প্রকাশিত: ১৮/০৮/২০১৬ ৯:৫২ পিএম

Masruf-মাসরুফ হোসেন::

২০০৩ সালের এরকম সময়ের কথা। নোকিয়ার কালো মোবাইলটা বেজেই চলছে। দু`চোখ ভর্তি পানি নিয়ে আম্মু কিচেনে রান্না সামলাচ্ছেন, চেষ্টা করছেন নিজেকে ব্যস্ত রাখতে। মোবাইল ফোন বাজতে বাজতে যখন সহ্যের সীমার বাইরে চলে গেলো, এক দুটো ফোন তিনি রিসিভ করা শুরু করলেন। ড্রয়িং রুমের এক কোণে কুঁকড়ে থেকে আমি শুনতে পাচ্ছি একটা দুটো বাক্য-

– না ভাবী, আমার ছেলে ভালো করে নাই।
– রেজাল্ট শুনে কি করবেন? ভালো হয় নাই, পাস করেছে কোন রকম।
– বুয়েটে পরীক্ষা? না ভাবী, ওর জিপিএ থ্রি পয়েন্ট সিক্স, মনে হয় না বুয়েটে পরীক্ষা দিতে পারবে।
– জ্বি ভাবী, সায়েন্স গ্রুপ থেকে। হ্যাঁ, খারাপই হয়েছে ভাবী, কি আর করা।

কিচেন থেকে বের হয়ে আমার প্লেটে খাবার বেড়ে দিলেন। সেদিন আমার প্রিয় সর্ষে ইলিশ ছিল- এই খাবারটা আম্মু সারা বিশ্বব্রম্মান্ডের ভেতরে সম্ভবত সবচাইতে ভালো রান্না করেন। অন্য সময় হলে অন্ততঃ তিন পিস খাই- সেদিন এক কণাও গলা দিয়ে নামছিলো না। আম্মু একটু ঝোল বেড়ে দিলেন, দেখলাম চোখ লাল। বেত খাওয়া পশুর মত মুখ নামিয়ে নিলাম, প্রাণপণ চেষ্টা সত্বেও টপ টপ করে দু`ফোঁটা পানি পড়ল ভাতের উপর। খেয়াল করার মত মানসিক অবস্থা ছিল না, অশ্রুমিশ্রিত মাছের ঝোল সুদ্ধো ভাত মুখে দিলাম নিজেকে ব্যস্ত রাখতে।

মাছ-ভাতের স্বাদের কথা মনে নেই, শুধু এটুকু জানি, হেরে যাবার স্বাদের চাইতে তিক্ত সম্ভবত পৃথিবীর আর কোন কিছু নেই। সেদিনের সর্ষে ইলিশের ঝোল ছিল আমার কাছে এ বিশ্বের সবচাইতে তেতো খাবার, করলা বা চিরতার পানি যার কাছে কিছুই না।

উনিশ বছরের সদ্য কৈশোর পেরুনো সেই ছেলেটির কথা যখন আজ বত্রিশ বছর বয়েসে এসে চিন্তা করি, ভীষন মায়া লাগে জানেন?

সমাজের প্রত্যেকটা কোণ থেকে চোখে আঙুল নয়, তপ্ত লৌহশলাকা প্রবেশ করিয়ে সেই ছেলেটিকে বুঝিয়ে দেয়া হল, সে কোন ভালো কিছুর যোগ্য নয়। সে তার বাবা মায়ের অপমানের কারণ হয়েছে, পরিবারে সে একটা অভিশাপ বিশেষ।

এই কাটা ঘায়ে সবচাইতে সুন্দর করে নুনের ছেঁটা দিত কারা বলুন তো?
– নিকটাত্মীয়ের দল।

“তোর ছেলেটা তো একেবারেই নষ্ট হয়ে গিয়েছে, দেখ মেয়েটাকে নিয়ে কিছু করতে পারিস কিনা”

“কিরে, এত নামকরা ক্যাডেট কলেজে পড়েও কি করল ও?”

“সারাদিন খেলাধুলা আর ডিবেট নিয়ে থাকলে তো রেজাল্টের এই অবস্থা হবেই!”

পরিবারে সবচাইতে গণ্ডমুর্খ, ওয়ার্থলেস বলে যে লোকটিকে সবাই জানে, তারও এক্সপার্ট অপিনিয়ন- ” সায়েন্স পড়ে কি আর সবাই কুলাতে পারে, ওরে আর্টস পড়ালে মনে হয় ভালো হত” ( চিন্তা করে দেখুন, ইনি এক কথায় সাহিত্য, দর্শন ইত্যাদিকে ডাস্টবিনে ফেলে দিলেন)।

শারীরিকভাবে ছয়ফুটের উপর লম্বা সেই ছেলেটি নিজের রুমে গিয়ে প্রতিদিন প্রতিরাত লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদত। তার মা-ও কাঁদত। দু`জনই জানতো দু`জনের কান্নার কথা, কেউ কাউকে বলতোনা।

আজ বত্রিশ বছর বয়েসে এসে আমি জানি, ছেলেটির এবং তার পরিবারের এই যে নরক যন্ত্রণা পোহাতে হয়েছিল- এটি অপ্রয়োজনীয় এবং ভয়াবহ রকমের অন্যায়। এবং প্রতি বছর এই অন্যায় সইতে হয় হাজার হাজার ছেলেমেয়েকে, প্রতি বছর আত্মহত্যা করে ডজন খানেক ছেলেমেয়ে।

কারণ কি?
কারণ হচ্ছে এই অসভ্য, বর্বর, ঈর্ষাকাতর সমাজ বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর দুর্বলতাকে পুঁজি করে বিকৃত আনন্দ লাভ করতে চায়।

সারাবছর একবারও খোঁজ না নেয়া আত্মীয়টিও রেজাল্টের দিন ফোন দেয়, খারাপ রেজাল্ট হলে আরো বেশি করে দেয়।

না, থ্রি পয়েন্ট সিক্স জিপিএ নিয়ে আমি মরে যাইনি। সমাজ যেমন বলেছিলো যে ভিক্ষা করে নইলে বাপের ঘাড়ে বসে সারাজীবন খেতে হবে, তেমনটিও হয়নি।

হ্যাঁ, খুব আহামরি কিছুই হইনি, কিন্তু এই সমাজে বলার মত একটা ছোটখাট পরিচয় আমি ঠিকই আদায় করে নিতে পেরেছি।

সেদিন আমার বাবা মাকে টিটকিরি দেয়া মানুষগুলো আজ প্রায়ই এটা সেটা ঝামেলায় পড়ে তাদের কাছে আসে, আমিও আমার অতিক্ষুদ্র সামর্থ দিয়ে যেটুকু পারি করি।

অথচ আমার যাত্রাটা আরও সহজ হতে পারতো, আরো আনন্দময় হতে পারতো। সমাজের উচিত ছিলো আমাকে বেশি বেশি উৎসাহ দেয়া, যাতে জীবনের কর্কশ বাস্তবতা আমার ভেতরের স্বপ্নালু মনটাকে মেরে ফেলতে না পারে।

আমাদের দেশে মার্ক জুকারবার্গ কেন জন্মায়না জানেন? ঠিক এই কারণে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমরা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করি ছেলেমেয়েদের স্বপ্নকে, তাদের আত্মবিশ্বাসকে। খুব অল্প ক`জন এই নরক থেকে নিজেকে টেনে তুলতে পারে, বাকিরা হারিয়ে যায়।

চলুন না, আজকে থেকে এই স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায় ছটফট করা ছেলেমেয়েগুলোর প্রতি একটু মানবিক আচরণ করি? ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলি, ধুর ব্যাটা, এ লড়াই শেষ লড়াই না- জীবনটা অ-নে-ক বড়!

আমার এ লেখাটি ক`জন পড়বে জানিনা, তবুও যদি কোন স্বপ্নাহত কিশোর কিশোরী এ লেখাটি পড়ে তাদেরকে শুধু তিনটি শব্দ বলব-

“তুমি হারছোনা, বন্ধু!”

পাউলো কোয়েলহোর ওয়ারিয়র অফ লাইটের মত সাত বার পড়ে গিয়ে অষ্টমবার ঠিকই তুমি উঠে দাঁড়াবে- চোখে চোখ রেখে চিৎকার করে বলবে, দ্যাখো, তোমরা বলেছিলে আমি হারিয়ে যাবো, হেরে যাব- ইউ গাইজ আর সো প্যাথেটিকালি রঙ!

সেই দিন পর্যন্ত দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাও। আর হ্যাঁ, জিতে যাবার পর আমাকে একটা ইনবক্স মেসেজ দিতে ভুলোনা কিন্তু!!

লেখক: সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট, বাংলাদেশ পুলিশ (বর্তমানে জাপানে অধ্যয়নরত)

সুত্র : জাগো নিউজ

পাঠকের মতামত

নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোই যখন বড় চ্যালেঞ্জ!

মিয়ানমারের তিনটি প্রধান এথনিক রেজিস্ট্যান্ট গ্রুপ—তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল এলায়েন্স (এমএমডিএ) এবং ...

একটি ফুল—

একটি ফুল, একটি ফুলের জন্যে কতো নিষ্পাপ গাছ প্রাণ হারালো, এই বর্বর শুকোনের দল বারংবার ...