প্রকাশিত: ০৩/০৭/২০১৭ ১১:১৪ এএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ৫:২৪ পিএম

রুদ্র মিজান: একজন সাথী। অন্যজন শোভা। সম্পর্কে দুই বোন। পোশাক, চেহারায় আভিজাত্যের ছাপ। আর এটাকে পুঁজি করেই প্রতারণার ফাঁদ পাতেন তারা। এ ফাঁদে আটকা পড়ে ইতিমধ্যে অনেকেই হয়েছেন নিঃস্ব। তাদের বিরুদ্ধে হয়েছে মামলা। তাদের প্রতারণার ধরন দেখে পুলিশও অবাক। মামলা তদন্ত করতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। কিন্তু কিভাবে চলে তাদের প্রতারণা? পুরো নাম নুরুননাহার সাথী ও কামরুননাহার শোভা। দুই বোন। কখনো তাদের পরিচয় ব্যবসায়ী, কখনো আইনজীবী, কখনো সাংবাদিক। প্রভাবশালীদের সঙ্গে তাদের চলাফেরা। পোশাক আর চেহারায় আভিজাত্যের চাপ। সহজেই যে কারও সঙ্গে গড়ে তোলেন বন্ধুত্ব। তারপর রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ, ডিনারের নামে আড্ডা। সুযোগ পেলেই শোনান তাদের ব্যবসার নানা গল্প। এভাবে এগিয়ে যান নির্দিষ্ট লক্ষ্যে। ব্যবসায় বড় অংকের বিনিয়োগ বা ধার চেয়ে বসেন সুযোগ মতো। বিনিময়ে লভ্যাংশ দেয়ার লোভনীয় প্রস্তাব। মূলত ব্যবসার নামে প্রতারণা তাদের পেশা। এই চক্রের শিকার হয়ে সর্বস্ব হারাতে হয়েছে অনেককে। কোটি কোটি টাকা লুটে নিয়েছে তারা। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করার কারণে উল্টো মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে ভুক্তভোগীকে।

সাথী ও তার ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় দায়েরকৃত মামলা তদন্ত করতে গিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, সাথী ও শোভা অত্যন্ত চতুর। যে কারণে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের পরও তাদের কিছুই হয়নি। উল্টো অভিযোগকারীরাই তাদের ভয়ে তটস্থ থাকেন। ভুক্তভোগীদের মধ্যে জাহিদুর রহমান ফারাজী জানান, ২০১৫ সালে সহকর্মী সানজিদা লাবণীর মাধ্যমে নুরুননাহার সাথীর সঙ্গে পরিচয়। পরিচয়ের শুরুতেই সাথী জানিয়েছিল সে একজন ব্যবসায়ী। প্রতি মাসে একাধিকবার তাকে ভারতে যেতে হয়। ভারত থেকে থ্রিপিস এনে ঢাকার বিভিন্ন দোকানে বিক্রি করে। এমনকি এলিফ্যান্ট রোডসহ বিভিন্ন স্থানে তার নিজেরও শোরুম রয়েছে। এতে অনেক লাভ। কিন্তু প্রয়োজন মতো টাকা বিনিয়োগ করতে পারছে না সাথী। প্রতিটি থ্রিপিসে কি পরিমাণ লাভ হয় তার হিসাব দিয়ে তাকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করা হয়। আগ্রহ জন্মে জাহিদুর রহমান ফারাজী ও তার সহকর্মী সানজিদা লাবণীর। একসময় কৌশলে টাকা চায় সাথী। সাথী জানায়, বছরে ২০ ভাগ করে লভ্যাংশ দেবে ফারাজীকে। কথা চূড়ান্ত। কথা অনুসারে ওই বছরের ২২শে ডিসেম্বর প্রথমে ৬ লাখ টাকা দেন ফারাজী। কিছুদিন পর লভ্যাংশ হিসেবে কিছু টাকা দেয়া হয় ফারাজী ও সানিজদাকে। ওই বছরের ২২শে ডিসেম্বর থেকে গত বছরের ৩রা মে পর্যন্ত ফারাজী দেন ৬০ লাখ ১৬ হাজার এবং সানজিদা দেন ৮০ লাখ ৪০ হাজার টাকা। দু’জনে মোট ১ কোটি ৪০ লাখ ৫৬ হাজার টাকা দেন সাথীকে। তারপরই প্রকাশ পায় সাথীর আসল চেহারা। নানা টালবাহানা করতে থাকে। লভ্যাংশ দেয়া দূরে থাক, মূল টাকা চেয়েও ফেরত পান না ফারাজী ও সানজিদা। ওই টাকা দেই দিচ্ছি বলে সময়ক্ষেপণ করতে থাকে সাথী। বারবার তাগদা। বারবার তারিখ।

ফারাজী ও সানজিদা লাবণী জানান, গত বছরের ৩রা মে ২০ পার্সেন্ট লভ্যাংশসহ পাওনা ১ কোটি ৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা গত বছরের ১০ই মের মধ্যে ফেরত দেবে স্ট্যাম্পে একটি অঙ্গীকারনামা করে সে। পরে টাকা না দিয়ে ভিন্নপথে হাঁটে সাথী। সাথী ও তার বোন শোভা নানাভাবে হুমকি দেয় তাদের। প্রভাবশালী নেতা, উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা, সাংবাদিক সব তাদের হাতের মুঠোয়। যা খুশি করতে পারবে তারা। প্রতিবাদ করারও সুযোগ পাবে না। উল্টো নিজের জানটা খোয়াতে হবে বলে হুমকি দেয় সাথী ও তার সঙ্গীরা। এভাবে ভয়ভীতি দেখালে পল্লবী থানায় একটি সাধারণ ডায়রি (জিডি) করেন ফারাজী। পরবর্তীতে গত বছরের ২৫শে জুলাই জাহিদুর রহমান ফারাজী বাদী হয়ে পল্লবী থানায় একটি মামলা করেন।

তাদের ফাঁদে পা দিয়েছেন আরও অনেকেই। তাদের মধ্যে একজন সাভারের আমিনবাজার সরকারি বালিরমাঠ এলাকার মাওলানা কামাল উদ্দিন। পেশায় ইমাম কামাল উদ্দিনের বাড়ি নাটোরে। গ্রামের বাড়ির জমি, পুকুর চালের ব্যবসা তার আয়ের প্রধান উৎস। কামাল উদ্দিনের প্রতি নজর পড়ে তাদের। পাড়ার এক বাসিন্দার আত্মীয় পরিচয়ে কামালকে দেখতে আসে সাথী। মামা সম্বোধন করে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা। এভাবেই শুরু। তারপর ব্যবসার কথা বলে প্রথমে দুই লাখ টাকা নেয়। লভ্যাংশ হিসেবে প্রতি মাসেই কয়েক হাজার টাকা তুলে দিতো কামালের হাতে।ইস্টার্ন মল্লিকার সাথীর লেডিস কানেকশনে ডেকে নিতো কামালকে। এ প্রতিষ্ঠানে কামালের বিনিয়োগ জানিয়ে তাকে সেভাবেই আপ্যায়ন করতে দেয়া হতো সেখানে। এভাবেই আস্থা বাড়ে। শুধু তা-ই না, কয়েক দফা পাঁচ লাখ টাকা করে ধার নিয়ে যথাসময়েই ফেরত দেয় সাথী। একপর্যায়ে তার কাছ থেকে ৯ লাখ টাকা নেয়। সর্বশেষ নিজের সমস্যার কথা বলে ধার চায় ১৫ লাখ টাকা। ততদিনে সাথী অনেক বিশ্বস্ত, আপনজনের মতো। তাই ঘনিষ্ঠ দুজনের কাছ থেকে ঋণ করে সাথীর হাতে ১৫ লাখ টাকা তুলে দেন কামাল। এভাবে কামাল উদ্দিনের কাছ থেকে মোট ২৪ লাখ টাকা নেয় সাথী। তারপরই প্রকাশ পায় তার আসল চেহারা। ফোন বন্ধ। বাসায় গেলে কামালকে গালিগালাজ করে বের করে দেয়া হয়। কামাল উদ্দিন বলেন, দেই, দিচ্ছি বলে টাকা ফেরত দেয়নি। উল্টো সন্ত্রাসী দিয়ে দু’বার মারধর করেছে। টাকা চাইলে হত্যার হুমকি দিয়েছে।

কামাল বলেন, সাথী ও শোভা কখনো সাংবাদিক, কখনো আইনজীবী পরিচয় দিয়েও হুমকি-ধমকি দেয়। এমনকি একজন মন্ত্রীর নামও ব্যবহার করে হুমকি দেয়। এ বিষয়ে গত বছরের ১৭ই আগস্ট পল্লবী থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন কামাল। একই কৌশলে ২০১২ সালের ১৩ই জুলাই ঢাকার আশুলিয়ার দুর্গাপুরের ফরহাদ হোসেনের কাছ থেকে ১৪ লাখ টাকা নেয় সাথীচক্র। টাকা চাইতে গেলেই ঘটে বিপত্তি। গত বছরের ১১ই আগস্ট ফরহাদকে হত্যার হুমকি দেয় নুরুননাহার সাথী ও তার স্বামী আবু হানিফ এবং তাদের ঘনিষ্ঠজন জুয়েল চন্দ্র সাহা। এ বিষয়ে ৭ই নভেম্বর আশুলিয়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন ফরহাদ। একই এলাকার আমিনবাজার চানপুরের মকিবুল হাসানের কাছ থেকে ৫৮ লাখ ৬৫ হাজার টাকা নেয় এই চক্র। টাকা ফেরত চাইতে গেলে তাকে মারধর করা হয়। এ বিষয়ে ২৯শে সেপ্টেম্বর সাভার থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন মকিবুল হাসান। এতে নুরুননাহার সাথী, তার স্বামী আবু হানিফ, বোন বীথি ও কামরুননাহার শোভার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে। একইভাবে ব্যবসার কথা বলে গুলশান-২-এর বাসিন্দা মোহাম্মদ ইমতিয়াজ করিমের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা নেয় সাথী। ওই টাকা ফেরত দিতে চাপ দিলে ইমতিয়াজ ও তার ঘনিষ্ঠদের আসামি করে অপহরণ মামলা করে সাথী। ইমতিয়াজ বলেন, তদন্ত করতে গিয়ে মামলাটি ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। আদালতে ২১১ ধারায় সাথীচক্রের বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা হয়েছে।

মিরপুর-১২ পল্লবীর ১৬ নম্বর সড়কের আট নম্বর আইডিএস স্কাইলার্কের চতুর্থতলার বাসিন্দা আবু হানিফের স্ত্রী নুরুননাহার সাথী। তার গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের জয়দেবপুরের পূর্ব বাগবাড়ি।

সাথীচক্রের বিরুদ্ধে একটি মামলা তদন্ত করছে সিআইডি। এ বিষয়ে সিআইডি’র তদন্ত কর্মকর্তা নিউটন কুমার দত্ত বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে এ ধরনের অনেক অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ব্যবসার কথা বলে তারা কৌশলে টাকা ধার নেয়। পরে আর ফেরত দেয় না। এসব বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আসামিদের বারবার ডাকলেও তারা সাড়া দিচ্ছে না বলে জানান তিনি। সূত্র: মানবজমিন

পাঠকের মতামত