নাফ নদের ৩৩ কি.মি. ও সেন্টমার্টিন পর্যন্ত ২০ কিমিতে বসেছে ৬ রাডার

সীমান্ত ও সমুদ্রে নজরদারিতে রাডার ড্রোন থার্মাল ক্যামেরা

ডেস্ক নিউজ
প্রকাশিত: ২৬/০৯/২০২৫ ৮:২০ এএম

এবার দেশের সীমান্ত ও সমুদ্র সুরক্ষায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির নজরদারি রাডার, ড্রোন ও থার্মাল ক্যামেরা যুক্ত করা হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে মাদক, অস্ত্র, চোরাচালান, মানব পাচার, বিভিন্ন ধরনের অপরাধ ও রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্ত এবং জলসীমায় এসব অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নজরদারি ও নিরাপত্তাবলয় গড়ে তুলেছে সীমান্ত সুরক্ষার অতন্দ্র প্রহরী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এছাড়া দেশের অভ্যন্তরীণ জলসীমায় এবং সীমান্তজুড়ে টহল জোরদার করা হয়েছে।

এর ফলে এক মাসে সাগরপথে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাচারের উদ্দেশ্যে বন্দি করে রাখা নারী ও শিশুসহ দুইশতাধিক লোককে উদ্ধার করেছে। এছাড়া বিপুল পরিমাণ মাদক, অস্ত্র ও গোলাবরুদ উদ্ধার করা হয়েছে। ২০ পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করেছে। প্রতিবেশী দেশে পাচারের উদ্দেশ্যে বহন করা কয়েক কোটি টাকার ডাল, রসুন, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন মালামাল উদ্ধার করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, নাফ নদের ৩৩ কিলোমিটার ও শাহপরীর দ্বীপ থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত বিস্তৃত সমুদ্রপথের জলসীমার ২০ কিলোমিটারজুড়ে নজরদারির জন্য অত্যাধুনিক ৬টি সার্ভিলেন্স রাডার বসানো হয়েছে। এ রাডারের মাধ্যমে দীর্ঘ পাঁচ কি.মি. এলাকায় যে কোনো ধরনের বস্তুর উপস্থিতি ও গতিবিধি সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব। নাফ নদের জেটিতেও বসানো হয়েছে সার্ভিলেন্স রাডার।
টেকনাফ বিজিবি-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিকুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, এসব অত্যাধুনিক প্রযুক্তির চোখ ফাঁকি দিয়ে কোনো কিছু প্রবেশ করা এখন প্রায়ই অসম্ভব হবে। এর ফলে সীমান্ত এবং সমুদ্রের জলসীমায় কারও পক্ষে কোনো ধরনের অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ থাকবে না। ইতোমধ্যে সুফল পাওয়া যাচ্ছে। বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য উদ্ধার ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকানো গেছে। মানব পাচারকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাচারের উদ্দেশ্যে বন্দি জীবন থেকে কয়েক শতাধিক লোককে উদ্ধার করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সূত্র জানায়, দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে প্রতিদিন অবৈধ উপায়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক ও ভারি অস্ত্রের চালান। একই সঙ্গে সীমান্ত পেরিয়ে, এমনকি জেলেবেশে ট্রলারযোগে রোহিঙ্গাদের অবৈধ অনুপ্রবেশ ঘটছে। প্রায় সময়ই বিজিবি, কোস্ট গার্ড, এমনকি নৌবাহিনীর অভিযানে ধরা পড়ছে অস্ত্র, মাদকের চালান আর অবৈধ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গারা।

এ নিয়ে গণমাধ্যমে একাধিক সংবাদ প্রকাশ হলে টনক নড়ে সীমান্ত নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বিজিবিসহ স্থানীয় প্রশাসনের। পরবর্তীতে অবৈধ অনুপ্রবেশ ও অস্ত্র, মাদকের চালান রোধে সীমান্তজুড়ে এবং নাফ নদ সংলগ্ন সমুদ্রপথের জলসীমায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল ও নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়।
গত ২২ সেপ্টেম্বর টেকনাফের রাজাছড়া গহীন পাহাড়ে মানব পাচারচক্রের ঘাঁটিতে অভিযান চালিয়ে পাচারকারীর হাত থেকে ৮৪ জন উদ্ধার করেছে বিজিবি। টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. আশিকুর রহমান জনকণ্ঠকে জানান, ২২ সেপ্টেম্বর দুপুরে বিজিবি ও র‌্যাবের সমন্বয়ে অভিযান চালিয়ে তাদের উদ্ধার করা হয়। অভিযানে কয়েকটি পাহাড়ে মানব পাচারচক্রের একাধিক ঘাঁটির সন্ধান পাওয়া যায়। এসব ঘাঁটি থেকে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পাচারের উদ্দেশ্যে জড়ো করা ৮৪ জনকে উদ্ধার করা হয়। মানব পাচারচক্রের ঘাঁটিগুলোতে তল্লাশি চালিয়ে ৩টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এখনো অভিযান চলমান।
এরই ধারাবাহিকতায় ৯ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ৯টার দিকে গোপন সংবাদে বিজিবির উখিয়া ৬৪ ব্যাটালিয়নের অধীন বালুখালী বিওপির একটি বিশেষ টহল দল সীমান্ত পিলার বিডি-২১ সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান নেন। এ সময় মিয়ানমারের দিক থেকে ১০-১২ জনের এক সংঘবদ্ধচক্র বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করলে বিজিবি সদস্যরা তাদের চ্যালেঞ্জ করে। তখন চোরাকারবারিরা দেশীয় অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা প্রদর্শন করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের চেষ্টা করে।

উপস্থিত বিজিবি সদস্যরা সাহসের সঙ্গে তাদের মোকাবিলা করে এবং চাপের মুখে তারা খালে ঝাঁপিয়ে পড়ে ও সাঁতরে মিয়ানমারের দিকে পালিয়ে যায়। পরে তল্লাশি চালিয়ে খালের পাড়ে সাদা পলিথিনে মোড়ানো দুটি প্যাকেটের ভেতরে নীল রঙের বায়ুরোধী ২৮ কার্টনে মোট ২ লাখ ৮০ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করে বিজিবি। উদ্ধার করা ইয়াবাগুলো উখিয়া থানায় হস্তান্তরের পাশাপাশি আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে উখিয়া ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন জানান, পালিয়ে যাওয়া মাদক কারবারিদের শনাক্ত করা হয়েছে এবং তাদের গ্রেপ্তারে গোয়েন্দা নজরদারি আরও জোরদার করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, বিজিবি শুধু সীমান্ত সুরক্ষা নয়, মাদক ও চোরাচালান প্রতিরোধেও সব সময় কঠোর অবস্থান নিয়ে কাজ করছে। ভবিষ্যতেও এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
এদিকে কোস্ট গার্ডের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার সিয়াম-উল-হক জানান, ১৮ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত ১১টার দিকে কোস্ট গার্ডের একটি জাহাজ সেন্টমার্টিনের ছেড়াদ্বীপ সংলগ্ন সাগর এলাকায় বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে ওই এলাকায় সন্দেহজনক একটি ফিশিং বোটে তল্লাশি চালিয়ে প্রায় ৩৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা মূল্যের ডাল, মশার কয়েল, রসুন, টেস্টিং সল্ট, রয়েল টাইগার এনার্জি ড্রিঙ্কস, পেঁয়াজসহ ১০ পাচারকারীকে আটক করা হয়।
সিয়াম-উল-হক জানান, একইদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত গোপন সংবাদে কোস্ট গার্ড ও নৌবাহিনীর একটি যৌথ দল কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়ার গহীন ও দুর্গম পাহাড়ে অভিযান পরিচালনা করে। সেখান থেকে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাচারের উদ্দেশ্যে বন্দি করে রাখা নারী ও শিশুসহ ৬৬ জনকে উদ্ধার করা হয়।
বিজিবি সূত্রে জানা যায়, মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নাফ নদের জেটিতে বসানো হয়েছে অত্যাধুনিক সার্ভিলেন্স রাডার। এটির পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় বস্তুর অবস্থান, গতি ও উপস্থিতি সহজেই শনাক্ত করার সক্ষমতা রয়েছে। নাফ নদের ৩৩ কিলোমিটার এবং শাহপরীর দ্বীপ থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার এলাকা নজরদারির জন্য বসানো হয়েছে ছয়টি সার্ভিলেন্স রাডার।

বিজিবির দাবি, এর ফলে অত্যাধুনিক এসব সরঞ্জামের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে দেশের অভ্যন্তরে কোনো কিছু প্রবেশ করা এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে টেকনাফ ২ বিজিবির সার্ভিলেন্স রাডার অপারেটর মো. আজিজুল হক জানান, এ রাডার সর্বোচ্চ ৯৬ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত কাজ করে। এক নটিক্যাল মাইল সমান এক দশমিক ৮০০ কিলোমিটার। ৫ কিলোমিটার এলাকায় অপারেশন কার্যক্রম চালালে প্রত্যেকটি নৌকা ধরতে পারি। একটি নৌকা যখন মিয়ানমার থেকে বের হয় আমরা তার অবস্থান সহজে জানতে পারি।
বিজিবি সূত্র জানায়, শুধু এ রাডার নয়, বিজিবিতে যুক্ত হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ড্রোন ও থার্মাল ক্যামেরা। ড্রোনের মাধ্যমে দুর্গম এলাকা যেমন সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে, ঠিক তেমনি থার্মাল ক্যামেরায় অন্ধকার রাত কিংবা বৈরি আবহাওয়াতেও দুই কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত শনাক্ত হচ্ছে যে কোনো বস্তুর অবস্থান, গতি ও উপস্থিতি।
টেকনাফ-২ বিজিবির ড্রোন অপারেটর আলহাজ হোসেন জানান, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ড্রোনের মাধ্যমে অপরাধীদের শনাক্ত করে আটক করা সম্ভব। এছাড়া দুর্গম জালিয়া দ্বীপে ড্রোন পাঠিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে সেখানকার সার্বিক পরিস্থিতি।
টেকনাফ-২ বিজিবির থার্মাল অপারেটর নায়েক মাহাবুব আলম বলেন, মিয়ানমার থেকে কোনো লোক সাঁতার কেটে অবৈধ অনুপ্রবেশ করলে খুব সহজেই শনাক্ত করা যাবে।
এ বিষয়ে টেকনাফ ব্যাটালিয়ন-২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, সীমান্তে মোতায়েন করা জনবলের সামর্থ্য বৃদ্ধির জন্য এবং সীমান্ত ও সমুদ্রের জলসীমা দিয়ে অস্ত্র, মাদক এবং অবৈধপথে রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঠেকাতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটানো হয়েছে।

পাশের রাষ্ট্রে আমাদের এখান থেকে কিছু নৌযানের সন্দেহজনক গতিবিধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফলে যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে, যা আমরা আন্তঃবাহিনী সমন্বয়ের মাধ্যমে সংশ্লি­ষ্ট বাহিনীগুলোকে নিয়মিত তথ্য দিয়ে যাচ্ছি। যে জায়গা নিয়ে সংশয় তৈরি বা নিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে এটা আমরা খতিয়ে দেখছি। তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণেও আন্তঃবাহিনীর সহায়তা নিয়েও কাজ করা হচ্ছে।

পাঠকের মতামত

তদন্তের নির্দেশ চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজিকেটেকনাফে হত্যা মামলার এজাহার পাল্টে দিল পুলিশ

কক্সবাজারের টেকনাফে একটি হত্যা মামলার এজাহার পুলিশ কর্মকর্তারা পরিবর্তন করে দিয়েছেন- এমন অভিযোগে আদালতে মামলা ...

ইউএনএইচসিআর ’এর প্রতিবেদনবাংলাদেশে নতুন অনুপ্রবেশকারি রোহিঙ্গা দেড় লাখের বেশি

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনী এবং আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘাত পুনরায় শুরু হওয়ার ফলে ২০২৩ সালের ...

ব্র্যাক আয়োজিত সংলাপে নারীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে ৫ দফা সুপারিশ

সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দেশে ‘আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক’ কর্ম ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ আশাব্যঞ্জক নয়। সম্প্রতি ব্র্যাকের ...

বিমানে কক্সবাজার থেকে ঢাকায় বিপুল পরিমাণ ইয়াবা আনছিলেন মা-মেয়ে

ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৭৫৮০ পিস ইয়াবাসহ দুই যাত্রীকে গ্রেফতার করেছে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ...