প্রকাশিত: ২৮/০২/২০১৮ ৩:৪৮ পিএম , আপডেট: ১৭/০৮/২০১৮ ৬:০২ এএম

ডেস্ক রিপোর্ট ::
কক্সবাজারের টেকনাফ থেকে ৭ লাখ ৩০ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি দল। কিন্তু মামলার নথিপত্রে উদ্ধারকৃত ইয়াবার পরিমাণ দেখানো হয়েছে স্রেফ ৮ হাজার পিস। অবশিষ্ট ৭ লাখ ২২ হাজার পিস ইয়াবা স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এমন বিস্ময়কর অভিযোগ তুলেছেন খোদ পুলিশেরই আরেক কর্মকর্তা বশির আহম্মাদ। উপপরিদর্শক পদমর্যাদার এ কর্মকর্তা পুলিশ সদর দপ্তরের আইজিপি কমপ্লেইন্টস মনিটরিং সেল ও কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (এসপি) বরাবর লিখিতভাবে এই অভিযোগ করেছেন।

এসআই বশির আহম্মাদ পারিবারিক কাজে ঢাকায় এলে তাকে ‘ম্যানেজ করতে’ কক্সবাজার থেকে বিমানে করে ঢাকায় উড়ে আসেন আরেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা এসআই মো. মাসুদ রানা। ইয়াবার বিশাল লট বিক্রির ঘটনা ধামাচাপা দিতে তিনি টাকা দিয়ে বশির আহম্মাদের মুখ বন্ধ করতে সচেষ্ট হন। এ নিয়ে দুই কর্মকর্তার মধ্যে একপর্যায়ে শুরু হয় বাগ্বিত-া। পরবর্তীতে সেখানে হাজির হয় থানা পুলিশও। দুই কর্মকর্তার বাগ্বিত-ার একটি অংশ ধারণ করা হয় আমাদের সময়ের গোপন ক্যামেরায়।

চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ওই ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, এসআই মাসুদ রানা বলছেন, ‘আমি নিজের কাজে আসি নাই। আমাকে স্যার পাঠিয়েছেন।’ জবাবে এসআই বশির আহম্মাদ বলছেন, ‘আমি চাকরি করব না। ইয়াবা বিক্রির টাকা নিয়ে এতকিছু হয়, দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে।’ বাগ্বিত-ার সময় দুজনই ছিলেন সাদা পোশাকে। এ সময় পুলিশের ইউনিফর্ম পরা এক কর্মকর্তাকে বলতে শোনা যায়, ‘সবাই প্যাঁচায়া গেছে। এখন সবাই বাঁচতে চায়।’ একটু থেকে তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা প্লিজ এখানে এভাবে চিৎকার করবেন না। পুলিশের ভাবমূর্তির বিষয় এটা। আপনারা থানায় চলুন।’

আইজিপি কমপ্লেইন্টস মনিটরিং সেল ও কক্সবাজার পুলিশ সুপার (এসপি) বরাবর করা লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ২০১৭ সালের ২৭ অক্টোবর রাতে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থেকে ৭ লাখ ৩০ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করে ডিবি পুলিশ। পরদিন ৮ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার দেখিয়ে একটি মামলা করা হয়। উখিয়ার জয়নাল মেম্বারের মাধ্যমে কয়েক চালানে ইয়াবাগুলো বিক্রি করা হয়। কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সাবেক ওসি মনিরুল ইসলাম, এসআই কামাল হোসেন ও এসআই মাসুদ রানার বিরুদ্ধে ইয়াবা বিক্রির অভিযোগ আনা হয়েছে।

এ ঘটনাকালীন সময়ে এসআই বশির আহম্মাদ বদলি হন ফেনী জেলায়। গত বছরের ৮ নভেম্বর এসআই মাসদু রানা ফেনীতে যান বশির আহম্মাদকে ‘ম্যানেজ করতে’। সেখানে গিয়ে ফোনে ডিবির তৎকালীন ওসি মনিরুল ইসলামের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলেন এসআই মাসুদ রানা। তখন মনিরুল ইসলাম ফোনে বশির আহম্মাদকে বলেন, ‘তুই এইটা নিয়ে আর বাড়াবাড়ি করবি না। মুখ খুললে তোকেসহ তোর পরিবারকে ধ্বংস করে দেব। ইয়াবা বিক্রির আট কোটি টাকা আছে। দরকার হলে তোর আর তোর পরিবারের পেছনে এক কোটি টাকা খরচ করব। অন্য টিমের পরিদর্শক আরাফাতকে তিন লাখ টাকা দিয়েছি। তোর জন্য দুই লাখ টাকা পাঠালাম। এটা নিয়ে চুপ করে থাকবি। ইয়াবার অর্ধেক সোর্সকে দেওয়া লাগছে। তুই মনে রাখিস, মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত।’

তাতেও এসআই বশির আহম্মাদ ক্ষান্ত না হওয়ায় তার পূর্বের কর্মস্থলের দুটি মামলায় আদালতে নারাজি দিয়ে পুনঃতদন্ত শুরু করে কক্সবাজার জেলা ডিবি পুলিশ। এটি তার ওপর চাপ প্রয়োগ করতে করা হয় বলে মনে করেন বশির আহম্মাদ। তাকে যে কোনো অজুহাতে ফাঁসানো হতে পারে বলে উল্লেখ করে বশির আহম্মাদ অভিযোগে লিখেছেন, তিনি নিজে ও তার পরিবার নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

সর্বশেষ গত বছর ১৩ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় একটি মামলার সাক্ষী দিতে যান এসআই বশির আহম্মাদ। সেখান থেকে রাজধানীর রামপুরায় নিজের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে আসেন তিনি। খবর পেয়ে তাকে ম্যানেজ করতে ফের ঢাকায় আসেন এসআই মাসুদ রানা। কিন্তু বশির আহম্মাদ দেখা করতে না চাওয়ায় মাসুদ রানা তাকে বলেন, ‘ভাই এতদূর থেকে আসলাম। শুধু আপনার সঙ্গে দুপুরে খেয়েই চলে যাব।’ এর পর তিনি বশির আহম্মাদের রামপুরার বাসায় যান। সেখানে গিয়ে একটি ব্যাগ থেকে এক লাখ টাকা বের করে টেবিলে রাখেন। সেটি নিতে বলেন বশির আহম্মাদকে। এ সময় মাসুদ রানা বলেন, ‘স্যাররা আপনাকে টাকা দেওয়ার জন্য আমাকে বিমানে করে পাঠিয়েছেন।’ এর পরই শুরু হয় দুই কর্মকর্তার মধ্যে বাগ্বিত-া। এ সময় তাদের সব কথা গোপনে ধারণ করা হয়।

গোলমালের একপর্যায়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় রামপুরা থানার একটি টহল টিম। স্থানীয় ফাঁড়ি হয়ে তাদের থানায় নেওয়া হয়। সেখানে থানার ওসিও তাদের নিবৃত করতে ব্যর্থ হন। পরে তাদের নেওয়া হয় ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল বিভাগের ডিসির কার্যালয়ে।

দুজনের বাগ্বিত-ার ঘটনায় রামপুরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে পুলিশ। সেটির তদন্ত শেষে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন মতিঝিল বিভাগের ডিসির কাছে পাঠান রামপুরা থানার ওসি প্রলয় কুমার সাহা। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এসআই মাসুদ রানা এসআই বশির আহম্মাদের রামপুরার বনশ্রীর বাসায় গিয়ে তাকে কিছু টাকা দেন। কিন্তু টাকার পরিমাণ কম হওয়ায় গোলমাল শুরু হয়। দুজনেই সাবেক সহকর্মী এবং তারা একই সঙ্গে কাজ করতেন কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা পুলিশে। সেখানকার একটি লেনদেকে কেন্দ্র করে এই অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই বশির আহম্মাদ আমাদের সময়কে বলেন, এটি আমাদের (পুলিশের) অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। আপনার কাছে আমি কিছু বলতে পারব না। যা বলার সংশ্লিষ্ট তদন্ত কমিটির কাছে বলে এসেছি।

জানা গেছে, কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা পুলিশের আরও কয়েকটি অপরাধ কর্মকা- তুলে ধরা হয়েছে অভিযোগপত্রে। সেখানে আরও দুটি বিষয় রয়েছে মাদকসংক্রান্ত।

জানতে চাইলে ডিবির তৎকালীন ওসি মনিরুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, এসব বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। আমি কিছু বলতে পারব না। যারা এগুলো বলছেন, আপনি বরং তাদের জিজ্ঞেস করুন। তারাই ভালো বলতে পারবেন।

কক্সবাজারের এসপি ড. একেএম ইকবাল হোসেনের মোবাইল ফোনে কল করে সাড়া পাওয়া যায়নি। এর পর প্রতিবেদক তার পরিচয়সহ খুদেবার্তা পাঠালেও ওপাশ থেকে সাড়া মেলেনি। পরে জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আফরুজুল হক টুটুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘যেখানে-যেখানে যে-যে অভিযোগ তারা করেছেন, সেগুলোর তদন্ত সেখানে-সেখানে হচ্ছে। এটাই নিয়ম।’

সুত্র: দৈনিক আমাদের সময়

পাঠকের মতামত