প্রকাশিত: ০৯/১২/২০১৬ ৮:১৮ এএম

তোফায়েল আহমদ

দেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক প্রয়াত নির্মল সেন স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চেয়েছিলেন। সম্ভবত লেখার শিরোনমাটিও ছিল-স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় ১৯৭৩-৭৪ সালে সরকারি ট্রাষ্টের পত্রিকা দৈনিক বাংলায় স্মরণীয় এ লেখাটিতে তিনি লিখেছিলেন কায়রো বিমান দুর্ঘটনার কথাটিও। ১৯৬৫ সালের কায়রো বিমান দুর্ঘটনায় এদেশের অনেক বড় মাপের সাংবাদিক ব্যক্তিবর্গ প্রাণ হারিয়েছিলেন।  দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। এমন এক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঘটনাও মেনে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু মানুষ যখন ঘর থেকে বেরিয়ে স্বাভাবিক ভাবে ঘরে ফিরতে পারেনা-তখনই বলা চলে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। জাতি এরকম অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মুখেও পড়েছিল সেই সময়। ভঙ্গুর আইন-শৃংখলা পরিস্থিতিতেই অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে নির্মল সেন তাঁর আলোচিত সাহসী লেখাটি লিখেছিলেন।

এখন সেই অস্বাভাবিক কোন পরিস্থিতি বা কোন অভাব-অভিযোগ নেই। তবুও কেন মানুষ স্বাভাবিক অবস্থায় থাকছে না-এটাই প্রশ্ন। প্রসঙ্গটি উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র নিয়ে। এটি একটি সরকারি হাসপাতাল। গতকাল খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালটিতে আউটডোরে দৈনিক ৪/৫শ রোগি চিকিৎসা সেবার জন্য যায়। হাসপাতালের ইনডোরেও ভর্ত্তি থাকে ৩০/৩৫ জন রোগি। সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ একটি উপজেলা সদরের একটি সরকারি হাসপাতাল বর্তমানে সন্ত্রাস কবলিত হয়ে রয়েছে। সন্ত্রাসী যারা তারাও এমন নয় যে-একেবারে ‘এরশাদ সিকদারের’ মত। উখিয়া উপজেলার বর্তমান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ, হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ রবিউর রহমান এবং মেডিকেল অফিসার ডাঃ আরিফা মেহের রুমী’র সাথে গতকাল আলাপ হয়েছে এসব প্রসঙ্গ নিয়ে দফায় দফায়। তারা জানিয়েছেন-এরা সবাই ‘পেটি মাস্তান’।

হাসপাতালের এই তিনজন চিকিৎসক আলাপকালে সুসংবাদ মোটেই জানাননি। ডাক্তারদের মুখেই শুনেছি-অনেক দুঃখজনক কথা। তারা বলেছেন-মাত্র ১৮/২০ জন বখাটে হাসপাতালটি জিন্মি করে রেখেছে। তারা সরাকে ধরা মনে করে। হাসপাতালটি যেন এসব বখাটের পৈত্রিক ভিটি-এরকমই ধারণা তাদের। চিকিৎসকদের যত্রতত্র ধমকায় বখাটেরা। তাদের হুমকি ধমকিতে কোন চিকিৎসকই হাসপাতালের কোয়ার্টারে বসবাস করেন না। সর্বশেষ মাত্র কিছুদিন আগেই এক দিন রাত এগারটায় হাসপাতালের কোয়ার্টার ছেড়ে কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছেন ডাঃ আরিফা মেহের রুমী। ডাঃ রুমী আমাকে জানিয়েছেন, বখাটেরা তাকে একজন চিকিৎসক হিসাবেই যেন দেখেননি।

এমবিবিএস ডিগ্রীধারী একজন সরকারি চিকিৎসককে বখাটের দল সন্মান জানানোতো দুরের কথা তাকে মোবাইলে অত্যন্ত বাজে এসএমএস দিয়ে বসত। গত কিছুদিনের মধ্যেই এসব সন্ত্রাসীদের অত্যাচার-নির্যাতনে একদম নিরবে একে একে ৩ জন নারী সহ ৭ জন চিকিৎসক হাসপাতালটি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। এমনকি সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে চলে যাওয়া চিকিৎসকের মধ্যে একজন জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেটের স্ত্রীও রয়েছেন। হাসপাতালমুখি এসব সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে চিকিৎসকরা দলে দলে এলাকা ছাড়ছেন। এটা নিঃসন্দেহে খারাপ সংবাদ।

উখিয়া উপজেলার লোক সংখ্যা আড়াই লক্ষাধিক। তার উপর রয়েছে লক্ষাধিক চিকিৎসা গ্রহণকারি রোহিঙ্গা। সব মিলে হাসপাতালটির উপর চিকিৎসা নির্ভরশীল লোকজনের সংখ্যা কমপক্ষে সাড়ে তিন লক্ষাধিক। অথচ মাত্র ১৮/২০ জন বখাটের উৎপাতে হাসপাতালটিতে চিকৎসকরা ভয়ে থাকছেন না। এগার জন চিকিৎসকের মধ্যে বর্তমানে রয়েছেন মাত্র চারজন। তাও ডাঃ আরিফা মেহের রুমীও চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি গতকাল জানিয়েছেন-গত সোমবার রাতে বখাটেরা হাসপাতাল থেকেই ষষ্ট শ্রেণীর এক ছাত্রীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করার পর তিনিও সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অন্যত্র পাড়ি জমাবেন। বর্তমানে এই চারজন চিকিৎসকই এত বিপুল সংখ্যক লোকজনের চিকিৎসা সেবায় রয়েছেন। বলা যায়-মাত্র গুটি কয়েক মাস্তানের হাতে কেবল উখিয়া সরকারি হাসপাতাল জিন্মি নয়-জিন্মি হয়ে রয়েছে হাসপাতালটির চিকিৎসা সেবা গ্রহনকারি কয়েক লাখ লোক।

উখিয়া হাসপাতালের বিষয়টাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে দেখার কোন সুযোগ নেই। দেশের কারাগার হচ্ছে সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। কারাগারে শত্রু পক্ষের হামলার সুযোগ থাকে না। তবে এমন নিরাপদ স্থানেও ১৯৭৫ এর ৩ রা নভেম্বর খোন্দকার মোশতাকের নির্দ্দেশে চার জাতীয় নেতাকে নির্মম ভাবে হত্যার ঘটনা ঘটেছিল। পরবর্তী নিরাপদ স্থানটি হচ্ছে দেশের হাসপাতাল। যেখানে মানুষ আশ্রয় নেয় মৃত্যু যন্ত্রণা নিয়ে। নিরাপদের এ স্থানটিতে মানুষকে সেবা দেয় চিকিৎসকরা।অসুস্থ চিকিৎসাসেবা গ্রহণকারীকে সেবা দেয় তার স্বজনরা। হাসপাতালের মত সরকারি একটি নিরাপদ স্থানে বখাটের জ্বালায় চিকিৎসক, রোগি এবং রোগির সেবায় নিয়োজিত স্বজনরা যখন নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে তখন মানুষ যাবে কোথায় ? এ জন্যই সাংবাদিক নির্মল সেনের ভাষায় বলতে হচ্ছে-আমি স্বাভাবিক ভাবে বাঁচার গ্যারান্টি চাই।

লেখক-তোফায়েল আহমদ, কক্সবাজারে কর্মরত দৈনিক কালের কন্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার এবং আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) ও বিবিসি’র স্ট্রিঙ্গার। ঃড়ভধুবষপড়ী@ুধযড়ড়.পড়স

পাঠকের মতামত

নতুন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানোই যখন বড় চ্যালেঞ্জ!

মিয়ানমারের তিনটি প্রধান এথনিক রেজিস্ট্যান্ট গ্রুপ—তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল এলায়েন্স (এমএমডিএ) এবং ...

একটি ফুল—

একটি ফুল, একটি ফুলের জন্যে কতো নিষ্পাপ গাছ প্রাণ হারালো, এই বর্বর শুকোনের দল বারংবার ...