
উখিয়া নিউজ ডটকম::
আজ ২০ জুন আন্তর্জাতিক শরণার্থী দিবস। বিশ্বেরর অন্য দেশের মতো বাংলাদেশও যখন দিবসটি পালন হচ্ছে তখন নতুন পুরাতন মিলিয়ে এদেশে রোহিঙ্গা শরনার্থীর সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৬ লাখেরও বেশি। বলা চলে-নানা ইস্যুতে রোহিঙ্গারা শুধু বাংলাদেশে এসেই চলেছে কিন্তু আগে থেকেই এখানে যারা অবস্থান করছে তাদের কেউ মিয়ানমারে ফিরে যাচ্ছে না।
অভিযোগ আছে, মানবিকতার দোহাই দিয়ে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা এখানকার সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং চারপাশের পরিবেশকে করে তুলেছে কলুষিত। তাদের এমন আচরণে বিব্রত স্থানীয়রাও।
এদিকে মিয়ানমারের আর্মি ক্যাম্পে সন্ত্রাসী হামলার পর উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে এদেশে আশ্রয় নেয়া লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা স্বদেশে ফিরে যায়নি আর। ক্যাম্প, বন, ও রাস্তার ধারে একচালা ঘর করে থাকছে তারা গাদাগাদি করে। নতুনরা জীবিকা নির্বাহ করছে ভিক্ষাবৃত্তি আর মজুরি খেটে।
আবার পুরনোদের অনেকেই লিপ্ত হচ্ছে নানা ধরণের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। গত বছরের ১৩ মে টেকনাফের মোছনী ক্যাম্পে আনসার ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে লুট করা হয় ১১টি অস্ত্র এবং খুন হয় ক্যাম্প কমান্ডার আলী হোসেন। প্রমাণিত হয় হামলাকারীদের সবাই প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের নাগরিক। এছাড়া কুতুপালং, নয়াপাড়া, মোছনী ও লেদা শরণার্থী ক্যাম্পসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় ছিটিয়ে থাকা ৫ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে খুন, ডাকাতি, মাদক, যৌন ব্যবসা এবং চুরি-ছিনতাই দখলবাজিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগও বিদ্যমান হরহামেশা।
জানা যায়, শরণার্থী রয়েছে এমন দেশের তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম। দীর্ঘ দুই যুগ ধরে কক্সবাজারের কয়েকটি এলাকা শরণার্থীর ভারে জর্জরিত হয়ে আছে। উখিয়ার কুতুপালং ও টেকনাফের নয়াপাড়ার দুটি শরণার্থী শিবিরে প্রায় ৩১ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গার পাশাপাশি শিবিরগুলো লাগোয়া পাহাড়ে ঝুঁপড়ি বেধে বসবাস করছে নতুন আসা আরো লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। শরণার্থী না হয়েও শরণার্থীর মতো থাকা বিশাল সংখ্যায় এই রোহিঙ্গারা এখন কক্সবাজারে জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অপরদিকে মানবিক দিক বিবেচনা করে প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে আসা কক্সবাজারের সীমান্ত এলাকায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ এখন দীর্ঘমেয়াদী সংকটের মুখোমুখি। প্রায় ১৭ কোটি বাংলাদেশী নাগরিকদের মধ্যে কক্সবাজারসহ আশপাশের জেলায় বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে প্রায় আট লাখের অধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী বছরের পর বছর ধরে অবস্থান করছে।
মিয়ানমার ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বন্ধ করে দিয়েছে। সেই সময় থেকেই মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকগুলোতে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়টি আলোচনা করে আসছে। মিয়ানমার বরাবরই ইতিবাচক আশ্বাস দিলেও গত দুই যুগ ধরে একজন রোহিঙ্গা শরণার্থীকেও ফিরিয়ে নেয়নি দেশটি। তবে ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে ঢাকায় পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে দুই মাসের মধ্যে নাগরিকত্ব নিশ্চিত হওয়া দুই হাজার ৪১৫ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ফিরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরুর আশ্বাস দিয়েছিলো। কিন্তু এর দেড় বছর অতিবাহিত হলেও এ প্রক্রিয়া শুরু হয়নি।
কক্সবাজারস্থ শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন অফিসের তথ্যমতে, নিবন্ধিত ২ লাখ ৫০ হাজার ৮৭৭ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীর মধ্যে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জনকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করা হয়। সে অনুযায়ী অবশিষ্ট নিবন্ধিত শরণার্থী থাকার কথা ১৪ হাজার ২৭৮ জন। অথচ সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী কক্সবাজারে উখিয়ার কুতুপালং ও টেকনাফে নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরে তালিকাভুক্ত শরণার্থীর সংখ্যা ৩১ হাজার ২৯৮ জন। তার মধ্যে কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে ২ হাজার ৬৩৫ পরিবারে ১৩ হাজার ১৫১ জন ও নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরে ৩ হাজার ৩৮৫ পরিবারে ১৮ হাজার ১৪৭ জন শরণার্থী রয়েছে।
জানা গেছে, তালিকাভুক্ত শরণার্থীর বাইরে কুতুপালংয়ে প্রায় ৫০ হাজার, নয়া পাড়ায় প্রায় ২০ হাজার এবং আশপাশে আরও ৬ হাজারের মতো অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। এছাড়াও কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, চট্টগ্রাম জেলাসহ বিভিন্ন স্থানে আরও প্রায় ছয় লক্ষাধিক অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা রয়েছে।
রোহিঙ্গা শরণার্থী অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন সংগ্রাম পরিষদ আহবায়ক অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে চট্টগ্রাম অঞ্চল বর্তমানে সামগ্রিক নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন। ইতিমধ্যে তাদের কারণে সারাদেশে উগ্র জঙ্গি তৎপরতা, ইয়াবা ও মানবপাচারসহ নানা অপরাধ ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এসব প্রতিরোধে স্থানীয়ভাবে জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ সরকার এর বোধগম্য করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের দাবি অবিলম্বে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধে সীমান্ত সীল করা। রোহিঙ্গাদের মানবতার নামে অনুপ্রবেশে উৎসাহ প্রদানকারী কতিপয় দেশী বিদেশী এনজিও এবং ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া। তিনি বলেন, বৈধ-অবৈধ মিলে কক্সবাজার, চটগ্রাম ও বান্দরবানসহ আশপাশের জেলাগুলোতে প্রায় আট লাখের বেশি রোহিঙ্গা রয়েছে। এসব রোহিঙ্গাদের কারণে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতিসহ নানা সমস্যা-সংকটের সৃষ্টি হচ্ছে। গত বছর নয়াপাড়া আনসার ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে ১১টি রাইফেল লুট ও এক আনসারকে হত্যার ঘটনায় রোহিঙ্গা জড়িত রয়েছে।
আইওএম সূত্র জানায়, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো দরকার। তা না হলে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান কোনো দিনও হবে না।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত) কাজি আব্দুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যাকে সরকার বেশ গুরুত্বসহকারে দেখছে। বর্তমান সরকার দ্বি-পাক্ষিক ভিত্তিতে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কার্যক্রম আবারও শুরু করবে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসের জন্য সরকারের সাথে জাতিসংঘ দায়িত্ব পালন করছে। এখনও পর্যন্ত মিয়ানমার সরকার এ ব্যাপারে তেমন কোনো মতামত দিচ্ছে না। যদি তাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার সরকার মতামত দেয় তাহলে দ্রুতই প্রত্যাবাসন করা হবে।
প্রসঙ্গত, ১৯৯২ সালের শুরুর দিকে মিয়ানমারে তৎকালিন সামরিক জান্তা সরকারের অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়ে ২ লাখ ৫২ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল। পরবর্তীতে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের মধ্যস্থতায় ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জন শরণার্থী স্বদেশে ফিরে গেলেও মিয়ানমার সরকারের ছাড়পত্র না দেয়ার কারণে আরও ২৫ হাজার শরণাথী স্বদেশে ফেরত যায়নি। সর্বশেষ ২০০৫ সালের জুলাই মাসে এক পরিবারে দুইজন রোহিঙ্গা শরণার্থী স্বদেশে ফেরত গিয়েছিল। তখন থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন বন্ধ রয়েছে।
পাঠকের মতামত