
বহুল আলোচিত ও পরিচিত রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ হত্যাকান্ড দেশের সীমানা ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধের চিত্র এই ঘটনায় আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রোহিঙ্গারা যে আসলেই নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত তা প্রমাণ করতেই উগ্রপন্থী আরসা নামক সংগঠনের সশস্র দুর্বৃত্তদের দিয়ে খুন করিয়েছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকার।
রোহিঙ্গাদের নিজ জন্মভূমি মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য কাজ করতে গিয়ে স্বদেশে যাওয়ার বিরোধী আরসা সংগঠনের সশস্র দুর্বৃত্তদের হাতে মুহিবুল্লাহ খুনের ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছে গোয়েন্দা সংস্থা।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু উগ্রপন্থী আরসাই নয়, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে চরমপন্থী সশস্র সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে মদদ দিতে তৎপরতা চালাচ্ছে আল ইয়াকিন, আরএসও, ইসলামি মাহাত, সিভিল রাইটস ও মানবাধিকার ইস্যুতে আন্দোলন করা কয়েকটি সংগঠনও।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অন্তত ২০ টি সশস্র বাহিনীর দেড়শ’ থেকে ২শ’ সশস্র সন্ত্রাসী তৎপর। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সক্রিয় সশস্র দুর্বৃত্তদের তালিকা তৈরি করে গ্রেফতার ও অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধারের জন্য মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। মুহিবুল্লাহর খুনীদের যে কোন মূল্যে গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দানের জন্য বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ প্রদানসহ কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তার হাত থেকে বাঁচার জন্য শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশের কক্সবাজারের টেকনাফ-উখিয়ার ৩৪ ক্যাম্পে আশ্রিত ১১ রোহিঙ্গা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার পর তারা খুন, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, অস্ত্র ও মাদক পাচার, চোরাচালান, ডাকাতি, বন দখল, প্রতারণাপূর্বক জন্মসনদ ও পাসপোর্ট তৈরি করে এবং অবৈধভাবে বিদেশ যাওয়া, নাগরিকত্ব গ্রহণের মতো গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গা সশস্র দুর্বৃত্তদের হাতে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র এখন আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য বড় ধরনের হুমকি। অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের মাধ্যমে অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, ছিনতাই, ডাকাতির মতো ঘটনা ঘটছে।
গত ৪ বছরে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ১২ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হওয়ার ঘটনা স্থান পেয়েছে পুলিশের তালিকায়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে গত ৪ বছরে অন্তত ৭০টি হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। সর্বশেষ হত্যাকান্ডের শিকারে পরিণত হয়েছেন রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ। রোহিঙ্গদের বিরুদ্ধে গত ৪ বছরে বিভিন্ন ধরনের অপরাধে অন্তত ১ হাজার ২৯৮টি মামলা হয়েছে। এতে আসামি হয়েছে ২ হাজার ৮৫০ রোহিঙ্গা। এসব অপরাধের মধ্যে রয়েছে হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি, অস্ত্র ও মাদক পাচার, মানব পাচার, পুলিশ আক্রান্ত ইত্যাদি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৭০টি খুনের মামলা হয়েছে গত চার বছরে।
এ সময় ৭৬২টি মাদক, ২৮টি মানব পাচার, ৮৭টি অস্ত্র, ৬৫টি ধর্ষণ ও ১০টি ডাকাতির ঘটনায় মামলা হয়েছে। ৩৪টি মামলা হয়েছে অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের অপরাধে। অন্যান্য অপরাধে হয়েছে ৮৯টি মামলা। গত ৪৮ মাসে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংঘর্ষের ঘটনায় ২২৬ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে আরও ৩৫৪ জন।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, রোহিঙ্গাদের জনপ্রিয় নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকান্ডের পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সক্রিয় সশস্র দুর্বৃত্তদের তালিকা তৈরি করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সশস্র দুর্বৃত্তদের গ্রেফতার করে তাদের কাছে থাকা অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করার জন্য ইতোমধ্যে গ্রেফতার অভিযান পরিচালনা শুরু হয়েছে।
গোয়েন্দা সংস্থার তালিকা অনুযায়ী, কক্সবাজারের ক্যাম্পে বেপরোয়া হয়ে ওঠা অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের মধ্যে আতাউল্লাহ, হাসিম/হামিম, শামসু আলম, জোবায়ের, আরিফ উল্লাহ, ফজলুল কবির, রহমত করিম, আব্বাস, মোনা মিয়া, রফিক ওরফে আমিন, আবদুল শুক্কুর, আবদুল মোনাফ, বদি উল্লাহ, মোস্তাক ও এহসান, আবদুল হাকিম, মোঃ আনাস, মাহাদ, মুন্না, হাফেজ, মোঃ ইউনুছ, শাহ আলম, পুতিয়া, মোঃ খালেক, রাশেদ, জকির আহমদ ওরফে জকির ডাকাত, হাসান প্রকাশ কামাল, খলিফা সেলিম, খায়রুল নবী, মোহাম্মদ রাজ্জাক, মোহাম্মদ রফিক, দোস মোহাম্মদ, নুরু মিয়া প্রকাশ ভুইল্যা, মোহাম্মদ নুর, বনি আমিন, সালমান শাহ, রশিদ উল্লাহ, খায়রুল আমিন, মহিউদ্দিন ওরফে মাহিন, সাদ্দাম হোসেনসহ অনেকেই রয়েছে। তারা সবাই উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পের বাসিন্দা।
রয়েছে রকি বাহিনী, শুক্কুর বাহিনী, আবদুল হাকিম বাহিনী, সাদ্দাম গ্রুপ, জাকির বাহিনী, মুন্না গ্রুপ, নবী হোসেন বাহিনী ইত্যাদি। এসব বাহিনীর সদস্য কয়েক শ’। স্থানীয় লোকজনের কাছে যারা ডাকাত হিসেবে পরিচিত।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিচ্ছিন্নতাবাদী বিভিন্ন সংগঠন সক্রিয়। বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ আছে যারা জঙ্গীর মানসিকতা নিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাচ্ছে, অস্ত্রবাজি করছে।
রোহিঙ্গাদের মধ্যে আরসা, আল ইয়াকিনসহ বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠন আছে। নিজেদের মধ্যে যে অন্তর্কোন্দল, গোলাগুলির যে আওয়াজ, এ নিয়ে বাংলাদেশীরা শঙ্কিত, উদ্বিগ্ন। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর আশপাশের জঙ্গলে, পাহাড়ে জঙ্গীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। এতে বিদেশীদের মদদ ও উস্কানি আছে। রাতেরবেলায় সেখানে আরসা, আল ইয়াকিনসহ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো তৎপর হয়ে ওঠে। সাধারণ রোহিঙ্গারা সন্ধ্যার পর ঘরে ঢুকে যায়। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর কর্মকা- রাতেই চলে। আশ্রয় শিবিরের ঘরগুলো দুর্গম পাহাড়ে, চিপা গলি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দেয়া খুবই সহজ।
গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকা-ের নেপথ্যে আরসা নামক উগ্র ও চরমপন্থী সংগঠনটির সশস্র দুর্বৃত্তরা জড়িত থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে প্রাথমিক তদন্তে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে যখন রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে তখন থেকেই আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি আর্মি বা আরসা নামে সংগঠনটি সক্রিয়। বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সম্প্রতি এই আরসা গ্রুপটি কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। আরসার নেতাদের সমর্থনে সম্প্রতি গড়ে উঠেছে আরও একটি চরমপন্থী সংগঠন আল ইয়াকিন। অনেকে এটিকে আরসার ‘ছায়া সংগঠন’ বলেও উল্লেখ করেছেন।
আল ইয়াকিন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের ঘোর বিরোধী। তাদের নেতারা কখনও মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায় না। ইসলামি মাহাত নামে আরও একটি সংগঠন শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে তৎপর। তারাও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনবিরোধী। রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আরও যেসব সংগঠন কাজ করে তাদের মধ্যে রয়েছে আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল ইউনিয়ন বা এআরএনইউ, ভয়েস অব রোহিঙ্গা। রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লা হত্যাকান্ডের তদন্ত করতে গিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির বিষয়ে ‘কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে আসছে’ বলে মনে করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
সূত্র : জনকন্ঠ

পাঠকের মতামত