
বছরের বেশির ভাগ সময় কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিন দ্বীপে নৌচলাচল বন্ধ থাকে। আর সচরাচর দ্বীপের বাইরেও যান না বাসিন্দারা। একান্ত প্রয়োজনে কেউ কেউ উপজেলা সদর টেকনাফে যাতায়াত করেন। তবে সুলতান ও তাঁর স্ত্রী হাজেরা টেকনাফেও কম গেছেন। সুলতান সারা জীবনে মাত্র তিনবার গেছেন কক্সবাজার। তা-ও চিকিৎসা নিতে। ঢাকা তো দূরের কথা, কখনো চট্টগ্রাম শহরেও যাননি তিনি। বড় বড় শহর দেখা হয়নি তাঁর। তবু এ নিয়ে আক্ষেপ নেই। জীবনে আনন্দ আর সুখের উপলক্ষের কমতি নেই। মাছ ধরা, খেতের ফসল তোলা বা পারিবারিক-সামাজিক যেকোনো উপলক্ষ ঘিরে আনন্দ খুঁজে নিয়েছেন তাঁরা। ঢাকা-চট্টগ্রাম না গেলেও প্রতিবছর ওই দুই শহর থেকে আসা পর্যটকের সঙ্গে দেখা হয় তাঁদের। শহরের মানুষেরা কেমন, বুঝতে পারেন তাঁদের দেখেই।
আব্দুল কুদ্দুস, প্রথমআলো
কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পশ্চিমপাড়ার পাশেই সমুদ্র। রাতের বেলায় যখন প্রকৃতি নীরব হয়ে ওঠে, তখন সাগরের গর্জনও কানে আসে। পাড়ার সীমানায় দাঁড়ালে দেখা যায় সাদা বালুর ওপর নীল ঢেউয়ের আছড়ে পড়া। এই পাড়ার ছোট একটা টিনশেড ঘরে থাকেন দম্পতি সুলতান আহমদ(৯০) ও হাজেরা বেগমের (৮০)। একসময় সুলতান সাগরে মাছ ধরতেন। এখন অবসর নিয়েছেন। সাত মেয়ের সবার বিয়ে হয়েছে। সুলতান দম্পতিকে তাঁরাই এখন দেখাশোনা করেন।
বছরের বেশির ভাগ সময়ই সেন্ট মার্টিন দ্বীপে নৌচলাচল বন্ধ থাকে। আর সচরাচর দ্বীপের বাইরেও যান না বাসিন্দারা। একান্ত প্রয়োজনে কেউ কেউ উপজেলা সদর টেকনাফে যাতায়াত করেন। তবে সুলতান ও তাঁর স্ত্রী হাজেরা টেকনাফেও কম গেছেন। সুলতান সারা জীবনে মাত্র তিনবার গেছেন কক্সবাজার। তা–ও চিকিৎসা নিতে। ঢাকা তো দূরের কথা, কখনো চট্টগ্রাম শহরেও যাননি তিনি। বড় বড় শহর দেখা হয়নি তাঁর। তবু এ নিয়ে আক্ষেপ নেই।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের এই বৃদ্ধ দম্পতির জীবনে আনন্দ আর সুখের উপলক্ষের কমতি নেই। মাছ ধরা, খেতের ফসল তোলা বা পারিবারিক-সামাজিক যেকোনো উপলক্ষ ঘিরে আনন্দ খুঁজে নিয়েছেন তাঁরা। ঢাকা-চট্টগ্রাম না গেলেও প্রতিবছর ওই দুই শহর থেকে আসা পর্যটকের সঙ্গে দেখা হয় তাঁদের। শহরের মানুষেরা কেমন, বুঝতে পারেন তাঁদের দেখেই।
সম্প্রতি দ্বীপের পশ্চিমপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, ঘরের উঠানে বসে আছেন সুলতান ও তাঁর স্ত্রী হাজেরা। পরিচয় হওয়ার আগেই তাঁরা অভ্যর্থনা জানান। বসতে বলেন। তারপর আলাপ শুরু। কথায় কথায় জানা গেল, তাঁদের শান্ত-নিরুদ্বিগ্ন জীবনের গল্প। জানালেন, দুজনের কেউ কখনো বড় শহরে যাননি। কেন, জানতে চাইলে তাঁদের সহজ-সরল উত্তর, প্রয়োজন হয়নি তাই।
ভাত, শুঁটকি মাছ আর ঘরের মাচায় হওয়া লাউয়ের শাক রান্না হয়েছে সেদিন। মাছ, শুঁটকি নিয়মিত থাকে তাঁদের খাবারের তালিকায়। কালেভদ্রে মুরগি বা গরুর মাংস খান। একবার পড়ে গিয়ে আঘাত পাওয়া ছাড়া তেমন কোনো শারীরিক সমস্যায় ভোগেননি সুলতান আহমদ। জানালেন, ওই দুর্ঘটনার পর ভাতিজা মৌলভি নুর মোহাম্মদ তাঁকে দুইবার ডাক্তার দেখাতে কক্সবাজারের একটি হাসপাতালে নিয়ে গেছেন। ওই দুইবারসহ মোট তিনবার কক্সবাজার শহরে গেছেন। প্রতিবারই স্ত্রী হাজেরাও ছিলেন সঙ্গে।
নাগরিক জীবনের অনেক বিনোদনের সঙ্গে পরিচয়ই নেই এই দম্পতির। টেলিভিশন দেখেন না তাঁরা। স্মার্টফোন দেখেছেন দুই একবার। রিল বা ভিডিওর সঙ্গে পরিচয়ও নেই তাঁদের। দুজনের কেউ জানেন না লেখাপড়াও।
সুলতান বলেন, যা যা শেখার নিজের বাবার কাছ থেকে শিখেছেন তিনি। মাছ ধরা, চাষ করা, জাল বোনা, মেরামত, নৌকা বাওয়া সবকিছু। সবচেয়ে কঠিন কাজ সাগরে টিকে থাকা। ঝড়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া। সে সবও ভালোই রপ্ত করেছেন তিনি। জানেন সাগরের কোন আচরণের কী অর্থ। এসব জানলেও লেখাপড়াটা হয়নি তাঁর। এ জন্য আফসোস আছে। তবে লেখাপড়া জানলেও জীবনে খুব একটা উনিশ-বিশ হতো না বলে জানান তিনি।
সুলতানের ভাতিজা মৌলভি নুর মোহাম্মদ সেন্ট মার্টিনের দোকান মালিক সমিতির সহসভাপতি। দ্বীপে দোকান আছে তিন শতাধিক। নুর মোহাম্মদ (৫০) প্রথম আলোকে বলেন, দ্বীপের ১১ হাজার মানুষের মধ্যে অন্তত ৯০ শতাংশ মানুষ এখনো রাজধানী ঢাকা দেখেননি। বেশির ভাগ মানুষ এমনকি চট্টগ্রামেও যাননি কখনো। ব্যবসা বা চিকিৎসার প্রয়োজন ছাড়া সচরাচর বড় শহরে দ্বীপের লোকজন যান না। তাঁর চাচা-চাচিও সেই দলে পড়েন।
সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমদ খান বলেন, দ্বীপের ৮০ শতাংশ মানুষ মৎস্যজীবী। বাকিরা চাষাবাদ-ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। ব্যবসা, চিকিৎসা, বিদেশযাত্রা ছাড়া দ্বীপের মানুষের কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ঢাকায় তেমন যাওয়া হয় না। সারা দেশের মানুষ সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে আসেন। তাতে তাঁদের দেশ দেখা হয়ে যায়।
শহরে যাওয়া নিয়ে কোনো আফসোস না থাকলেও একটা বিষয় নিয়ে খানিকটা কৌতূহল রয়ে গেছে সুলতানের। কথার এক ফাঁকে হেসে বললেন, ‘এই দ্বীপে কোনো শেয়াল নেই। শেয়াল কেমন, আমরা জানি না। বাবা কক্সবাজারে দেখছিলেন কয়েকবার। আমাদের কাছে গল্প করেছেন। কিন্তু আমরা ভাইবোনেরা দেখিনি। হুক্কাহুয়া ডাকও শুনিনি।’
পাঠকের মতামত