলিশের নামে কেউ টাকা নেওয়ার কথা বললে তা অপপ্রচার ছাড়া কিছু নয়।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, সীমান্তে পুলিশের কোনো কাজ নেই। তারপরও পুলিশের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আর অপরাধীদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

মৌজন্যে: দৈনিক কালবেলা

পাঠকের মতামত

বদির কাছে হারলেন স্ত্রী

কক্সবাজার ৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের সংসদ সদস্য শাহিন আক্তারকে ৩ ভোটে পরাজিত করে উখিয়ার মরিচ্যা পালং ...