জসিম উদ্দিন টিপু, টেকনাফ
প্রকাশিত: ২২/১০/২০২৫ ১১:০০ এএম

প্রশাসনিক কড়াকড়ির মাঝেও টেকনাফ সীমান্তের কচ্ছপিয়া উপকুল দিয়ে মানবপাচার অব্যাহত রেখেছে পাচারকারী চক্রে। মানবপাচারকারীদের জিম্মিদশা থেকে আবারো ৬জন লোককে মুক্ত এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে। এভাবে প্রতিনিয়ত যৌথ অভিযানে ভিকটিম উদ্ধার, অস্ত্র আটকের পাশপাশি দালালদের সহযোগী আটক হলেও প্রকৃত দালালরা অধরা থেকে যাওয়ায় টেকনাফ উপকুল দিয়ে মানবপাচার ঠিকই নিরবে নিভৃতে চলছে বলে জানাগেছে।
২১ অক্টোবর (মঙ্গলবার) ভোরে ২বিজিবির অধিনায়কের নেতৃত্বে বিজিবির বিশেষ একটি টীম মাদকপাচারকারীদের ডেরায় দু:সাহসিক অভিযান চালিয়েছে। অভিযানে ৬জন জিম্মি মুক্ত করা হয়েছে। মানবপাচারকারীদের আস্তানা গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এসময় তাদের আস্তানা থেকে বিজিবি বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করেছেন। দীর্ঘ ৬ঘন্টা ব্যাপী চলা ওই অভিযানে করাচিপাড়া এলাকার মোহাম্মদ হোছনের পুত্র মো: রুবেল নামীয় দালালদের এক সহযোগী আটক করতে সক্ষম হয় বিজিবি। পরে আটক দালালদের সহযোগী রুবেল এবং জিম্মি থেকে মুক্ত হওয়া ভিকটিমদের দেওয়া তথ্য মতে ৮জন চিহ্নিত মানবপাচারকারীকে পলাতক আসামী করে মামলা দায়ের করেছে বিজিবি।
এদিকে টেকনাফের কচ্ছপিয়া ও করাচিপাড়া উপকুলের বঙ্গোপসাগর দিয়ে মালয়েশিয়ায় মানবপাচারের অঘোষিত ট্রানজিট ঘাট রয়েছে। ওই ঘাট দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সময়ে সুযোগে মানবপাচার করছেন কয়েকটি দালাল চক্র। কচ্ছপিয়া ও করাচিপাড়া উপকুলে মানবপাচার চক্রের বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট রয়েছে। সিন্ডিকেটের সবাই কচ্ছপিয়া ও করাচিপাড়া এলাকা এবং আশেপাশের গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা। কচ্ছপিয়া ও করাচিপাড়া উপকুলে মানবপাচার সিন্ডিকেটে অন্তত অর্ধশত সক্রিয় দালাল রয়েছেন। তারা কলা কৌশলে সাগরপথে ট্রলারে করে নারী-পুরুষ ও শিশুদের মালয়েশিয়ায় পাচার করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে মানবপাচারে জড়িত দালাল চক্রের এক সদস্য এই প্রতিবেদককের কাছে স্বীকার করেছেন, পাচারের টার্গেট কেবল রোহিঙ্গা। তারা শুধু রোহিঙ্গাদের সাগরপথে মালয়েশিয়া পাঠায়। মালয়েশিয়ায় অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের স্ত্রী এবং স্বজনদের পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। যারা স্বেচ্ছায় মালয়েশিয়ায় যাচ্ছে; তাদেরকে পাহাড়ের চুড়াতে নিরাপদ আস্তনায় রাখা হয়। সুযোগ বুঝে আস্তনায় অবস্থান করা লোকদের সহি সালামতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন তারা। কাউকে জোর করে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় পাঠান না দাবী করে দালাল চক্রের ওই সদস্য স্বেচ্ছায় এবং অলিখিত চুক্তির আওতায় আর্থিক লেনদেনের ভিত্তিতে কেবল তাদেরকে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন বলে স্বীকার করেছেন।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, গত ১৮ ও ২১ সেপ্টেম্ব বিজিবি কোষ্টগার্ড ও র‌্যাবের সমন্বয়ে কচ্ছপিয়া উপকুলের দুর্গম পাহাড়ে অভিযান পরিচালনা করা হয়। যৌথ বাহিনী দুর্গম পাহাড়ে মানবপাচারকারীদের আস্তনা ও বন্দিশালায় হানা দেয়। এসময় যৌথ বাহিনী পাহাড়ের দুর্গম আস্তনায় পৃথক অভিযান চালিয়ে মালয়েশিয়ায় পাচারের উদ্দেশ্যে বন্দি থাকা নারী শিশুসহ ১শ ৫০জন ভিকটিমকে উদ্ধার করেন। অভিযানকালে ৩অপহরণকারীকে আটক করা হয়েছে বলে যৌথব বাহিনী সুত্রে জানাগেছে। এসময় দুর্গম পাহাড়ে মানবপাচারকারীদের আস্তনা থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনাও ঘটেছে।
পরবর্তীতে ২২ সেপ্টেম্বর আবারো অভিযান চালিয়ে কচ্ছপিয়া এলাকা থেকে ৫ভিকটিমকে উদ্ধার করেন কোষ্টগার্ড। উদ্ধার হওয়া ভিকটিমের দেওয়া তথ্য মতে পরের দিন (২৩ সেপ্টেম্বর) সকালে কচ্ছপিয়ায় অভিযান চালিয়ে ২অপরহণকারীকে আটক করা হয়।
সপ্তাহের শুরুতে কচ্ছপিয়া ও রাজারছড়ার দুর্গম পাহাড়ে মানবপাচারকারীদের আস্তনা এবং বন্দিশালায় যৌথ বাহিনীর ব্যাপক অভিযানের পরও কচ্ছপিয়া উপকুল থেকে ২দিন পর কোষ্টগার্ড কর্তৃক ভিকটিম উদ্ধার এবং অপহরণকারী আটকের ঘটনায় আবারো নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃংখলা বাহিনী।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, উপকুলীয় বাহারছড়া ৮নং ওয়ার্ডের কচ্ছপিয়া এলাকার বাদশা মিয়া ও খুরশিদা বেগমের পুত্র জসিম উদ্দিন(২৭) ওরফে জসিম সওদাগর, তার মামা মৃত ছৈয়দ আলী ও আশেক বানুর পুত্র আব্দুর রকিম(৩৮), মৃত আব্দুর রশিদ ও মৃত ছৈয়দুন্নিছার পুত্র ও স্থানীয় মহিলা মেম্বার খালেদা বেগমের স্বামী আব্দুল গফুর(৩৫), আব্দুল গফুর ও নুর হাবার পুত্র রিদুয়ান(২৭), দিলদার মিয়া(৩০), মৃত আব্দুল আজিজ ও মেহেরুন্নিছার পুত্র বুজরুজ মিয়া(৪৫), ছৈয়দ আহমদ ও নুরুন্নাহারের পুত্র মো: রফিক(২৮), মৃত শমসু মিয়া ও রাহামা খাতুনের পুত্র মোহাম্মদ রফিক(২৭), নুর হোছাইন ও মোস্তফা খাতুনের পুত্র কেফায়ত উল্লাহ(২৩), আয়াত উল্লাহ(২৪), আব্দুল গফুর ও রওশন জামানের পুত্র আব্দুল্লাহ(১৮), আলী আজম(২৩), আব্দুর রহিম ও আনজু আরার পুত্র ছৈয়দ নুর(২১), ছৈয়দ ওমর ও দয়াবানুর পুত্র আব্দুল করিম(৪৫), ফরিদ আহমদ ও হাজেরা খাতুনের পুত্র মোজাম্মেল(১৯), হুমায়ুন(১৮), মৌলভী নুর মোহাম্মদ ও সানজিদা খাতুনের পুত্র শহিদ(২০), ছৈয়দ ওমর ও দয়াবানুর পুত্র আব্দুল মতলব(২৭), কালা মিয়া ও লাল বানুর পুত্র আব্দুল মাবুদ(৫৫), বশির আহমদ ও মৃত রশিদা বেগমের পুত্র মুজিব উল্লাহ(২৫), নুর কবির ও নুর বানুর পুত্র হেলাল উদ্দিন(২৭), বেলাল উদ্দিন(২৫), জাফর আলমের পুত্র জয়নাল(২২), নবী হোছনের পুত্র হামিদ উল্লাহ(১৯), মৃত চাঁন্দ মিয়া ও জরিনা খাতুনের পুত্র শাহজাহান(২৬), ওমর আকবরের পুত্র রশিদ মিয়া(২০), চাঁন্দ মিয়ার পুত্র ওমর আকবর(৬০), আলী আকবরের পুত্র আব্দুল গফুর(২২), মৃত ওসমান গণি ও হাকিমুন্নিসার পুত্র আলী আকবর(৫৮), আব্দুল জাব্বারের পুত্র ছেবর মিয়া(২৩), রশিদ মিয়া(২৫), মৃত কবির আহমদের পুত্র ছৈয়দুল হক(৪২), জাকের আহমদের পুত্র নুরুল আমিন(২৭), মো: ইলিয়াছ ও নুর বেগমের পুত্র মো: রফিক(২৮), মো: রুবেল(২৪), মো: সোহেল(২৩), মৃত নজির আহমদ ও মৃত কালা বানুর পুত্র মো: ইলিয়াছ(৬০),আব্দুর রশিদ ও তাজল বেগমের পুত্র জাহিদুল ইসলাম হ্রদয়(১৮), নুরুল ইসলাম ও খালেদা বেগমের পুত্র আনোয়ারুল ইসলাম(৩০), মৃত গুরা চান্দ ও সুরুত জামালের মো: ইউনুছ(৩৫), মো: তৈয়ব(৩৪),মৃত শামসুল আলমের পুত্র মো: রফিক(২২), আব্দুস শুক্কুরের পুত্র রাসেল(২৫), বুজরুজ মিয়ার পুত্র আব্দুল্লাহ(১৯),আব্দুস সালাম ও খতিজা বেগমের পুত্র মো: ইউনুছ(৩৫) কোন না কোনভাবে মানবপাচারে জড়িত থাকার খবর পাওয়া গেছে। কচ্ছপিয়া উপকুল দিয়ে মানবপাচার শুরু হওয়ার পর থেকে উল্লেখিত ব্যাক্তিদের অনেকের বিরুদ্ধে মানবপাচার মামলা হয়েছে। তাদের অনেকে আটক হয়ে জেল ফেরত হয়েছেন। ফিরে এসে আবারো চিরচেনা লাভজনক ব্যবসা মানবপাচারে জড়িয়ে পড়েছেন। উপকুলের কচ্ছপিয়াসহ আশেপাশের গ্রামের লোকজনও মানবপাচারে জড়িয়ে পড়েছেন। বাহারছড়া এলাকা ও টেকনাফ সদরের বেশ কয়েকজন জনপ্রতিনিধিও মানবপাচার চক্রের সাথে জড়িত থাকার খবর পাওয়া গেছে। কচ্ছপিয়া এলাকায় প্রায় সময় আইন শৃংখলা বাহিনীর নাম দিয়ে দালালদের কাছ থেকে মাসোহারা উত্তোলনের কথা লোকেমুখে শুনা গেছে।
পাচারে জড়িত লোকদের সাথে কথা বলে জানাগেছে, আগষ্ট মাসের শুরু থেকে জানুয়ারী মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সাগরপথ দিয়ে মালয়েশিয়ায় মানবপাচার করা হয়। চলতি সপ্তাহে প্রশাসনিক কঠোরতার কারণে কচ্ছপিয়া সীমান্তের মানবপাচারকারীরা রুট পরিবর্তনের কথা ভাবছেন। টেকনাফের সচেতন মহলের মতে, কচ্ছপিয়া সীমান্ত দিয়ে সাগরপথে মানবপাচার ঠেকিয়ে দিতে পাচারে জড়িত ওই সীমান্তে সক্রিয় অর্ধশত দালাল ও তাদের সহায়তাকারী সংশ্লিষ্ট সকলকে আইনের আওতায় আসতে হবে। তাহলে পরে কচ্ছপিয়া উপকুল দিয়ে সাগরপথে মানবপাচার শুন্যের কোটায় নিয়ে আসা সম্ভব বলে মনে করছেন তারা।

মানবপাচার চক্রের সদস্যের আটকের বিষয়ে টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু জায়েদ মুহাম্মদ নাজমুন নুর বলেন, মানবপাচারে জড়িত সে যেই হোক না কেন? তাকে অবশ্যই অবশ্যই আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। এছাড়া মানবপাচারকারীসহ যাবতীয় অপরাধীদের ধরতে পুলিশী অভিযান অব্যাহত আছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

জানতে চাইলে টেকনাফস্থ ২বিজিবির অধিনায়ক লে: কর্ণেল আশিকুর রহমান বলেন, দুর্গম পাহাড়ে মানবপাচারকারীদের ডেরায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। এসময় তাদের হাতে জিম্মি ৬জন ভিকটিমকে মুক্ত করার পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। পাহাড়ে গড়ে তোলা তাদের আস্তানা টোটালি গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। মাদক এবং মানবপাচারের অভিশাপ থেকে দেশ এবং জাতিকে বাঁচাতে বিজিবি দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, অপরাধীদের জন্য দেশের এক ইঞ্চি জমিও নিরাপদ নয় বলে কঠোর বার্তা জানিয়ে দেন।

পাঠকের মতামত

রোহিঙ্গাদের জন্য ১১.২ মিলিয়ন ডলারের এলপিজি সহায়তা দেবে যুক্তরাজ্য-কাতার

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) সরবরাহে ১১.২ মিলিয়ন ডলার তহবিলের যৌথ ঘোষণা দিয়েছে ...

পেশিশক্তির হুমকিকে ভয় পায় না উখিয়া–টেকনাফের যুব সমাজ—মুহাম্মদ শাহজাহান

উখিয়া–টেকনাফে পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে উঠেছে তরুণরা—এমন দাবি রেখেই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ...

মাছকারিয়া বিলে বনবিভাগের অভিযান: ৩ হাজার কৃত্রিম বক ও শতাধিক ফাঁদ নষ্ট

কক্সবাজারের উখিয়ার মাছকারিয়া বিল এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অবৈধ শিকার সরঞ্জাম ধ্বংস করেছে বনবিভাগ। ...

এসএসএফ সুবিধা জিয়া পরিবারের অন্য সদস্যদের নয়, উপদেষ্টার বক্তব্যের উদ্বেগ প্রকাশ শাহজাহান চৌধুরীর

এসএসএফ সুবিধা পাবেন শুধুমাত্র খালেদা জিয়া, পরিবারের অন্য সদস্য নয়, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রেজওয়ানা হাসানের ...