ডেস্ক নিউজ
প্রকাশিত: ০৩/০৯/২০২৫ ৭:২৪ পিএম

কক্সবাজার বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের জন্য সুপরিচিত। এবার সেই পর্যটননগরীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বিমান অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর একটি। কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে কক্সবাজার বিমানবন্দর সম্প্রসারণের কাজ প্রায় শেষ। আগামী ২ অক্টোবর থেকে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক মর্যাদা পাচ্ছে।

রানওয়ে সম্প্রসারণ, নতুন টার্মিনাল ভবন, নিরাপত্তা ও ইমিগ্রেশন ব্যবস্থাসহ সবকিছুই প্রায় প্রস্তুত। কিন্তু এত বিপুল বিনিয়োগ ও প্রস্তুতির পরও আশংকা রয়ে যাচ্ছে—আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু করতে এয়ারলাইনগুলো কবে প্রস্তুত হবে?

সরকারের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা ও এয়ারলাইনগুলোর বাণিজ্যিক বাস্তবতার মধ্যে তৈরি হয়েছে এক অদৃশ্য টানাপোড়েন। ফলে শঙ্কা দেখা দিয়েছে—কক্সবাজার বিমানবন্দর কি সত্যিই আন্তর্জাতিক মানচিত্রে জায়গা করে নেবে, নাকি অবকাঠামো উন্নয়নের গল্পেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে?

কক্সবাজার বিমানবন্দরটির ইতিহাস অনেক পুরোনো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সামরিক প্রয়োজনে এটি নির্মিত হয়। স্বাধীনতার পর থেকে কেবল অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের জন্য ব্যবহৃত হলেও কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতের খ্যাতি ও পর্যটন সম্ভাবনার কারণে দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিকীকরণের দাবি উঠছিল। তবে বাস্তব পদক্ষেপ শুরু হয় প্রায় এক দশক আগে। তখন মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র, সরাসরি রেল সংযোগসহ একাধিক মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।

সরকারের পরিকল্পনা ছিল, কক্সবাজারকে শুধু পর্যটন শহর নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার একটি শক্তিশালী এভিয়েশন ও অর্থনৈতিক হাব হিসেবে গড়ে তোলা। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিমানবন্দরটিকে “দুবাইয়ের মতো উড়োজাহাজ রিফুয়েলিং গেটওয়ে” করার স্বপ্নও দেখিয়ে ছিলেন। সেই স্বপ্ন থেকেই শুরু হয় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রূপান্তর।

চার হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে সম্প্রসারিত হয়েছে রানওয়ে। দৈর্ঘ্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯,০০০ ফুটে, প্রস্থ ২০০ ফুট। সমুদ্রের ভেতর পর্যন্ত বিস্তৃত করে ১০,৭০০ ফুট পর্যন্ত রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজ চলছে, যা ওয়াইড বডির উড়োজাহাজকেও পূর্ণ সক্ষমতায় ওঠানামার সুযোগ করে দেবে।

এ ছাড়া ৩৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত নতুন আন্তর্জাতিক টার্মিনাল ভবনের কাজ শেষ হওয়ার কথা ৩০ সেপ্টেম্বর। বছরে ১৮ লাখ যাত্রী সেবা দেওয়ার সক্ষমতা থাকবে এই টার্মিনালে, যা বর্তমানের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।

বেবিচকের সদস্য (পরিচালনা ও পরিকল্পনা) এয়ার কমডোর আবু সাঈদ মেহবুব খান জানান, ২ অক্টোবর থেকে কক্সবাজার বিমানবন্দর আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক মর্যাদা পাবে। প্রথমদিকে সীমিত আকারে ফ্লাইট শুরু হতে পারে, তবে আগামী মার্চ নাগাদ ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।

এরই মধ্যে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ও ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেওয়া হয়েছে। বিদেশি এয়ারলাইনগুলোও একইভাবে চিঠি পেয়েছে। তবে এখনো কোনো এয়ারলাইন কক্সবাজার থেকে আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট চালুর ঘোষণা দেয়নি।

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মুখপাত্র কামরুল ইসলাম জানান, ঢাকা–কক্সবাজার–ব্যাংকক রুট তাদের বিবেচনায় আছে। তবে যাত্রী পর্যাপ্ত না হলে রুট পরিচালনার খরচ মেটানো সম্ভব হবে কি না, সেটিই বড় প্রশ্ন।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সও কিছু সম্ভাব্য রুট যাচাই করছে, কিন্তু সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। বিদেশি এয়ারলাইনগুলোও দ্বিধায় আছে।

এয়ার অ্যারাবিয়ার এক কর্মকর্তা বলেন, আগ্রহ রয়েছে, তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পর।

এয়ারলাইন্স অপারেটরস কমিটির সভাপতি দিলরুবা আখতারও স্বীকার করেছেন, এখনো কোনো এয়ারলাইন কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালুর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি।

কেন এই দ্বিধা? মূলত কক্সবাজারে পর্যটন অবকাঠামোর ঘাটতি বড় কারণ। যদিও কক্সবাজারে হাজারো হোটেল-মোটেল রয়েছে, তবে বিশ্বমানের রিসোর্ট, বিনোদনকেন্দ্র বা আন্তর্জাতিক পর্যটকের জন্য আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা এখনো গড়ে ওঠেনি। সঠিক ব্র্যান্ডিংয়ের অভাবও রয়েছে।

ইউএস-বাংলার মুখপাত্র মন্তব্য করেন, নেপালে সমুদ্রসৈকত নেই, তবুও তারা বিশ্বপর্যটন মানচিত্রে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে কেবল কার্যকর ব্র্যান্ডিংয়ের কারণে। কক্সবাজারে সেই উদ্যোগ চোখে পড়ে না। বিদেশি পর্যটক আনতে হলে আন্তর্জাতিক মানের প্রচারণা চালাতে হবে।

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) প্রায় এক দশক আগে কক্সবাজারে তিনটি ট্যুরিজম পার্ক গড়ার পরিকল্পনা নেয়। এর মধ্যে সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, নাফ ট্যুরিজম পার্ক এবং সোনাদিয়া ইকো ট্যুরিজম পার্ক অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে পরিবেশগত কারণে সোনাদিয়া প্রকল্প বাতিল হয়। সাবরাং পার্ক কিছুটা অগ্রগতি পেলেও অবকাঠামোগত ঘাটতির কারণে হোটেল-রিসোর্ট নির্মাণ আটকে আছে।

আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক সিভিল অ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইসিএও)-র মানদণ্ড পূরণ করতে কক্সবাজার বিমানবন্দরে আধুনিক রানওয়ে, ট্যাক্সিওয়ে, আলোকসজ্জা, ন্যাভিগেশন সিস্টেম, ইমিগ্রেশন, কাস্টমস ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু সম্প্রসারিত রানওয়ে পুরোপুরি চালু হতে এখনো আলোকসজ্জা, ইন্সট্রুমেন্ট ল্যান্ডিং সিস্টেম এবং ফ্লাইট ক্যালিব্রেশনের কাজ শেষ হয়নি। ফলে বিমান চলাচলে কিছু সীমাবদ্ধতা থেকে যাচ্ছে। নতুন টার্মিনাল ভবন চালু হলে যাত্রীসেবার মান অনেকটা বাড়বে।

বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ১,৫০০ থেকে ২,০০০ যাত্রী এই বিমানবন্দর ব্যবহার করছে। আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু হলে এই সংখ্যা দ্বিগুণ বা তারও বেশি হবে বলে আশা করছেন বিমানবন্দরের পরিচালক গোলাম মর্তুজা হাসান। তিনি বলেন, নতুন টার্মিনালের ফলে যাত্রীসেবা দ্বিগুণ হবে, নিরাপত্তা ও আরামদায়ক ভ্রমণের সুযোগও বাড়বে।

কক্সবাজার বিমানবন্দরকে ঘিরে শুধু পর্যটন নয়, রপ্তানি খাতেও নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে। এখানকার সামুদ্রিক মাছ, চিংড়ি, শুকনো মাছ ও কৃষিপণ্য সরাসরি আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করা গেলে অর্থনীতিতে বড় ধরনের গতি আসবে। বেবিচকও ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক কার্গো অপারেশন চালুর পরিকল্পনা করছে।

তবে বাস্তবতা হলো, রানওয়ে ও টার্মিনাল প্রস্তুত থাকলেও এয়ারলাইনগুলো প্রস্তুত নয়। পর্যটন অবকাঠামোর ঘাটতি, আন্তর্জাতিক প্রচারণার অভাব এবং অনিশ্চিত যাত্রীচাহিদা এখন প্রকল্পের বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারের লক্ষ্য এই বিমানবন্দরকে কেবল অবকাঠামো উন্নয়নের প্রতীক নয়, বরং দক্ষিণ এশিয়ার একটি আন্তর্জাতিক হাব হিসেবে দাঁড় করানো। কিন্তু সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে শুধু রানওয়ে বা টার্মিনাল নয়, প্রয়োজন হবে পূর্ণাঙ্গ পর্যটন অবকাঠামো, বিশ্বমানের হোটেল-রিসোর্ট, বিনোদনকেন্দ্র ও ব্র্যান্ডিং কৌশল।

নিয়ম অনুযায়ী, কোনো অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক ঘোষণা করতে হলে আইসিএও-র কিছু গাইডলাইন মানতে হয়। বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে সেই গাইডলাইন মেনেই কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মর্যাদা দিয়েছে। গত ৭ আগস্ট বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) আইসিএওকে এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি দেশের বিমান খাত ও পর্যটন শিল্পের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।

কক্সবাজার বিমানবন্দর যদি পূর্ণমাত্রায় আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করতে পারে, তবে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে। এতে হোটেল-মোটেল ব্যবসা, রিসোর্ট, পরিবহন খাত ও স্থানীয় অর্থনীতি নতুন গতিশীলতা পাবে। শুধু অবকাশযাপন নয়, আন্তর্জাতিক সম্মেলন, করপোরেট ইভেন্ট ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম আয়োজনও সহজ হবে। এর ফলে স্থানীয় কর্মসংস্থানও বাড়বে বহুগুণে।

২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে বিমানবন্দরের উন্নয়নকাজের প্রথম ধাপ শুরু হয়। ২০১৫ সালে যোগ হয় আন্তর্জাতিকীকরণের নতুন ধাপ। ভৌগোলিকভাবে কক্সবাজার দক্ষিণ এশিয়ার এক কৌশলগত পয়েন্ট। এ জন্য সরকার চায়, কক্সবাজারকে শুধু পর্যটক নয়, বরং আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের রিফুয়েলিং ও টেকনিক্যাল ল্যান্ডিংয়ের আঞ্চলিক হাব হিসেবে গড়ে তুলতে।

সব মিলিয়ে কক্সবাজার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বাংলাদেশের জন্য এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সরকারের স্বপ্নকে সফল করতে হলে এয়ারলাইনগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ, পর্যটন অবকাঠামোর দ্রুত উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কার্যকর ব্র্যান্ডিং অপরিহার্য। অন্যথায় কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ শুধু অবকাঠামোর সৌন্দর্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে। কক্সবাজার তাই এখন এক অমোঘ প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে—এই বিমানবন্দর কি সত্যিই দক্ষিণ এশিয়ার আকাশে বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়াবে, নাকি স্বপ্নের আধুনিক টার্মিনাল কেবল সম্ভাবনার গল্প হয়ে থাকবে?

পাঠকের মতামত

আসিয়ান পার্লামেন্টারিয়ান দলের বৈঠক ও রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন

কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক ও বর্তমান সংসদ সদস্যদের সংগঠন আসিয়ান ...