প্রকাশিত: ২৭/০৯/২০১৭ ৯:৩৩ পিএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ১২:৫৯ পিএম

উখিয়া নিউজ ডেস্ক::
মিয়ানমারের রাখাইনের সহিংসতা কবলিত এলাকাগুলোর একটি মংডু। এই শহরের উত্তর দিকে প্রধান সড়কের ৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত গ্রামগুলোতে বসবাস ছিল কয়েক হাজার মানুষের। তবে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ক্লিয়ারেন্স অপারেশনে সবগুলো গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেনাদের তাণ্ডবের ভয়াবহতায় পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ৪ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা। এখনও যারা পালিয়ে যেতে পারেনি; সেনাদের ভয়ে তাদের বনজঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। সেখানে ঘাস আর পানি খেয়ে তাদের মানবেতর জীবনযাপনের চিত্র উঠে এসেছে রয়টার্সের প্রতিবেদনে।

২০১৬ সালের অক্টোবরে সামরিক অভিযানের সময় ইউ শেই কিয়া গ্রামের রোহিঙ্গারা সেনাসদস্যদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ তোলে। এবারও সেনাদের তাণ্ডবের শিকার হয়েছেন গ্রামটির বাসিন্দারা। ওই গ্রামের একজন শিক্ষক রয়টার্সকে বলেছেন, “৮০০টি পরিবারের মধ্যে এখন আছে মাত্র ১০০টির মতো পরিবার। যারা রয়ে গেছে তাদেরকে সেনাদের সঙ্গে লুকোচুরি করে থাকতে হচ্ছে। কারণ সেনারা সকালে গ্রামে আসে। সেনারা গ্রামে আসলে তারা জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ে এবং রাতে বাড়িতে ফিরে আসে।”

এই শিক্ষক বলেন, “আজ সন্ধ্যায় খাওয়ার মতো কোনও খাবার নেই আমাদের। কী করার আছে? আমরা জঙ্গলের কাছাকাছি থাকি। সেখানে অনেক ঘাস রয়েছে; যা আমরা খাচ্ছি। এরপর একটু পানি সংগ্রহ করে পান করছি। এভাবেই বেঁচে আছি আমরা।” সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা না বলার সরকারি নির্দেশনা থাকায় ওই শিক্ষকের নাম প্রকাশ করেনি রয়টার্স।

সেনাদের পুড়িয়ে দেওয়া রোহিঙ্গা বসতবাড়িগুলোতে সৃষ্ট বিরাণভূমিতে দেখা গেছে, সেখানে কয়েকশ গরু চষে বেড়াচ্ছে। জমিতে রোপণ করা ধানের চারা খাচ্ছে। ক্ষুধার্ত কুকুরগুলো ছোট ছোট ছাগল খাচ্ছে। এক সময় রোহিঙ্গা মুসলিমদের পদচারণায় মুখর স্থানীয় মসজিদ, বাজার ও স্কুল এখন একেবারে নীরব।

রাখাইনের উত্তররাঞ্চলে সেনাবাহিনীর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এরমধ্যেই সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে রয়টার্সের পক্ষ থেকে স্বতন্ত্রভাবে সহিংসতাকবলিত অঞ্চলটিতে সরেজমিন প্রত্যক্ষ করা হয়। কোনও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের পক্ষে রাখাইনে এটিই প্রথম সরেজমিন প্রতিবেদন। এই সহিংসতাকবলিত অঞ্চলে জাতিসংঘ মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনযজ্ঞের অভিযোগ তুলেছে।

রয়টার্সের প্রতিনিধিরা উত্তর রাখাইনের মংডু, বুথিয়াডাউং ও রাথেডাউং এলাকায় দুবার গিয়েছেন। তারা মংডু থেকে সবচেয়ে বেশি সহিংসতাকবলিত এলাকা কিয়েইন চাউং এলাকায় সড়ক পথে গাড়ি চালিয়ে গেছেন। প্রতিনিধিরা স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে খুব কম কথা বলেছেন। কারণ বহিরাগত কারও সঙ্গে কথা বলতে তারা ভয় পাচ্ছে। বেশিরভাগ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে ফোনে সেই এলাকাগুলোতে যেখানে সেনাবাহিনীর অভিযান চলছে না।

২৫ আগস্ট শুরু হওয়া সহিংসতায় প্রায় হাজারখানেক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। আর রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে ৪ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি ৩০টি পুলিশ ফাঁড়ি ও একটি সামরিক ঘাঁটিতে হামলার পর ভয়াবহ ও নৃশংস সামরিক অভিযান শুরু করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। অভিযানে অংশ নেওয়া সেনাসদস্যদের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

রয়টার্সের প্রতিনিধি মংডু’র উত্তরে ইয়ে খাট চাউং গয়া সন গ্রামটি পরিদর্শন করেন। গ্রামটির বাসিন্দা সুয়াইদ ইসলাম (৩২) এখন বাংলাদেশের কক্সবাজারে একটি রোহিঙ্গা শিবিরে রয়েছেন। টেলিফোনে তিনি রয়টার্সকে বলেন, সেনাবাহিনী ও পুলিশ আমাদের খুঁজে পেলে গুলি করতে পারে বলে আমরা আতঙ্কিত। তাই আমরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছি।

সুয়াইদ ইসলামের গ্রামের বাসিন্দারা রয়টার্সকে জানান, ২০১৬ সালে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযানের সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। যারা পালিয়ে যেতে পারেনি তারা অস্থায়ী কুঁড়েঘরে থাকছে। ত্রাণ সংস্থাগুলোর দেওয়া খাবার খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে।

নিউ ইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) স্যাটেলাইট ছবি বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, উত্তর রাখাইনের ২১৪টি গ্রামের কয়েক হাজার বাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, ২০ বর্গকিলোমিটার এলাকার বিভিন্ন অবকাঠামো ধ্বংস করা হয়েছে।

মিয়ানমার সরকার বলছে ৬ হাজার ৮০০ বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এজন্য তারা রোহিঙ্গাদের দায়ী করে আসছে। দেশটির ডি ফ্যাক্টো নেতা অং সান সু চি’র মুখপাত্র জাউ হিতায় বলেন, আমরা যে তথ্য পেয়েছি তাতে জানা গেছে, সন্ত্রাসীরা আগুন লাগিয়েছে।

খাদ্য ঘাটতি

জাতিসংঘ ত্রাণ তৎপরতা বন্ধ ঘোষণার পর থেকে খুব কম ত্রাণ ও সহযোগিতা রাখাইনে পৌঁছেছে। জাতিসংঘ সন্ত্রাসীদের সহযোগিতা করছে- সরকারের এমন অভিযোগের মুখে বিশ্বসংস্থাটি সেখানে ত্রাণ তৎপরতা বন্ধ করে দেয়। রাজ্যের রাজধানীতে রাখাইনরা দুইবার রেডক্রসের ত্রাণবহর আটকে দেয়।

সু চির মুখপাত্র জানান, রাখাইনে মানবিক সহযোগিতা পৌঁছে দেওয়াকে সরকার অগ্রাধিকার দিচ্ছে। তিনি বলেন, কোনও এলাকায় যদি ত্রাণ না পৌঁছে থাকে লোকজনের উচিত আমাদের জানানো। তাহলে যত দ্রুত পারি আমরা সেখানে ত্রাণ পৌঁছে দেব।

চলমান অভিযানে ৩০ হাজার অমুসলিম বাসিন্দাও বাস্তুচ্যুত হয়েছে। আগস্টে অভিযান শুরু হওয়া আগে মিয়ানমারের রাখাইনে ১১ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমের বাস ছিল। রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব বাতিল করেছে দেশটি।

‘রোহিঙ্গারা চলে যাওয়াতে খুশি’

বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানায়, রাখাইনরা মুসলিমদের উচ্ছেদে সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করছে। দক্ষিণ মংডুর আলেল থান কিয়াইউ এলাকার বাসিন্দা কামাল হুসেন (২২) সেপ্টেম্বরের শুরুতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। সে জানায়, রাখাইন সম্প্রদায়ের লোকেরা বাড়িতে পেট্রোল ঢেলে চলে যায়। এরপর সেনারা গ্রেনেড লঞ্চার ছুড়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। তবে সু চির মুখপাত্র দাবি, কিছু খালি বাড়িতে রাখাইনরা আগুন লাগিয়েছে। আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।

রয়টার্সের নেওয়া সক্ষাৎকার ও স্যাটেলাইট ছবিতে অগ্নিকাণ্ডের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে দেখা গেছে, মংডু’র বিশাল এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ উপকূলীয় এলাকার ১০০ কিলোমিটার অঞ্চলজুড়ে বেশিরভাগ বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।

মংডু শহরে রাখাইন বৌদ্ধ, রোহিঙ্গা মুসলিম ও হিন্দুদের বাস ছিল। এইচআরডব্লিউ জানিয়েছে, হামলার প্রথম সপ্তাহেই শহরটিতে থাকা রোহিঙ্গাদের ৪৫০টি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। শহরটিতে বসবাসরত মোহাম্মদ সালেম টেলিফোনে রয়টার্সকে জানান, যারা খাবার জমিয়ে রেখেছিল তারা তা বিক্রি করে বাংলাদেশ পালিয়ে যাচ্ছে।

রাথেডাউং এলাকাতেও রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের বাস ছিল। স্থানীয় বাসিন্দা ও ত্রাণকর্মীদের মতে, সেখানে ২১টির মধ্যে ১৬টি রোহিঙ্গা গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট পাঁচটি গ্রামে খাবার ও ওষুধ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। বাসিন্দারা রাখাইনদের হুমকির মুখে রয়েছে।

সেনাবাহিনীর অভিযানে সহযোগিতাকারী দুই রাখাইন বৌদ্ধ কর্মকর্তার সঙ্গে রয়টার্সের পক্ষ থেকে কথা বলা হয়। এদের একজন টিন টুন সয়েই। সে জানায়, সেনাবাহিনীর ত্বরিত পদক্ষেপের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। হামলার পরদিনই প্রায় এক হাজার ৬০০ বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। টিন টুন বলেন, তারা (রোহিঙ্গা) সংখ্যায় অনেক বেশি। তারা এখানে থাকলে আমাদের বেঁচে থাকা মুশকিল। তারা সবাই চলে যাওয়াতে আমি খুব খুশি।

পাঠকের মতামত

প্রকাশ্যে নামাজ পড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী গ্রেফতার

ভারতের উত্তর প্রদেশে মীরুটের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলা জায়গায় নামাজ আদায়ের অভিযোগে এক শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার ...

বাংলাদেশ হয়ে রাখাইন রাজ্যে সহায়তা পাঠাতে চায় জাতিসংঘ

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সেখানে ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ। সংস্থাটি বাংলাদেশকে ...

আওয়ামী লীগের প্রায় ৪৫ হাজার নেতাকর্মী এখন ভারতে অবস্থান করছেন: গৌতম লাহিড়ী

বিশিষ্ট প্রবাসী সাংবাদিক জুলকার নাইন সায়ের এক ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে জানিয়েছেন,সম্প্রতি ভারতের দিল্লির প্রেস ক্লাব ...