প্রকাশিত: ০৬/১০/২০১৭ ৬:৩৫ পিএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ১২:৩৬ পিএম

নিউজ ডেস্ক::
নিজ দেশের সরকারি বাহিনীর হাতে মার খেয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা যখন তৃষ্ণার্ত, তখন তাদের জন্য নলকূপ বসিয়ে মুখে পানি তুলে দিচ্ছে এক দল বাংলাদেশি।

তল্পিতল্পা কাঁধে নিয়ে যখন রোহিঙ্গা বৃদ্ধা বা শিশুটি হাঁটতে পারছে না, তখন তাদের কাঁধের বস্তা নিজের কাঁধে তুলে নিচ্ছে এ দেশের কেউ।

বৃষ্টিতে কাকভেজা রোহিঙ্গা পরিবারকে ত্রিপলের ঘর বানিয়ে আশ্রয় দিয়ে মুখে খাবার তুলে দিয়ে বাঁচিয়ে রাখছে বাঙালি।

নিউমোনিয়া আক্রান্ত রোহিঙ্গা শিশুকে ফ্রি চিকিৎসা ও ওষুধ দিয়ে বাঁচিয়ে তুলছেন এ দেশের চিকিৎসক।

প্রসববেদনায় কাতর রোহিঙ্গা নারীর পাশে মায়ের মমতা নিয়ে দাঁড়িয়ে নবজাতককে সুন্দর কাপড়ে মুড়িয়ে আদরে বুকে টেনে নিচ্ছে বাঙালি নারী।

চোখ ভিজিয়ে দেওয়া এ রকম হাজারো গল্প প্রতিনিয়ত রচিত হচ্ছে কক্সবাজারের মাটিতে। আট দিন ধরে রোহিঙ্গা আশ্রয়পল্লীগুলো ঘুরে দেখা গেছে এসব চিত্র। এমন মানবিকতার নিদর্শনে অভিভূত রোহিঙ্গারা। অতীতে একাধিক দফায় নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করলেও এবারের মতো মানবিক বাংলাদেশকে তারা আগে দেখেনি বলে জানিয়েছে। প্রবীণ রোহিঙ্গা নারী ও তিন দফা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী আয়েশা খাতুন বুধবার কুতুপালং ক্যাম্পে দাঁড়িয়ে কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে আলাপকালে নিজস্ব ভাষায় অকপটে বলেন, ‘এমন বাংলাদেশ আগে দেখিনি। এবার মনে হচ্ছে এটি অন্য এক বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের মানুষ যে আমাদের এভাবে সহযোগিতা দেবে সেটা কল্পনাও করতে পারিনি। ’

জানা গেল, ৬৫ বছর বয়সী এই নারী প্রথম বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছিলেন ১৯৯২ সালে। এরপর ২০১২ সালে এবং সর্বশেষ গত মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি আসেন। এবারের অভিজ্ঞতায় তিনি অভিভূত।

চট্টগ্রাম মহানগরের বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় ঘুরে ত্রাণ সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আঞ্জুমান ফেরদৌসীর নেতৃত্বে একটি দল। পরে সেই অর্থ পাঠানো হয় উখিয়ায়। একইভাবে গানের সুরে সুরে ত্রাণের জন্য চট্টগ্রাম নগরে টাকা তোলে একদল যুবক। তারা এই টাকা পাঠিয়ে দেয় টেকনাফে। ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের জন্য টাকা তুলে ত্রাণ নিয়ে আসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জুনায়েদ, সাকিল, হান্নানসহ অনেকে। তারা রাজশাহী থেকে কক্সবাজারে এসে রোহিঙ্গা শিশুদের পোশাক বিতরণ করে। গত সোমবার তাদের সঙ্গে দেখা হয় কুতুপালং ক্যাম্পে। শিক্ষার্থীরা জানায়, তারা কয়েক বন্ধু মিলে ফেসবুকে ইভেন্ট খুলে ত্রাণের টাকা সংগ্রহ করেছে।

চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবুল বাশার আবু খাদ্য পাঠিয়েছেন রোহিঙ্গাদের জন্য। তার ছোট ভাই আবু তাহের খাবারের সঙ্গে নগদ টাকা বিতরণ করছেন।

সাতকানিয়ার কেঁওচিয়ার শামসুল ইসলাম ব্যস্ত রোহিঙ্গাদের জন্য খাবার পানির ব্যবস্থা করতে। তিনি টানা কয়েক দিন কক্সবাজারে অবস্থান করে নলকূপ বসানোর কাজ তদারকি করেন। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ব্যবসায়ী সমিতির নেতারাও আসেন ত্রাণের টাকা নিয়ে।

ঢাকার সাভার থেকে আসা আনিসুল ইসলাম বলেন, ‘আমি একটি বেসরকারি ফার্মে চাকরি করি। বেতন খুব বেশি নয়। কিন্তু টেলিভিশনে রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগের চিত্র দেখে ঠিক থাকতে পারিনি। আসার সময় বেতনের বেশির ভাগ টাকা সঙ্গে এনে বিলিয়ে দিয়েছি। ’

নরসিংদীর মাধবদী উপজেলার বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী পেশায় মসজিদের ঈমাম। তিনি গত শুক্র ও শনিবার টেকনাফ সাবরাং হারিয়াখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে রোহিঙ্গাদের মাঝে নগদ টাকা বিতরণ করেন। শনিবার দেখা গেছে, সেনাবাহিনীর পাশে দাঁড়িয়ে রোহিঙ্গা পরিবারপ্রতি নগদ এক হাজার টাকা করে দিচ্ছেন মধ্যবয়স্ক এক ব্যক্তি। তাঁর পাশে দাঁড়ানো আরো দুই ব্যক্তির হাতেও টাকার বান্ডিল। পরিচয় জানতে চাইলে একজন বলেন, ‘নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে চাই না। শুধু এটুকু বলতে পারি, আমার জাকাত ফান্ডের সব টাকা আমি দিয়ে দিচ্ছি। ’

সিলেট থেকে আসা এক নারীকে দেখা গেল কাঁধে একটি ব্যাগ ঝুলিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হাঁটতে। কিছুক্ষণ পরপরই তাঁকে ঘিরে ধরছে শিশুরা। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার কথা লিখবেন না। শুধু দোয়া করবেন, আল্লাহ যেন আমার মনের আশা পূরণ করেন। ’ মনের আশা কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মা হওয়ার আশা। ১১ বছরের বিবাহিত জীবনে আমি যে নিঃসন্তান। ’

সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, গত ২৫ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনী দায়িত্ব গ্রহণের আগ পর্যন্ত বেসরকারি পর্যায়ে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানিকভাবে কী পরিমাণ ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে, সেই হিসাব রাখা যায়নি। ত্রাণদাতারা এসেছেন আর ত্রাণ দিয়ে চলে গেছেন। জেলা প্রশাসন এ ক্ষেত্রে সমন্বয় করেছিল। এরপর দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই কী পরিমাণ ত্রাণ আসছে তা নিরূপণের কাজ শুরু করে সেনাবাহিনী।

দেখা গেল, উখিয়া কলেজ মাঠে বড় আকারের ত্রাণ ক্যাম্প গড়ে তোলা হয়েছে। সেখানে চাল, ডালসহ প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য ছাড়াও নলকূপসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ত্রাণসামগ্রী স্তূপ করে রাখা হয়েছে। এসব ত্রাণ এসেছে বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় থেকে। শুধু ব্যক্তি-প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে বুধবার পর্যন্ত তিন হাজার ৮০০ মেট্রিক টন ত্রাণ সহায়তা পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনী। গত বুধবার সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে গিয়ে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

সেনাবাহিনীর মেজর পদবির একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে আলাপকালে বলেন, বিদেশি ও বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণের বিষয়টি মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনের কাছে থাকবে। আর উখিয়া কলেজের সামনে সেনাবাহিনী ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের ত্রাণ গ্রহণ করছে। এসব ত্রাণ ক্যাম্পগুলোতে সুষ্ঠুভাবে বণ্টনের জন্য সমন্বয় করে সেনা সদস্যরা পৌঁছে দিচ্ছেন।

জানা গেল, সেনাবাহিনী নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় জরিপ চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে ৭০ শতাংশ জরিপ শেষ হয়েছে। বাকি ৩০ শতাংশ জরিপ শেষ হলেই নতুনভাবে ত্রাণ কার্যক্রম চালানো সম্ভব হবে। ক্যাম্পগুলোকে জোন, উপজোন ও ব্লকে বিভক্ত করা হয়েছে। এসব ব্লকে কত পরিবার আছে, পরিবারের সদস্যসংখ্যা, পরিবারের কর্তার নামসহ প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। এসব তথ্য পাওয়ার পর ত্রাণকার্ড তৈরি করছে সেনাবাহিনী। এসব কার্ডে ত্রাণগ্রহণকারীর ছবি থাকবে; পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আলাদা ছবি ও ত্রাণকার্ড গ্রহীতার বিস্তারিত তথ্য থাকবে। এ ছাড়া এই কার্ডের বিপরীতে কতবার ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে সে বিষয়ে কর্মকর্তার স্বাক্ষর থাকবে। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতি পরিবারকে একসঙ্গে সাত দিনের খাবার দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

মাঠপর্যায়ে ঘুরে দেখা গেছে, দুজন করে সেনা সদস্য ব্লকে ব্লকে গিয়ে রোহিঙ্গা পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করছেন। এসব তথ্য পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় তথ্য ভাণ্ডারে পাঠানো হচ্ছে। সেনা দপ্তরে গিয়ে দেখা গেল, সেখানে একদল সেনা সদস্য কার্ড লিপিবদ্ধ করছেন। ১০ পদাতিক ডিভিশনের অন্তর্গত ৬৫ পদাতিক ব্রিগেড এই কার্যক্রম চালাচ্ছে।

ত্রাণ বিতরণ মাঠে দেখা গেছে, গ্লোবাল ওয়ান নামের একটি উন্নয়ন সংস্থার কর্মীরা ত্রাণ বিতরণ করছেন। সেখানে সারিবদ্ধভাবে ত্রাণগ্রহীতাদের বসিয়ে রেখেছে সেনাবাহিনী। নারী-পুরুষের আলাদা লাইন। প্রত্যেকের হাতে ত্রাণের কার্ড। প্রতিষ্ঠানের কর্মী লিটন জানান, তাঁদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে হাঁড়ি-পাতিল, চাল, ডাল, তেল, কম্বল থেকে শুরু করে সব কিছুই দেওয়া হচ্ছে ত্রাণ হিসেবে। প্রায় ছয় হাজার রোহিঙ্গাকে ত্রাণ দেওয়ার পরিকল্পনা আছে তাঁদের। সেনাবাহিনী সহযোগিতা দেওয়ায় তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, না হলে এখানে ত্রাণ বিতরণ সম্ভব হতো না।

অদূরেই একটি চিকিৎসা ক্যাম্প খুলে রোহিঙ্গাদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা দিচ্ছিলেন সাজেদা ফাউন্ডেশন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসকরা। তাঁরা শিশু ও নারীদের বিশেষ স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছিলেন। এই ক্যাম্পের এক স্থানে দেখা গেল একদল শ্রমিক নলকূপ বসাচ্ছে। পানীয় জলের সংকট মোকাবেলায় এ ধরনের শত শত নলকূপ বসানো হচ্ছে অস্থায়ী ক্যাম্পগুলোতে। এখনো কয়েক শ নলকূপ জমা আছে সেনাবাহিনীর কাছে। অন্যদিকে প্রতিটি ব্লকেই পর্যাপ্ত স্যানিটেশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে। একদল শ্রমিক স্যানিটেশন তৈরির কাজ করছিল।

ক্যাম্পের ভেতরে যাওয়ার পরই দেখা যায় সেনাবাহিনীর বড় বড় কিছু এক্সকাভেটর। এগুলো দিয়ে পাহাড়ের মাটি কেটে রাস্তা তৈরি হচ্ছে। ইতিমধ্যে ১০টির মতো সড়কের কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে সেনাবাহিনী। ক্যাম্পগুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগের প্রক্রিয়াও চলমান। এ ছাড়া কিছু সোলার প্যানেলও চালু হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ঘরে ঘরে।

এ দেশের মানুষের এসব মানবিকতায় মুগ্ধ রোহিঙ্গা আকতার হোসেন বলেন, ‘আসলেই বাংলাদেশের মানুষ আমাদের হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করেছে। না হলে সারা দেশ থেকে এত লোক আমাদের বাঁচাতে এগিয়ে আসবে কেন? তারা যে মহান জাতি, সেটাই প্রমাণ করেছে তাদের কর্মের মধ্য দিয়ে। ’ তিনি বলেন, ‘সোয়া পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা এসেছে বলে শোনা যাচ্ছে। কেউ না খেয়ে মরেছে কিংবা চিকিৎসাহীনতায় কেউ মরেছে—এমনটা আমি শুনিনি। ’ আকতার হোসেন রোহিঙ্গা ভাষায় বলেন, ‘এই বাংলাদেশকে আমরা আজীবন মাথায় করে রাখব। এই ঋণ শোধের চিন্তাও কখনো করব না। কারণ, ভালোবাসার ঋণ শোধ হয় না।

পাঠকের মতামত

রামুর ফতেখাঁরকুলে উপ-নির্বাচনে প্রতীক পেয়ে প্রচারনায় ৩ চেয়ারম্যান প্রার্থী

রামু উপজেলার ফতেখাঁরকুল ইউনিয়ন পরিষদের উপ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্ধি ৩ প্রার্থীকে প্রতীক বরাদ্ধ দেয়া ...