উখিয়া নিউজ ডটকম::
গত সপ্তাহে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ চেষ্টার হার কিছুটা কম দেখা গেলেও গত দুইদিন ধরে আবারো বেড়েছে। নাফনদী ও সীমান্ত থেকে ৫ শতাধিক রোহিঙ্গাকে গত দুইদিনে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি। এরপরও সীমান্ত পেরিয়ে গতকাল রবিবার দুপুরে উখিয়ার কুতুপালং শরণার্থী শিবির ও টেকনাফের নয়াপাড়া শিবিরে পৌঁছেছে কমপক্ষে ৩ শতাধিক রোহিঙ্গা। এদিকে বিভিন্ন এনজিও ও ব্যাক্তির্বগরা অবৈধভাবে ত্রান বিতরনের কারনে রোহিঙ্গারা আসতে উৎসাহবোধ করছে।মিয়ানমারের রাখাইনে (আরাকান) গত ৯ অক্টোবরের ঘটনার পর থেকে শুরু হওয়া সেনা অভিযানের কারণে প্রাণ ভয়ে প্রতিদিনই বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা। স্বজনহারা এসব মানুষকে আশ্রয় দিতে মানবিক কারণে অনেকটা বাধ্য হচ্ছে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার মানুষেরা। তবে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা এসব মানুষের মুখে শোনা মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী মগদের ভয়াবহ নির্যাতনের ঘটনায় এপারেও উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে। এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যেও উগ্রপন্থী দলের উত্থান ঘটতে পারে এবং তা বাংলাদেশকে নতুন ঝুঁকিতে ফেলতে পারে বলে আশংকা সংশ্লিষ্টদের।
গতকাল রবিবার বিকালে কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের রোহিঙ্গা টালে গিয়ে দেখা হয়, মিয়ানমারের হাতিপাড়া থেকে সকালে আসা একটি দলের সাথে। এদের মধ্যে স্বামীহারা ও ধর্ষিতা দুই তরুণীও ছিলেন। গত প্রায় ১২ দিন আগে রাতের আঁধারে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের বাড়িতে এসে তাদেরকে (ভাবী ও ননদ) ধর্ষণ করে। এ সময় বাড়ির পুরুষেরা বাঁধা দেয়ায় তাদেরকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। এ সময় বাড়ির অপর চার পুরুষ সদস্য পালিয়ে যায়। পরে তারা বাংলাদেশে আসতে সক্ষম হয়।
তাদেরই মত মংডুর নিকটবর্তী খেয়ারিপ্যারাং থেকে গতকাল রবিবার স্ত্রী ও ২ কন্যা সন্তান নিয়ে কুতুপালং ক্যাম্পে আসা রোহিঙ্গা বদিউর রহমান জানান, গত ১০ দিন আগে মিয়ানমার সেনাবাহিনী তার পিতা ছালামতউল্লাহকে (৬০) গলা কেটে এবং মা চেমন আরাকে পুড়িয়ে হত্যা করে। এরপর তিনি স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে পালিয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে খেয়ে না খেয়ে পাহাড় ও বিল পেরিয়ে রবিবার বাংলাদেশে পৌঁছেছেন এবং কুতুপালং শিবিরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।
তারই মত একই এলাকার হালিমা খাতুন (৫৫) তিন নাতিসহ একই সময়ে কুতুপালং শিবিরে এসে অনিবন্ধিত এক রোহিঙ্গার বাড়িতে আশ্রয় পেয়েছেন। তার একমাত্র ছেলে কামাল আহমদকে স্ত্রীসহ ঘরে বন্দি করে পুড়িয়ে হত্যা করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এরপর অসহায় এই বিধবা তিন অবুঝ নাতিকে নিয়ে পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছেছেন বাংলাদেশে।
তারা জানান, মিয়ানমার সেনাবাহিনী খেয়ারিপ্যারাংসহ মংডুর কয়েকটি গ্রামকে শ্মশানে পরিণত করেছে। এ কারণে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগই ছিল মংডু থেকে উত্তরে বলীবাজার পর্যন্ত এলাকার। এখন সেই অশান্তির আগুন ধীরে ধীরে উত্তর ও দক্ষিণ দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। মিয়ানমার সৈন্যদের আনাগোনা আগের তুলনায় বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিদিনই মানুষ হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটাচ্ছে সেনাবাহিনী। পাশাপাশি উগ্রপন্থী মগেরাও রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে। এ কারণে ৭ কানি জমি ও ৭টি মহিষ ফেলে তিনি পালিয়ে এসেছেন বলে জানান।
তাদেরই মত নির্যাতিত ও আতংকিত শত শত নারী-পুরুষ প্রাণভয়ে প্রতিদিন বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে। গত সপ্তাহে এই পালিয়ে আসার হার কিছুটা কম হলেও গত দুইদিন ধরে অনুপ্রবেশ ও অনুপ্রবেশ চেষ্টা বেড়েছে।
টেকনাফস্থ ২ ব্যাটালিয়ন বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ জানিয়েছেন, শনিবার সকাল থেকে রবিবার সকাল পর্যন্ত তারা রোহিঙ্গা বোঝাই অন্তত ২৫টি নৌকা নাফনদী থেকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। যেসব নৌকার প্রতিটিতে ১০ থেকে ১৫ জন পর্যন্ত রোহিঙ্গা ছিল। এছাড়া কক্সবাজারস্থ ৩৪ বিজিবির আওতাধীন এলাকাতেও শনিবার থেকে রবিবার পর্যন্ত বহু রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ প্রতিহত করা হয়েছে বলে বিজিবি সূত্রে জানা গেছে। তাদের মতে, অরক্ষিত সীমান্তের ফাঁকফোকর দিয়ে কিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে থাকতে পারে। তবে তাদের নজরে আসলে তারা প্রতিহত করছেন। গত দুইদিনে সীমান্তে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ চেষ্টা বৃদ্ধির কথা জানান বিজিবি কর্মকর্তারা।
সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা জানান, দু’পারে দালালচক্রের তৎপরতার কারণে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বাড়ছে। অনুপ্রবেশ রোধ করার জন্য রাখাইনে (আরাকান রাজ্য) রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি সবচেয়ে জরুরি বলে মনে করেন বালুখালী সীমান্তের বাসিন্দা, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটি ও সমন্বয় পরিষদের সভাপতি ইকরামুল কবীর চৌধুরী বাবলু। তিনি মিয়ানমারের উপর তীব্র চাপ সৃষ্টি ও প্রয়োজনে জাতিসংঘের মাধ্যমে বলপ্রয়োগের বিষয়টি নিয়েও ভাবা উচিৎ বলে মনে করেন।
তিনি বলেন- মিয়ানমার ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ সীমান্তে এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি করে নানা ফায়দা হাসিল করছে। এর নেতিবাচক প্রভাবের শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। এ কারণে রাখাইনে উগ্রপন্থারও জন্ম হাতে পারে বলে আশংকা করেন তিনি।
তার মতে, এর শিকার হতে পারে বাংলাদেশও। তার আশংকার সত্যতার প্রমাণ পাওয়া যায় কুতুপালং ও নয়াপাড়া শরণার্থী শিবিরের রোহিঙ্গাদের মুখে। ৯১ সালে মিয়ানমারের বুচিদং থেকে কুতুপালং রেজিস্টার্ড ক্যাম্পে আসা এক শরণার্থীর ঘরে জন্মগ্রহণকারী জালাল আহমদ (১৯) নামের এক যুবকের মতে, বর্তমানে রাখাইনে (আরাকান) যে নির্যাতন চলছে তাতে ওঠতি যুবকদের মনে তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণার সৃষ্টি হচ্ছে। সুযোগ পেলে মিয়ানমারে গিয়ে যুদ্ধ করে মরতেও প্রস্তুত শরণার্থী শিবিরের হাজার হাজার রোহিঙ্গা যুবক।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিয়ানমারে চলমান সহিংসতাকে কেন্দ্র করে উগ্রপন্থার উত্থান ঘটাতে একটি মহল চেষ্টা চালিয়ে আসছে। এদের উদ্দেশ্য সফল হলে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ ওঠতে পারে এবং পরিণতিতে শরণার্থীদের আরো বড় ঢল আসতে পারে।
–
পাঠকের মতামত