
ক্যাম্পে থেমে নেই হত্যাকাণ্ড, দিন দিন বাড়ছে অপরাধ
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সোচ্চার থাকা রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার এক বছর আজ। ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের উখিয়ার লাম্বাশিয়া আশ্রয়কেন্দ্রের ডি ব্লকের আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) সংগঠনের কার্যালয়ে বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হন মুহিবুল্লাহ। তিনি ওই সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন।
এরই মধ্যে কানাডায় আশ্রয় মিলেছে মুহিবুল্লাহর পরিবারের সদস্যদের। তবে ক্যাম্পে থেমে নেই হত্যাকাণ্ড। দিন দিন বাড়ছে অপরাধ। এসব ঘটনায় অধিকাংশ রোহিঙ্গা ও সন্ত্রাসীরা জড়িত বলে জানিয়েছে পুলিশ।
মুহিবুল্লাহ হত্যার ঘটনায় ওই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর তার ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ বাদী হয়ে অজ্ঞাতদের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান উখিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সালাহ উদ্দিন। তিনি ২৯ জনের বিরুদ্ধে চলতি বছরের ১৩ জুন আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন।
গত ১২ সেপ্টেম্বর কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ২৯ আসামির বিচার শুরু হয়। জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। বর্তমানে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ফরিদুল আলম বলেন, ‘রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। মামলার শুনানি শেষে আদালত ২৯ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। আসামিদের মধ্যে ১৫ জন আদালতে হাজির ছিলেন। বাকি ১৪ আসামি পলাতক। ৩১ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। পরবর্তী ধার্য দিনে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে।’
কে এই মুহিবুল্লাহ?
মুহিবুল্লাহ (৫০) মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু এলাকার স্কুলশিক্ষক ছিলেন। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সহিংসতার মুখে রাখাইন থেকে কক্সবাজারে সপরিবারে পালিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা হন। এরপর রোহিঙ্গাদের পাশে থেকে প্রত্যাবাসনের জন্য কাজ করেন। এ কারণে মুহিবুল্লাহ বিদেশে বিশেষ করে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে ‘রোহিঙ্গাদের কণ্ঠস্বর’ হিসেবে পরিচিতি পান। কারণ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ভূমিকা ছিল তার। বিশেষ করে মুহিবুল্লাহ কয়েক দফায় সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেন। ইংরেজি ভাষা জানা ও রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের দক্ষতা মুহিবুল্লাহকে ধীরে ধীরে বিদেশিদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। জাতিসংঘ মহাসচিবসহ বিদেশি প্রতিনিধিরা যখনই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গেছেন, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রতিনিধি হিসেবে মুহিবুল্লাহ যোগ দিয়েছেন। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করে আলোচনায় আসেন। জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থায়ও রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন তিনি।
মুহিবুল্লাহকে কেন হত্যা করা হয়েছে?
হত্যাকাণ্ডের পর রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর স্বজন ও অনুসারীরা দাবি করেন, প্রত্যাবাসনবিরোধী এক সশস্ত্র সংগঠন তাকে হত্যা করেছে। সংগঠনটির নেতারা তাকে আগে থেকেই হুমকি দিয়ে আসছিল। কারণ তিনি রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটা অংশ দেশে ফিরতে চায় না। সশস্ত্র দলটির সঙ্গে ‘মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর যোগাযোগ’ রয়েছে বলেও ক্যাম্পের অনেকের বিশ্বাস।
ক্যাম্প ছেড়ে কানাডায় মুহিবুল্লাহর পরিবার
রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যার পর নিরাপত্তাহীনতায় ছিল পরিবারের সদস্যরা। তাই বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় কানাডা সরকার মুহিবুল্লাহর পরিবারকে আশ্রয় দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। এরই অংশ হিসেবে গত ১ এপ্রিল তার পরিবারের ১১ সদস্য কানাডায় যান। সর্বশেষ ২৬ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দফায় মুহিবুল্লাহর পরিবারের আরও ১৪ সদস্য কানাডায় যান।
অশান্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্প
মুহিবুল্লাহকে হত্যার পর থেকে অশান্ত হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প। বিশেষ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্পকেন্দ্রিক সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর টার্গেটে পরিণত হন ক্যাম্পের নেতা ও স্বেচ্ছাসেবকরা। ফলে গত চার মাসে ক্যাম্পে টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হয়েছেন ১৬ রোহিঙ্গা নেতা ও স্বেচ্ছাসেবক।
সচেতন মহল ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে নেতৃত্ব না মানার প্রবণতা, অপরাধ প্রবণতা ও চাঁদাবাজিসহ আধিপত্য বিস্তারের কারণে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটছে। রোহিঙ্গারা যাতে সংঘবদ্ধ হয়ে নিজের অধিকারের কথা বলতে না পারেন, সেজন্য টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হচ্ছেন।
যা বলছে কক্সবাজার জেলা পুলিশ
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলামের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১১৬টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে গত চার মাসে ১৬টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের শিকার রোহিঙ্গারা ক্যাম্পভিত্তিক ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতা (মাঝি) ও স্বেচ্ছাসেবক। বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিনটি টিম আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে। জেলা পুলিশ এপিবিএনকে সহযোগিতা করছে বলে জানান রফিকুল ইসলাম।
এপিবিএনের কাছে যেসব তথ্য আছে
উখিয়া-টেকনাফের ৩২টি ক্যাম্পে আর্মড পুলিশের তিনটি ব্যাটালিয়ন নিরাপত্তায় নিয়োজিত রয়েছে। তাদের তথ্যমতে, ২২ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ এরশাদ (২২) নামে একজন স্বেচ্ছাসেবক খুন হন। ২১ সেপ্টেম্বর খুন হন মোহাম্মদ জাফর (৩৫) নামে এক রোহিঙ্গা নেতা। ১৮ সেপ্টেম্বর খুন হন আরেক স্বেচ্ছাসেবক মোহাম্মদ ইলিয়াস (৩৫)। ৯ আগস্ট দুই রোহিঙ্গা নেতা, ৮ আগস্ট টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক স্বেচ্ছাসেবক খুন হন। ১ আগস্ট একই ক্যাম্পে সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক নেতা মারা যান। ১ আগস্ট উখিয়ার মধুরছড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবক, গত ২২ জুন কথিত আরসা নেতা মোহাম্মদ শাহ এবং ১৫ জুন একই গ্রুপের সদস্য মো. সেলিম (৩০) সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। ১৬ জুন রাতে উখিয়া ক্যাম্পে স্বেচ্ছাসেবক, ১০ জুন কুতুপালংয়ের চার নম্বর ক্যাম্পের আরেক স্বেচ্ছাসেবক, ৯ জুন এক রোহিঙ্গা নেতা, মে মাসে খুন হন রোহিঙ্গা নেতা সানা উল্লাহ (৪০) ও সোনা আলী (৪৬)।
রোহিঙ্গাদের নিয়ে যা ভাবছে স্থানীয়রা
উখিয়ার কুতুপালং এলাকার ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘সম্প্রতি ক্যাম্পের পরিস্থিতি নিয়ে স্থানীয়রা নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। ক্যাম্পভিত্তিক মাঝি (নেতা), সাব-মাঝি ও স্বেচ্ছাসেবকদের খুন করে অবস্থান জানান দিচ্ছে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ক্যাম্পে অপরাধ বাড়বে।’
কক্সবাজার পিপলস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবাল বলেন, রোহিঙ্গারা স্বাভাবিকভাবে নেতা মানতে চান না। কেউ নেতা হয়ে উঠবে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করবে তা মানতে চায় না রোহিঙ্গারা। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গা নেতাদের হত্যা করা হচ্ছে। তবে যারা হত্যা করছে তাদের আইনের আওতায় আনা জরুরি।’
হত্যার দায় স্বীকার করে ভিডিওবার্তা
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চার মাঝিকে হত্যার দায় স্বীকার করে মো. হাসিম (২১) নামে এক রোহিঙ্গা যুবকের ভিডিওবার্তা ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওবার্তায় ক্যাম্পের দায়িত্বরত মাঝিদের কীভাবে কার ইন্ধনে হত্যা করা হয়েছে তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। গত এক মাসে চার নেতা হত্যার বিষয়টি ভিডিওবার্তায় প্রকাশ করেন হাসিম। এতে একটি অস্ত্র হাতে কোন ক্যাম্পের কোন মাঝিকে কীভাবে হত্যা করেছিল, তার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। ভিডিওতে এই রোহিঙ্গা যুবককে বলতে শোনা যায়, ‘আমার মতো ২৫ যুবককে অস্ত্র দিয়েছে ইসলামী মাহাজ গ্রুপ নামে একটি সংগঠন।’
এ ব্যাপারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বরত ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, ‘ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি যাচাই-বাছাই করছি আমরা। একইসঙ্গে ভিডিওতে ওই যুবক যাদের নাম উল্লেখ করেছে, তদন্ত সাপেক্ষ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া ক্যাম্পের নিরাপত্তায় আমরা সবসময় সজাগ রয়েছি। সুত্র: বাংলাট্রিবিউন
ঘটনাপ্রবাহঃ রোহিঙ্গা ক্যাম্প
ক্যাম্প প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ত্রাণপণ্য বিক্রি করছে রোহিঙ্গারা
০৭/১২/২০২৪ ১০:০০ এএমরোহিঙ্গা ক্যাম্পে গোলাগুলিতে নিহত ২
০৯/১০/২০২৩ ১২:০৬ পিএমরোহিঙ্গা ক্যাম্পে অস্ত্র ও মাদক ঠেকাতে অভিযান জোরদার
০৮/১০/২০২৩ ৭:৪২ এএমশিবির ছেড়ে ভাড়া বাসায় থাকছেন রোহিঙ্গা নেতারা
১২/০৪/২০২৩ ১০:৩৩ এএমরোহিঙ্গাদের ‘শরণার্থী’ স্বীকৃতি দিলে কার কতটা লাভ-ক্ষতি?
০৮/০৩/২০২৩ ১০:৫৩ এএমরোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে অশান্তির মূলে কি নবী হোসেন
০৮/০৩/২০২৩ ৯:৩৫ এএমউখিয়া ক্যাম্পে দুর্বৃত্তের গুলিতে রোহিঙ্গা নেতা খুন
০৭/০৩/২০২৩ ৯:২০ এএমভয় দেখিয়ে ক্যাম্পে আগুন দেয় সন্ত্রাসীরা
০৭/০৩/২০২৩ ৭:৩০ এএমরোহিঙ্গা ক্যাম্পের আগুন দুর্ঘটনা নাকি পরিকল্পিত?
০৬/০৩/২০২৩ ৮:০৯ এএমউখিয়ার ক্যাম্পে আগুন নাশকতা কি না খতিয়ে দেখা হচ্ছে
০৫/০৩/২০২৩ ১০:১২ পিএমআগুনে ঘরছাড়া ১২ হাজার রোহিঙ্গা, আটক -১
০৫/০৩/২০২৩ ৯:০০ পিএমউখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরে আগুন নিয়ন্ত্রনে
০৫/০৩/২০২৩ ৬:৪৮ পিএমরোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগুন নিয়ন্ত্রণে যোগ দিয়েছে সেনাবাহিনীও
০৫/০৩/২০২৩ ৬:২৫ পিএমআবারো আগুনে জ্বলছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প
০৫/০৩/২০২৩ ৩:২৪ পিএমরোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের নিরাপদ ঘাঁটি উনছিপ্রাং ক্যাম্প
০৭/১০/২০২২ ৮:২৬ এএমরোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যা: পাঁচ কোটি টাকায় মূলহোতার নাম বাদ দেওয়ার অভিযোগ
২৯/০৯/২০২২ ১১:১৭ এএমরোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধিদের টার্গেট মাঝি ও স্বেচ্ছাসেবক
২৫/০৯/২০২২ ৭:৩৮ এএমরোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে আসছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান
১৫/০৮/২০২২ ১০:২২ পিএম

পাঠকের মতামত