প্রকাশিত: ২০/০৭/২০১৭ ৮:০৬ পিএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ৪:৩১ পিএম

বিশেষ প্রতিবেদক::
ইয়াবা উদ্ধার নিয়ে গত ২০ দিন ধরে সেন্টমার্টিন জুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হলেও মুখ খুলেননি সেন্টমার্টিন পুলিশ ফাঁড়ি। জুলাই মাসের শুরুর দিকে সেন্টমার্টিন দক্ষিণ পাড়ার আব্দু শুক্কুরের ছেলে নুরুল হকের ফিশিং বোটে করে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা ঢুকেছে এমন খবরে সাধারণ মানুষের মাঝে নানান আলোচনা – সমালোচনার জন্মদিলেও নিরব ছিল স্থানীয় প্রশাসন। আর এইসব ইয়াবা কব্জায় রাখার নেপথ্যে কাজ করছেন ঐ এলাকার ইউপি সদস্য আব্দুর রউফ। ফিশিং বোটের মালিক নুরুল হক সম্পর্কে আব্দুর রউফের ভায়রা। জানা যায়, গত ৬ জুলাই সেন্টমার্টিন কোস্ট গার্ডের কাছে ৩০ হাজার ইয়াবা জমা দেন ইউপি সদস্য আব্দুর রউফ।

আরোও জানা যায়, পরের দিন ৭ জুলাই সেন্টমার্টিন পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা ইয়াবা উদ্ধারে অভিযানে যান দক্ষিণ পাড়ায়। অভিযানে আব্দুর রউফের ভায়রা নুরুল হকের বাড়ি থেকে ৫০ হাজার ইয়াবাসহ একজনকে আটক করে পুলিশ। পরে পুলিশ সদস্যরা আব্দুর রউফ মেম্বারের কাছ থেকে ৫০ হাজার ইয়াবা ও সত্তর হাজার টাকা নিয়ে কাউকে গ্রেফতার না করে ফিরে আসেন। ইয়াবা উদ্ধারের বিষয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ কৃষ্ণ দাশের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি অভিযানের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, “অভিযানে গিয়েছিলাম কিন্তু কোনকিছু পাওয়া যায়নি”। পুলিশের এমন রহস্যজনক আচরণে হতাশ হয়েছেন সেন্টমার্টিন দ্বীপের সচেতন মহল। কিন্তু গত ১৭ জুলাই সোমবার সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের মাসিক আইন শৃঙ্খলা সভায় সেন্টমার্টিন বিডি নিউজের সম্পাদক ও বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন সেন্টমার্টিন পর্যটন শাখার সভাপতি কেফায়েত উল্লাহ ইয়াবা উদ্ধারের বিষয়টি তুলে ধরলে ইয়াবা উদ্ধারের সত্যতা স্বীকার করেন পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ কৃষ্ণ দাশ। সভায় কৃষ্ণ দাশ ঐ দিনের অভিযানে ৫০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছিল বলে স্বীকার করেন। এদিকে তার এই স্বীকারোক্তিতে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন ছাত্রসমাজ ও এলাকাবাসী। এলাকার সচেতন মহল এই ইয়াবার পেছনে যে বা যারা জড়িত তাদের দ্রুত গ্রেফতারের পাশাপাশি ঐ এলাকায় আবারো অভিযান পরিচালনার দাবি জানান এবং প্রয়োজনে ইউপি সদস্য আব্দুর রউফের বাড়িও চেকিং করার দাবি জানান তারা।

পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকায় সাগর পাড়ের বালি উত্তোলন, ভূগর্ভস্থের পাথর উত্তোলন, সমুদ্র থেকে পাথর উত্তোলন, কেয়াবন উজাড়, সাগর পাড়ের পাথর থেকে কংক্রিট তৈরি, বীচ পাড়ের পাথর দিয়ে বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও বহুতল ভবন নির্মাণ ইত্যাদি সাধারণের জন্য সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ হলেও পশ্চিম পাড়ার আব্দুল জলিলের ছেলে ৯ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুর রউফের কালো টাকার প্রভাবে প্রশাসনের সহযোগীতায় তার (আব্দুর রউফ) জন্য বৈধ বলে অভিযোগ করেন ঐ ছাত্র। তিনি বলেন, বর্তমানে তার অবৈধ কার্যকলাপের মাত্রা এতই বেড়ে চলছে যে দ্বীপবাসী রীতিমতো অসহনীয় হয়ে পড়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রায় সকল অপকর্মের নেপথ্যে কাজ করে আসছেন ইউপি সদস্য আব্দুর রউফ ও তার সহযোগীরা। ইয়াবা, মানব পাচার, বালি ও পাথর উত্তোলন কোনকিছুতেই পিছে নেই ঐ ইউপি সদস্য। সিজন কিংবা আন-সিজনে আব্দুর রউফ মায়েনমার থেকে ট্রলারে করে ইয়াবা এনে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠাই। যার পেছনে কাজ করছেন তার ভাই ৫ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবু বক্কর ছিদ্দিকসহ তার অনুসারীরা। দক্ষিণ পাড়ার প্রায় প্রতিটি পরিবারকে সুদেআসলে টাকা দিয়েছেন আব্দুর রউফ। তার এই সুদের টাকার পরিমাণ কয়েক-কোটি টাকা বলে বলে জানা যায়। ইয়াবার বর্তমান চালানের বেশিভাগ অংশ এখনো আব্দুর রউফের কব্জায় আছে বলে দাবি করেন এলাকাবাসী।
অনুসন্ধানে আরোও জানা যায়, প্রায় একযুগ আগে আব্দুর রউফ পশ্চিম পাড়া থেকে পেটের দায়ে দক্ষিণ পাড়া পাড়ি জমায়। সেন্টমার্টিনের মূল ভূ-খন্ড থেকে দক্ষিণ পাড়া দূরবর্তী হওয়ায় আব্দুর রউফ সেখানে একটি লাঠিয়াল বাহিনী গঠন করেন। ২০১১ সালের ইউপি নির্বাচনে কালো টাকা ও লাঠিয়াল বাহিনীর প্রভাবে ৯ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয় আব্দুর রউফ। জানা যায়, বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে বর্তমানে সে নিজেকে ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের প্রভাবশালী নেতা বলে দাবি করেন যা ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দও জানেনা। বর্তমানে জনপ্রতিনিধির মুখোশের আড়ালে নানা ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করে রাতারাতি শতকোটি টাকার মালিক বনে যান বলে জানান একাধিক ব্যাক্তি, শুধু আব্দুর রউফ নয় তার ছত্রছায়ায় গড়ে উঠা একাধিক সদস্যও কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে এখন পুরো সেন্টমার্টিন দ্বীপ জুড়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার গড়ে তুলতে নানান অপকৌশল নিয়ে এখানকার সাধারণ মানুষের মাঝে আতংক তৈরি করে চলছে। প্রশাসনের পাশাপাশি তার এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডে সহযোগীতা করেন খোদ আব্দুর রউফের বাবা ও ভাইয়েরা। এই বাহিনী দিয়ে সে সকল ধরণের অপকর্ম নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। মানব পাচার, চোরাচালান, বালি উত্তোলন, পাথর উত্তোলন, বন উজাড়, পাথর ভেঙ্গে কংক্রিট তৈরি করে ঢাকার হোটেল মালিকের কাছে বিক্রি, ঢাকার হোটেল মালিকদেরকে হোটেল তৈরি করে দেওয়ার টেন্ডার লওয়া, সাগর পাড়ের পাথর দিয়ে ঢাকার হোটেল মালিকদের বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে দেওয়া, সেন্টমার্টিন থেকে ট্রলার নিয়ে প্রবাল, শৈবাল, শামুক, ঝিনুক, কড়ি ইত্যাদি কক্সবাজার নিয়ে যাওয়া এবং সেখান থেকে সিমেন্ট, রড, টিন, টাইলস ইত্যাদি এনে ঢাকার হোটেল মালিকের কাছে বিক্রি করা তার নিত্যদিনের কাজ। স্বপ্ন বিলাস নামে একটি বহুতল ভবন নির্মাণের সময় পরিবেশ কর্মীরা আব্দুর রউফকে বাঁধা দিলে আব্দুর রউফ বাহিনীর হাতে হামলার শিকার হন পরিবেশ কর্মীরা। এরপ্রেক্ষিতে পরিবেশের পক্ষে আব্দুর রউফ বাহিনীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। যার মামলা নং জিআর-১৬৭/১৩। এই মামলায় আব্দুর রউফসহ তার বাবা আব্দুল জলিল, বড় ভাই ইলিয়াছ, মেজু ভাই সিরাজুল ইসলান, ছোট ভাই আবুবকর ছিদ্দিক, আয়াছ উদ্দিনকে আসামি করা হয়। বর্তমানে এই মামলায় ওয়ারেন্ট ইস্যু হওয়ার পরও প্রকাশ্যে ঘুরাফেরা করছে আসামীরা। চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে স্থানীয় কোষ্টগার্ড কর্তৃক কয়েকবার গণধোলাই খায় আব্দুর রউফ। এই সম্পর্কে স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ীর ইনচার্জ কৃষ্ণ দাশের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “পরিবেশের দায়িলকৃত মামলা সম্পর্কে আমি অবগত নয়”। মানব পাচার, চোরাচালান, বালি উত্তোলন, পাথর উত্তোলন, বনভূমি উজাড় ইত্যাদি বিষয়াদী জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি নতুন এসেছি। এখনো সবকিছু বুঝে উঠতে পারিনি। উল্লেখিত বিষয়াদি যদি সত্য হয় অবশ্যই তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে সম্মতি প্রকাশ করেন কৃষ্ণ দাশ।

সারি সারি বৃক্ষরাজি ও বনভূমি নিয়ে ভরপুর দক্ষিণ পাড়াকে মরুভূমিতে পরিণত করেছেন আব্দুর রউফ বাহিনী। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দক্ষিণ পাড়ার এক মুরব্বী বলেন, আমার এজমালি খতিয়ান ভুক্ত জমিগুলো জোরপূর্বক উজার করে দখল করেছে আব্দুর রউফ ও তার বাহিনী। তার বিরুদ্ধে কিছু বলাও যায়না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দক্ষিণ পাড়ার বাসিন্দা টেকনাফ ডিগ্রী কলেজের এক ছাত্র বলেন, ‘শুধুমাত্র টাকার জন্য এই আব্দুর রউফ গাছে গাছে সারিবদ্ধ দক্ষিণ পাড়া এলাকাকে মরুভূমি বানিয়েছে। একজন মানুষ কতটা মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেললে এরকম নৃশংস কাজ করতে পারে। তাকে সমর্থন দেওয়ার কিছু উচ্চ শ্রেণী ভাল মানুষ দাবিবার লোকদেরও দেখা যায় যা খুবই লজ্জাজনক’।

স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ কৃষ্ণ দাশ বলেন, “৬ জুলাই সেন্টমার্টিন কোস্ট গার্ড কর্তৃক আমাদের পুলিশ ফাঁড়িতে কিছু জব্দকৃত ইয়াবা জমা দেওয়া হয়। পরে ৭ জুলাই ঐ এলাকায় আরোও কিছু ইয়াবা আছে এমন সংবাদে আমরা দক্ষিণ পাড়ার নুরুল হকের বাড়িতে অভিযান চালায়। তার বাড়ির পিছনে ৫ টি ইয়াবার কার্ড পাই। এবং আমরা তা টেকনাফ থানায় পাঠিয়ে দিই। বাড়িতে কেউ না থাকায় কাউকে গ্রেফতার করতে পারনি বলে জানান পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ কৃষ্ণ দাশ। জানা যায়, আব্দুর রউফ ও তার বাহিনীর হিংস্রথাবার ভয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিও তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারেননা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ইউপি সদস্য বলেন, টেকনাফের এক বিশেষ ব্যক্তির ক্ষমতাবলে আব্দুর রউফ তার বাহিনী দিয়ে এসব অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। সে এলাকায় কাউকে পরোয়া করেনা। এই সম্পর্কে অভিযুক্ত আব্দুর রউফের সাথে যোগাযোগ করা হলে সে তার বিরুদ্ধে আনিত সব অভিযোগ হাস্যকর বলে উড়িয়ে দেন এবং ব্যঙ্গ করে সাক্ষী প্রমাণের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ছাত্র বলেন, আব্দুর রউফ যেভাবে দ্বীপটা গিলে খাচ্ছে সত্যিই খুব ভয় হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে কোন প্রতিনিধি কথা বলেনা এটা খুবই দুঃখজনক। দ্রুত তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নিলে দ্বীপের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। উল্লেখিত বিষয়াদি সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করে আব্দুর রউফ ও তার বাহিনীর আক্রোশে জরাজীর্ণ প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনকে রক্ষার্থে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহবান জানান স্থানীয় সচেতন মহল।
সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সেক্টরের বক্তব্যসহ পরবর্তী প্রতিবেদনে চোখ রাখুন!
চলবে….

পাঠকের মতামত