
উখিয়া নিউজ ডেস্ক::
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বর্বর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে বানের পানির মতো কক্সবাজার সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আসছে রোহিঙ্গারা। রাখাইন রাজ্য থেকে আসা প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কেউ কেউ অস্ত্র কিংবা মাদক বহন করতে পারে। তা ছাড়া সহায়-সম্বলহীন এসব মানুষকে দেশীয় কোনো জঙ্গি গোষ্ঠী সদস্য হিসেব রিক্রুট করতে পারে। এমন শঙ্কা মাথায় রেখে মানবিক সহায়তার পাশাপাশি শরণার্থী এসব রোহিঙ্গার প্রতি কঠোর গোয়েন্দা নজরদারি চালাচ্ছেন গোয়েন্দারা।
একই সঙ্গে ওই রোহিঙ্গাদের অধিকার লড়াইয়ে থাকার দাবিদার ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’র (এআরএসএ) সশস্ত্র গেরিলা সদস্যরা যাতে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে সেদিকেও নজরদারি অব্যাহত রেখেছেন দেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ ও বিজিবি সদর দফতর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
একাধিক দায়িত্বশীল গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, নিজ দেশের সেনাবাহিনীর নারকীয় হামলা থেকে জানমাল রক্ষায় সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে নির্যাতিত রোহিঙ্গারা। বাংলাদেশ তাদের প্রতি মানবিক। তাই তাদের আশ্রয় দিয়েছে সরকার। কিন্তু এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে যাতে কোনো রোহিঙ্গা ইয়াবা কিংবা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দেশে প্রবেশ করতে না পারে সেদিকে নজর রাখছেন গোয়েন্দা সদস্যরা। মাঠ পর্যায়ে কর্মরত গোয়েন্দাদের কাছে এ বিষয়ে যথাযথ নির্দেশনা দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ, বিজিবি ও র্যাব সদর দফতর।
ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, মিয়ানমার থেকে আসা ভয়াবহ মাদক ইয়াবার চালান বাংলাদেশে ঢোকার উৎসমুখ কক্সবাজার সীমান্ত। সেই বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করছেন গোয়েন্দারা। এর পাশাপাশি রাখাইনের জিহাদি সশস্ত্র গ্রুপ এআরএসএ গেরিলাদের কাছে ভারি অস্ত্র রয়েছে। সেই দলের সদস্যরা যাতে সাধারণ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে সেদিকেও জোর দৃষ্টি দিচ্ছেন গোয়েন্দারা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের কার্যক্রমের দিকে নজর রাখতে বিজিবির গোয়েন্দা ইউনিটের পাশাপাশি এসবি, ডিবি, র্যাব ও এনএসআইয়ের মাঠ পর্যায়ের সদস্যরা কাজ করছেন। এ নজরদারি জোরদার করতে চট্টগ্রাম থেকে যাওয়া গোয়েন্দা সদস্যরাও এখন কক্সবাজার সীমান্তে কাজ করছেন।
সূত্র আরো বলছে, বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়া প্রায় চার লাখ অসহায় রোহিঙ্গাদের উসকে দিয়ে কিংবা রাজনৈতিক কূট চাল দিয়ে দেশকে যাতে অস্থিরতা বা অশান্ত করতে না পারে সেদিকেও নজর রাখছেন গোয়েন্দারা। পাশাপাশি এ বিশাল জনগোষ্ঠী জঙ্গি সংগঠনগুলোর টার্গেট হতে পারে। নির্যাতিত এসব মানুষের মধ্যে থেকে কাউ কাউকে নানা লোভ দেখিয়ে জঙ্গিবাদে জড়ানোর চেষ্টা চালাতে পারে দেশীয় জঙ্গি সংগঠনগুলো। এমন শঙ্কা মাথায় রেখে সেখানে ত্রাণ দিতে আসা এনজিওসহ বেসরকারি সংস্থাগুলোর কার্যক্রমের ওপর নজরজারি অব্যাহত রয়েছে।
অন্যদিকে নিরাপত্তা ইস্যুকে কেন্দ্র করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যেই গঠন করেছে রোহিঙ্গা সেল। এ কার্যক্রম তদারিক করতে প্রশাসনের কয়েক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করছেন।
রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ইয়াবা ও অস্ত্র আসতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। শনিবার নোয়াখালীর কবিরহাটে এক অনুষ্ঠানে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। সরকারে প্রভাবশালী এই মন্ত্রী বলেছেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে সরকার উদ্বিগ্ন। কারণ, এই শরণার্থীদের সঙ্গে কোন ষড়যন্ত্র আবার এখানে আসে।
ওবায়দুল কাদের বলেন, যে জঙ্গিরা মিয়ানমারের সংকট, শরণার্থীদের সঙ্গে সেই জঙ্গির অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে। তাই জঙ্গি, অবৈধ অস্ত্র ও ইয়াবার অনুপ্রবেশের সঙ্গে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রেরও অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে। এসব আশঙ্কা সত্ত্বেও মানবিক বিবেচনায় অসহায়, নির্যাতিত নর-নারী ও শিশুদের আশ্রয় দেয়া হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন মন্ত্রী।
‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’(এআরএসএ) নামের এক গোষ্ঠী নিজেদের রোহিঙ্গাদের সুরক্ষাকারী দাবি করলেও মিয়ানমার সরকার তাদের ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যায়িত করে আসছে শুরু থেকেই। ২৫ আগস্ট ২৪টি পুলিশ চেকপোস্টে সমন্বিত হামলা চালিয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্যকে হত্যার দায় শিকার করে তারা। গত বছরের অক্টোবরেও রাখাইনে পুলিশ ফাঁড়ির ওপর হামলার ঘটনার জন্য দায়ী করা হয় এই গোষ্ঠীটিকে। সবশেষ ওই ২৫ আগস্টের ঘটনার পর রাখাইন রাজ্যে নির্বিচারে রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞ ও বাড়ি-ঘরে আগুন দিচ্ছে দেশটির সেনা সদস্যরা। এরপর থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে ছুটে আসছে নিপীড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী।
বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্র বলছে, এআরএসএর প্রধান নেতা ‘আতাউল্লাহ’ নামে একজন রোহিঙ্গা। সংগঠনটির নেতা আতাউল্লাহ ‘আবু আমর জুনুনি’ নামেও পরিচিত। তার জš§ পাকিস্তানে। মাদরাসা লাইনে পড়াশোনা করেছেন মধ্যপ্রাচ্যে। পরবর্তী সময়ে রাখাইনে গিয়ে দেশটির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী বাহিনী গড়ে তোলেন। এ সশস্ত্র বাহিনীতে কয়েকশ’ রোহিঙ্গা সদস্য রয়েছেন। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে লড়াই করছে বলে সংগঠনটির দাবি।
বিজিবি সূত্র জানায়, দেশের সার্বভৌমত্ব ও যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় কক্সবাজার বিশাল সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এআরএসএ সদস্যরা কিংবা সীমান্তবর্তী কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দেশে প্রবেশ করে যাতে অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি না করতে পারে, সেদিকে নজর রাখছেন বিজিবির সদস্যরা। উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের যেসব ক্যাম্পে বা খোলা জায়গায় আশ্রয় দেয়া হয়েছে, সেসব জায়গায় সাদা পোশাকে নজরদারি অব্যাহত রেখেছে বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান ও অতিরিক্ত ডিএমপি কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত হয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কেউ যাতে তাদের জঙ্গিবাদের দিকে টেনে নিয়ে যেতে না পারে সে ব্যাপারে নজরদারি রাখছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তিনি বলেন, ঝিমিয়ে পড়া জঙ্গিবাদ, এখানে প্রভাব তৈরি করে যাতে তারা কোনো রিক্রুটমেন্টের কাজ না করতে পারে সে বিষয়ে যথাযথ নজরদারি ও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা।
ডিআইজি মনিরুল ইসলাম বলেন, যারা শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মানবিক আচরণ করা হচ্ছে। তবে সবাই আমরা সতর্ক রয়েছি মিয়ানমারে যে মানবিক বিপর্যয় চলছে তার সুযোগ নিয়ে কোনো মহল যাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে। সুত্র: মানবকন্ঠ
পাঠকের মতামত