প্রকাশিত: ৩১/১২/২০১৬ ৭:৪৮ এএম

উত্তম চক্রবর্তী ॥ আজ রাতটুকু পেরোলেই আগামীকাল ভোরের পূর্বাকাশে দেখা দেবে নতুন বছরের সূর্য। দেখতে দেখতে কেটে গেল আরেকটি বছর। দিনপঞ্জিকার শেষ পাতাটি উল্টে যাবে আজ। নানা কাজের ফিরিস্তি লেখা নিত্যসঙ্গী হয়ে হাতখাতাটি হয়ে পড়বে সাবেক। পরমায়ুর বৃক্ষ থেকে ঝরে যাবে একটি পাতা। মহাকাল নামের এক অন্তহীন মরুভূমির বুকে যেন এক ফোঁটা জল। আজ মহাকাল সেভাবেই মুছে দেবে বহুল আলোচিত ২০১৬ কে। ‘যেতে নাহি দিব’-এ চিরন্তন বিলাপধ্বনির ভেতরে আবহমান সূর্য একটি পুরনো দিবসকে আজ কালস্রোতের ঊর্মিমালায় বিলীন করে পশ্চিম দিগন্তে মিলিয়ে যাবে। বর্ষবরণের আবাহন রেখে কুয়াশামোড়া পা-ুর সূর্য আজ বিদায় নেবে মহাকালের যাত্রায়। সময় হলো খ্রিস্টীয় ২০১৬ সালকে বিদায় বলার। খ্রিস্টীয় নতুন বছর ২০১৭ সালকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত বিশ্ববাসী।

সময় যায়। সময় যাওয়ার সময় বদলে যায় অনেক কিছুই। এ হলো পরম সত্য। সময় যেন এক প্রবহমান মহাসমুদ্র। কেবলই সামনে এগিয়ে যাওয়া, পেছনে ফেরার সুযোগ নেই। তাই তো জীবন এত গতিময়। সেই গতির ধারাবাহিকতায় মহাকালের প্রেক্ষাপটে একটি বছর মিলিয়ে গেল। আজ আলোড়িত-আন্দোলিত বর্ষ বিদায়ের দিন। জীর্ণ ঝরা পল্লবের মতো সরল রৈখিক গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে আজ খসে পড়বে ‘২০১৬’। মধ্যরাতে নতুন বছর ২০১৭-কে স্বাগত জানানোর উৎসবের বাঁশি বেজে উঠবে সবার প্রাণে। আগামীকাল থেকে শুরু হবে নতুন প্রত্যাশার নতুন বছর, কিন্তু যে বছরটি হারিয়ে গেল জীবন থেকে, ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে, তার সবই কি হারিয়ে যাবে? মুছে যাবে সব? না, সবকিছু মুঝে যায় না। ঘটনাবহুল ২০১৬’র ঘটনার রেশ টেনেই মানুষ এগিয়ে যাবে ২০১৭ সালের মধ্যরাতের পথে। অনেক ঘটনা মুছে যাবে বিস্মৃতির ধুলোয়। আবার পাওয়া না পাওয়ার অনেক ঘটনা থাকবে উজ্জ্বল হয়ে।

প্রতিবারের মতো এবারও নতুন সূর্যালোকে নতুন আশা ও স্বপ্ন নিয়ে নতুন একটি বছরে যাত্রা শুরুর জন্য প্রস্তুত সবাই। অসীম প্রত্যাশা নিয়ে মানুষ অপেক্ষা করছে আজ মধ্যরাতের প্রথম প্রহরের জন্য, যখন সূচিত হবে নতুন আকাক্সক্ষায় উদ্ভাসিত হবে নতুন বছর। যে বছরের খেরোখাতায় চোখ বুলালেই বয়ে যায় আনন্দ-বেদনার স্রোত। হয়ত স্মৃতি সতত সুখের নয়। হিসেবের খেরোখাতায় জমে আছে অনেক বিয়োগ-ব্যথা, হারানোর কান্না, নানা গ্লানি আর মালিন্যের দাগ। বছরজুড়ে অপ্রত্যাশিত নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায় আমাদের মন ভীষণ ভারাক্রান্ত, তবু নিরাশার গভীর থেকে ফুটে ওঠে বিপুল আশার আলো, ধ্বংসস্তুপ থেকে ফোটে নবতর জীবনের ফুল। আমরা আবারও মেতে উঠি সৃষ্টিসুখের উল্লাসে, বৈরী সময়কে মারিয়ে এসে গেয়ে উঠি জীবনের জয়গান।

আজ রাত পেরোলেই কাল পূর্বাকাশে উঠবে যে নতুন সূর্য সে সূর্য নতুন বছরের। নতুন আশায় বুক বেঁধে আরও একটি নতুন বছরের দিনলিপি পড়ে থাকবে পেছনে। নতুন বছরে নতুন সূর্যের অসীম প্রতীক্ষা মানুষের। উৎসব আয়োজনের মধ্য দিয়েই মানুষ স্বাগত জানাবে ইংরেজী নতুন বছর ২০১৭ সালকে। ইংরেজী পঞ্জিকার সর্বজনীনতায় কাল বিশ্ববাসীও মেতে উঠবে নতুন বছরের আগমনী আনন্দ-উল্লাসে। স্বপ্ন আর দিনবদলের অপরিমেয় প্রত্যাশার রক্তিম আলোয় উদ্ভাসিত শুভ নববর্ষ ২০১৭। ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’- উচ্চারিত হবে শতকোটি মানুষের কণ্ঠে।

বহু ঘটনার জন্ম দিয়ে মহাকালের পরিক্রমায় বিদায় নিল আরও একটি বছর। মিথ্যার কুহেলিকা ভেদ করে সত্য প্রতিষ্ঠিত এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অভূতপূর্ব পুনর্জাগরণ ঘটিয়ে চিরকালের জন্য আজ হারিয়ে যাচ্ছে ঘটনাবহুল ২০১৬ সাল। বাংলাদেশের ৪৫ বছরের অনেক ইতিহাস বদলে দিয়েছে বিদায়ী বছরটি। সূচনা করেছে জাতীয় জীবনে ও রাজনীতির ইতিহাসে এক অভিনব অধ্যায়ের। যে ভয়াল জঙ্গী সন্ত্রাসের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সারাবিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করার যে সুগভীর ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল বিদায় বছরের মাঝপথে, শেষ পর্যন্ত সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত আর ভয়াল জঙ্গীবাদকে শক্তহাতে দমন করে বিপুল উন্নয়ন আর জনমনে শান্তি-স্বস্তি দিয়েই বিদায় নিল ২০১৬ সাল। অনেক ঘটনা, অঘটন, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, চড়াই-উতরাই, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আনন্দ-বেদনার সাক্ষী হয়ে কালের গর্ভে আজ হারিয়ে যাচ্ছে এ বছরটি।

যে প্রত্যাশার বিশালতা নিয়ে ২০১৬ সালের যে প্রথম দিনটি বরণ করা হয়েছিল সে প্রত্যাশার সব কি পূরণ হয়েছে। হয়নি। কিন্তু যা পাওয়া গেছে তাও কম নয়। নানা চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র শক্তভাবে মোকাবেলা করে সৃষ্টির জাগরণে দেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে বর্তমান সরকার। সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বেড়াজাল ছিন্ন করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দক্ষ রাষ্ট্র পরিচালনায় আজ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। দুর্নীতি-সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের দেশের কালো তকমা মুছে ফেলে সারাবিশ্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল।

সকল ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে প্রমত্তা পদ্মা নদীর বুকচিরে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণযজ্ঞ চলছে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর। নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে গেছে রাজধানীতে মেট্রোরেলের। সরকারের দক্ষ রাষ্ট্র পরিচালনায় বাংলাদেশ পেয়েছে বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও স্বীকৃতি। তাই বিদায়ী বছরে কৃষি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতিসহ সার্বিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে বলা যায়Ñ আশা-নিরাশার, আনন্দ-বেদনার দোলাচলে যথেষ্ট বাক্সময় ২০১৬। নতুন বছর ২০১৭ সালের অনেক প্রত্যাশার বীজও বুনে গেছে বিদায়ী ২০১৬।

দেখতে দেখতে চলে গেল আরেকটি বছর। শেষলগ্নে এসে হাসি-কান্না, পাওয়া, না-পাওয়ার হিসাব মেলাতে ব্যস্ত সবাই। রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে বিদায়ী বছরটি কেমন গেল, দেশের সব মানুষের এক জবাব- ২০১৬ সাল ছিল নিস্তরঙ্গ রাজনীতির বছর। জুনে ঢাকার গুলশানে এবং কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ভয়াবহ জঙ্গী হামলার পর কিছু সময় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করলেও কার্যত পুরো বছরটিই কেটেছে শান্তি, স্বস্তি ও অগ্রগতির মিছিলে। ২০১৫ সালের মতো দেশবাসীকে রাজনীতির নামে নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ ও পুড়িয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যার নৃশংসতার ঘটনা বিদায়ী ২০১৬ সালে দেখতে হয়নি।

২০১৬ সালটি কেমন গেল তার সার্বিক পর্যালোচনায় এক কথায় বলা যায়, কিছু ঘটনা ছাড়া রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে উন্নয়নের নবযাত্রার এক বছর পূর্ণ হলো। বিদায়ী এই এক বছরে বড় ধরনের রাজনৈতিক বিরোধিতায় পড়তে হয়নি সরকারকে। সংঘাতময় আন্দোলনে যাওয়ার সুযোগ পায়নি বিরোধী দলগুলো। প্রধান বিরোধী দলসহ কোন রাজনৈতিক দলই কোন হরতাল পালন করেনি। বিএনপি-জামায়াতের কর্মসূচিহীন নিস্তরঙ্গ রাজনীতি সত্ত্বেও ২০১৬ সালে ভিন্ন এক অস্থিরতার জন্ম দেয় জঙ্গীবাদী সংগঠনগুলোর দেশবিনাশী কর্মকা-। জঙ্গীবাদী সংগঠনগুলোর সন্ত্রাসবাদী কর্মকা-ে ভিন্নধর্মাবলম্বী, সংখ্যালঘুসহ ভিন্ন মতাদর্শের মানুষ, ব্লগার ও বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশীসহ বহু মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। বছরের শেষেরদিকে রাজধানীর আশকোনায় এক আত্মঘাতী নারী জঙ্গী শরীরে গ্রেনেড বেঁধে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিহত হওয়ার ঘটনা দেশবাসীকে আতঙ্কিত করে তুলেছে।

বিদায়ী বছরে ঘুরেফিরেই আলোচনার শীর্ষে ছিল জঙ্গীবাদ ॥ বিদায়ী বছরে রাজনীতির মাঠ শান্ত থাকলেও জঙ্গীবাদী হামলায় বার বারই সারাবিশ্বে আলোচনায় প্রধান্য পায় বাংলাদেশ। একের পর এক জঙ্গী হামলার ঘটনায় দেশে-বিদেশে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। বিদেশীরা যাতে বাংলাদেশ ছেড়ে যায়, চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে যাতে স্থবিরতা নেমে আসে, বাংলাদেশ যাতে সারাবিশ্ব থেকে ছিটকে পড়ে; এমন সুগভীর চক্রান্তের অংশ হিসেবেই পহেলা জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় ভয়াবহ জঙ্গী হামলা চালানো হয়। হামলাকারী জঙ্গীরা বিদেশী নাগরিকদের জিম্মি করে ১৭ বিদেশীসহ ২২ নাগরিককে পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করে। জঙ্গীদের ছোড়া গ্রেনেডে প্রাণ হারান দুই পুলিশ কর্মকর্তাও। পাল্টা আঘাত হেনে হামলাকারী ৫ জঙ্গীকে হত্যা করে ৩৩ জিম্মিকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।

সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডোরা হামলাকারী জঙ্গীদের হত্যা করে জিম্মিদের উদ্ধার করতে পারলেও গোটা বিশ্বের দৃষ্টি চলে আসে বাংলাদেশের দিকে। একসঙ্গে এত বিদেশী নাগরিক হত্যার ঘটনা দেশের স্বাধীনতার ৪৫ বছরের ইতিহাসে কখনও ঘটেনি। জঙ্গীদের মদদদাতা মাস্টারমাইন্ডরা ভেবেছিল: একসঙ্গে এত বিদেশী নাগরিককে হত্যা করলে আতঙ্কে বাংলাদেশে থাকা সব বিদেশী চলে যাবে, কোন বিদেশী বিনিয়োগকারী আসবে না, চলমান উন্নয়ন কর্মকা- মুখ থুবড়ে পড়বে। আর বাংলাদেশকে যাতে বিশ্বের মোড়লরা জঙ্গীরাষ্ট্র তকমা দিয়ে একঘরে করে ফেলে সেজন্য হামলার পরই এটি আইএসের হামলা বলে সুপরিকল্পিত রটনাও সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। তবে সরকার তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে দেশে আইএসের কোন অস্তিত্ব নেই তা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরে। এসব ঘটনা যে সরকারবিরোধী একটি অংশ পরিকল্পিতভাবেই করেছে তাও পরবর্তীতে ধৃত আসামিদের স্বীকারোক্তিতে বেরিয়ে এসেছে।

সরকারের জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতির সামনে টিকে থাকতে পারেনি জঙ্গীরা। গুলশানের হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশের প্রধানরা টেলিফোন করে জঙ্গীবাদ নির্মূলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী ভূমিকার প্রশংসার পাশাপাশি তার পাশে থাকার অঙ্গীকার করেন। এরপর ঘটে শোলাকিয়ায় জঙ্গী হামলা। এ দুটি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী শুরু হয় সাঁড়াশি অভিযান। এসব অভিযানে নব্য জেএমবির শীর্ষস্থানীয় নেতা তামিম চৌধুরী, মেজর (অব) জাহিদসহ ২৮ শীর্ষ জঙ্গী নিহত হয়।

সবচেয়ে বড় কথা জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী এক অভূতপূর্ব গণজাগরণ সৃষ্টিতে সক্ষম হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার আহ্বানে সারাদেশেই গড়ে ওঠে জঙ্গীবাদবিরোধী কমিটি। দেশের মানুষ সোচ্চার হয়ে ওঠেন জঙ্গীদের বিরুদ্ধে। অনেক জঙ্গীকে দেশের সাধারণ নাগরিক ধরে পুলিশে সোপর্দ করেছে। গোয়েন্দা সূত্র এবং সাধারণ মানুষের তথ্য নিয়ে অনেক জঙ্গী আস্তানা খুঁজে পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জুলাইয়ের পর থেকে বাকি ছয়টা মাস ধরে চলেছে এই জঙ্গীবিরোধী অভিযান। কিন্তু বছরের শেষভাগে এসে গত ২৪ ডিসেম্বর ঢাকার আশকোনায় এক জঙ্গী আস্তানায় পুলিশের অভিযানের সময় আত্মঘাতী হামলা চালায় এক নারী। বছরের শেষে এই নারী জঙ্গীর আত্মঘাতী হওয়ার মধ্য দিয়ে আশঙ্কা দেখা দেয়, জঙ্গী তৎপরতার স্রোতটি ক্ষীণ হয়ে পড়লেও একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়নি।

এছাড়া বিদায়ী বছরের শুরু থেকেই সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে নানাস্থানে গুপ্ত হত্যাকা- শুরু হয়। শুরুতেই ৭ জানুয়ারি ঝিনাইদহে খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহণ করার অপরাধে ৮২ বছর বয়সী হোমিও চিকিৎসক ছমির আলীকে কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গী সন্ত্রাসীরা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও ব্লগার নাজিমউদ্দিনকেও একই কায়দায় হত্যা করা হয়। ২৫ এপ্রিল কলাবাগানের বাসায় ঢুকে মার্কিন সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডির কর্মকর্তা জুলহাস মান্নান ও তার বন্ধু নাট্যকর্মী মাহবুব রাব্বীকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। আর প্রতিটি হত্যাকা-ের পরই আনসার আল ইসলাম অথবা আইএসের দায় স্বীকার অভীন্ন স্টাইলও প্রত্যক্ষ করেছে দেশবাসী। কিন্তু সরকারের কঠোরতার সামনে অনেক জঙ্গীই এখন মৃত্যুভয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হচ্ছে।

এছাড়া বছরের শেষদিকে এসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি-ঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা এবং গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পরিবারের ওপর হামলার ঘটনা দেশব্যাপী তোলপাড়ের সৃষ্টি করে। এসব ঘটনায় সরকারদলীয় স্থানীয় মন্ত্রী-এমপির দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিলে সরকারকে বেশ বেকায়দায় পড়তে হয়। কিন্তু প্রতিটি ঘটনার পরই দোষীদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থান দেশের মানুষকে স্বস্তি দিয়েছে। নাসিরনগরের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে নিজ দলের বেশ ক’জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করতেও সরকার দ্বিধা করেনি।

বিদায়ী বছরে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাই ছিল দেশী-বিদেশী সকল রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী ও ধনকুবের মীর কাসেমের মৃত্যুদ- কার্যকরের মাধ্যমে দেশকে কলঙ্কমুক্ত করা। এই মৃত্যুদ- কার্যকর যাতে না হয় সেজন্য হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছিল। দেশে একের পর এক গুপ্তহত্যা চালিয়ে পরিস্থিতি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করারও চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সকল ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে মীর কাসেমকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করে সরকার। এর মাধ্যমে ছয় শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর দ- কার্যকর হয় বর্তমান সরকারের সাহসী অবস্থানের কারণে। এছাড়া বিদায়ী বছরে প্রচ- দাবির প্রেক্ষিতে শহীদদের অবমাননা রোধ এবং দ-িত যুদ্ধাপরাধীদের সম্পদ বাজেয়াফত করতে নতুন দুটি আইন তৈরির পথেই হাঁটছে সরকার।

বিদায়ী বছরে সরকারের সাফল্যে বা অর্জনের কমতি ছিল না। একের পর এক আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিজয়, সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, দেশীয় অর্থনীতি মজবুত, উপচেপড়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। পাল্টে যাচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতিও। বিদায়ী বছরে রাজপথে ছিল না সরকারবিরোধী আন্দোলন কিংবা সংঘাত-সাংঘর্ষিক রাজনীতি। রাজনৈতিক প্রধান প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক সঙ্কটে ফেলার কৃতিত্বও সরকারের ঝুলিতে। পুরো বছরেই রাজনীতির লাগাম ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে।

কূটনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে বিদায়ী বছরে বাংলাদেশের অর্জন অনেক। বিদায়ী বছরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং ঢাকা সফর করেছেন। তার এই সফরে বাংলাদেশের সঙ্গে ২৭টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নতুনমাত্রা যোগ করেছে। চীনের প্রেসিডেন্ট ছাড়াও বিদায়ী বছরে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। তার সফরের সময়ে দু’দেশের সম্পর্ক আরও জোরদারে আলোচনা হয় এবং জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাস দমনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসাও করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এছাড়া বাংলাদেশ সফর করেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মনোহর পারিকর। ৪৫ বছরের মধ্যে ভারতের কোন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই প্রথম বাংলাদেশ সফর। তার সফরের সময় অমীমাংসিত তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তির বিষয়ে আলোচনা প্রাধান্য পায়। বিশ্বের বড় বড় দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরাও বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়নের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন বিদায়ী বছরজুড়েই।

বছরজুড়েই নির্বাচন, বিএনপির ভরাডুবি ॥ বিদায়ী বছরে সম্মেলন করে নতুন নেতৃত্ব নিয়ে পথ চলছে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। রাজপথে আন্দোলন, হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও না থাকলেও বছরজুড়েই সারাদেশে স্থানীয় নির্বাচনকে ঘিরে ভোটযুদ্ধে ব্যস্ত ছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। আর স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের জয়জয়কার, বিপরীতে ভরাডুবি ঘটেছে বিএনপির। স্থানীয় সরকারের সব স্তরে এখন আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ব। জেলা ও উপজেলা পরিষদ থেকে শুরু করে সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের প্রায় ৮৫ ভাগই জিতেছে আওয়ামী লীগের প্রার্থী।

বছরের শেষদিকে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিএনপির প্রার্থীর শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে। সকল জেলা পরিষদেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীর জয়জয়কার। বিএনপি পরাজয় দিয়ে বছরটা শুরু করার পর শেষ সময়েও পরাজয় নিয়েই বছরটা শেষ করতে হয়েছে। কোন নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের নৌকার কাছে পাত্তাই পায়নি বিএনপির ধানের শীষ। স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী লীগের ঐক্যবদ্ধ সাংগঠনিক শক্তির কাছে বিএনপির ভঙ্গুর সাংগঠনিক শক্তি দাঁড়াতেই পারেনি। তবে বিদায়ী বছরে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কাছে এক আতঙ্কের নামই ছিল ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’। প্রতিটি নির্বাচনেই বিদ্রোহীদের লাগাম টেনে ধরতে পারেনি দলটি। এতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল অনেকস্থানে ভাতৃঘাতী সংঘর্ষে রূপ নিয়েছিল, এতে অনেকের প্রাণও ঝড়ে গেছে। সবশেষ জেলা পরিষদ নির্বাচনেও দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে ১৭ জেলায় বিদ্রোহী প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে বছর শুরু এবং শেষও হয়েছে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের জ্বালা নিয়েই।

বিদায়ী বছরটি প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির দোলাচলে নিয়েছে অনেক কিছু। চিরবিদায় নিয়েছেন সব্যসাচী লেখক ও কবি সৈয়দ শামসুল হক, প্রবীণ রাজনীতিক অজয় রায়, খ্যাতনামা কবি রফিক আজাদ, বিএনপির স্থানীয় কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার (অব) হান্নান শাহ, সরকারের সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন, খ্যাতনামা চলচ্চিত্র নির্মাতা শহীদুল ইসলাম খোকন, চিত্র নায়িকা পারভীন সুলতানা দিতি, চিত্রশিল্পী খালিদ মাহমুদ মিঠু, বেগম পত্রিকার সম্পাদক নুরজাহান বেগম, সঙ্গীতজ্ঞ খন্দকার নুরুল আলম, অভিনেতা ও মুক্তিযোদ্ধা ফরিদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী কবি মাহবুবুল হক শাকিলসহ অসংখ্য মানুষ। কিন্তু দিয়েছেও কি খুব কম? এ দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে ২০১৬ অনেক কারণেই স্মৃতির পাতায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। মহাকালের আবর্তে হারিয়ে গেলেও বিদায়ী বছরটি দেশের মানুষের মনে দাগ কেটে থাকবে বহুকাল, বহু বছর। পাল্টে দিয়েছে অনেক ইতিহাসও।

সব মিলিয়ে বিদায়ী বছরটি ছিল বৈচিত্র্যময়। আজকের গোধূলিবেলায় রক্তিম সূর্য অস্ত যাওয়ার মধ্য দিয়ে হারিয়ে যাবে ঘটনাবহুল এ বছরটি। এখন নতুন বছর আর নতুন সূর্যের অপেক্ষায় দেশবাসী। অপেক্ষা কেবল মানুষের নিরাপত্তা, শান্তি, স্বস্তি, জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বিনির্মাণ এবং সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির দেশ গড়ার। ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন চৌদ্দদলীয় জোট সরকারের কাছে এ প্রত্যাশা রেখেই আগামীকাল রবিবার থেকে নতুন বছরে, নতুন জীবনে যাত্রা করবে এ দেশের মানুষ। কাল শুরু হবে আরও একটি নতুন বছর ২০১৭। বিদায় ২০১৬janakantha

পাঠকের মতামত

অনলাইন জুয়া / দেশে নেতৃত্ব দিচ্ছেন যারা , হেডকোয়ার্টার রাশিয়া

মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার বিশ্বনাথপুর-শিবপুর সড়কে দাঁড়িয়ে হাত উঁচিয়ে একটি নির্মাণাধীন বাগানবাড়ি দেখালেন স্থানীয় আবুল হোসেন। ...

সীমান্তে সাউন্ড গ্রেনেড-টিয়ারশেল ব্যবহারের অনুমতি পেল বিজিবি

লালমনিরহাট সীমান্তে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে কয়েকদিন ধরে চলা উত্তেজনার পর, বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে (বিজিবি) সাউন্ড গ্রেনেড ...