
সুজাউদ্দিন রুবেল::
কক্সবাজারে ২১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ‘আইকনিক রেলস্টেশন’ চালু হয়েছে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। তবে এখনো যাত্রীদের জন্য পুরোপুরি খুলে দেয়া হয়নি স্টেশনের মূল ছয়তলা আধুনিক ভবনটি। ফলে নানা সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন যাত্রীরা। অনেকটাই অলস পড়ে আছে পুরো অবকাঠামো।
সরেজমিনে দেখা যায়, স্টেশনের সামনেই দৃষ্টিনন্দন ঝিনুকের ফোয়ারা। পেছনে চোখ জুড়ানো নির্মাণশৈলীর আইকনিক ভবন। কিন্তু ফোয়ারার চারপাশে এখনো বাঁশের ঘেরা। অনেক জায়গায় বাঁশের ঘেরা ভেঙ্গে গেছে। অপরদিকে স্টেশনের চারপাশে অসমাপ্ত নিরাপত্তা বেষ্টনী এবং ফেলে রাখা রড-পিলার যেন বলে দেয় কাজ এখনো শেষ হয়নি।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইকনিক স্টেশন নিমার্ণ প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা বলেন, “কক্সবাজার আইকনিক রেল স্টেশন ভবনসহ চকরিয়া থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ সেপ্টেম্বরে কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। আর বাকি ছোট-খাটো কিছু কাজ রয়েছে তাও দ্রুত শেষ হয়ে যাবে।”
যদিও বাণিজ্যিক ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে প্রায় দুই বছর আগে, তবে এখনো বন্ধ ছয়তলা ভবনটির দরজা। ফলে হোটেল, ফুড কোর্ট, শোরুম, মাল্টিপারপাস হলসহ নানা সুবিধা ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন না যাত্রীরা।
চট্টগ্রাম থেকে আসা যাত্রী আরিফুর রহমান বলেন, চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে চড়ে কক্সবাজার আইকনিক স্টেশনে সকাল বেলায় পৌছায়। যখন টয়লেটে যায় তখন দেখি অনেক মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। কমপক্ষে ১৫ জন মানুষ হবে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু পুরুষ টয়লেট হচ্ছে দুটি। আর স্টেশন ভেতরের সবকিছু বন্ধ। সবখানে লেখা আছে বন্ধ। এই হলো আইকনিক রেলস্টেশন ভবনের সেবা কার্যক্রম।
আরেক যাত্রী রিয়াজ আলম বলেন, “যারা ট্রেনের টিকিট করতে আসে তারা তো সবাই অ্যাপসে টিকিট করতে হবে তা বুঝে না। যারা বুঝে না তাদের জন্য স্টেশনে টিকিট করার জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখতে হবে। এখন কিন্তু এই স্টেশনে সেটি নেই। যার কারণে অনেক গ্রামের মানুষ দেখলাম টিকিট করা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন।”
ঢাকা যাত্রীর হায়দার আলী বলেন, আইকনিক স্টেশনটা খুবই সুন্দর হয়েছে। কিন্তু স্টেশনে ভেতরে তো সেই সেবা নেই। তার ওপর স্টেশনের বাইরে দেখছি ঝিনুকের ফোয়ারার চারপাশ বাঁশের বেড়া। এতো কোটি কোটি টাকা খরচ করে স্টেশন হয়েছে, কিন্তু নিরাপত্তা জন্য বাঁশের বেড়া। এটা তো হতবাক করার মতো।
আরেক যাত্রী সিরাজুল ইসলাম বলেন, বৃদ্ধ মানুষ ব্যাগ নিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়া খুবই কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু চলন্ত সিঁড়িগুলো বন্ধ। সুন্দর ভবন হলে তো হবে না, যাত্রীদের কষ্ট লাঘবের ব্যবস্থাও করতে হবে।
এদিকে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানায়, এই স্টেশন পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হলে প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকা খরচ হতে পারে। এত ব্যয়ভার নিজেদের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয় বলে স্টেশনটি তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে পরিচালনা করার পরিকল্পনা নিয়েছে রেলওয়ে। কোন পদ্ধতিতে সেটি ইজারা বা পরিচালনার জন্য দেওয়া হবে, তার প্রস্তুতির কাজ শেষ। ইতিমধ্যে রেলওয়ে একটি খসড়া রেলপথ মন্ত্রণালয়ের পাঠিয়েছে। সবকিছু চূড়ান্ত হলে দরপত্র আহ্বান করা হবে।
ঢাকা-কক্সবাজার রেললাইন উদ্বোধন হয়েছিল ২০২৩ সালের ১১ নভেম্বর। আনুষ্ঠানিকভাবে বাণিজ্যিক ট্রেন চলাচল শুরু হয় ১ ডিসেম্বর। বর্তমানে ঢাকা-কক্সবাজার রুটে ‘পর্যটক’ ও ‘কক্সবাজার এক্সপ্রেস’ নামের দুটি ট্রেন চলাচল করছে। এছাড়াও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে সৈকত ও প্রবাল এক্সপ্রেস নামের দুটি ট্রেন চলাচল করছে। এসব ট্রেন আসা এবং ছাড়ার সময় স্টেশনের নিচতলা খোলা হয়। ট্রেন চলে গেলে আবার বন্ধ হয়ে যায় স্টেশন।
এদিকে বৃহস্পতিবার দুপুরে স্টেশন ভবন পরিদর্শনে আসেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম। স্টেশন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং প্রকল্পের কাজ ঘুরে ঘুরে দেখেন।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম বলেন, কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশন আক্ষরিক অর্থেই একটি আইকনিক স্থাপনা। দেশের অন্যান্য সব রেলস্টেশন থেকে এটি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম ও অনন্য। এই স্টেশন ভবনটি দোহাজারি-কক্সবাজার রেলপথ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত হয়েছে এবং এটি নিঃসন্দেহে একটি চমৎকার স্থাপনা হিসেবে বিবেচিত।
তিনি আরও জানান, স্টেশনটিতে রয়েছে আধুনিক ও বহুমুখী সুবিধা-যার মধ্যে রয়েছে শপিং সেন্টার, আবাসন ব্যবস্থা এবং যাত্রীদের জন্য প্রয়োজনীয় সকল সেবা ও সুবিধা।
সচিব বলেন, এই স্টেশনকে কার্যকরভাবে ব্যবস্থাপনায় আনতে বিট ডকুমেন্ট বর্তমানে মন্ত্রণালয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাধীন। প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরামর্শের কাজ শেষ। আশা করা যাচ্ছে, শিগগিরই উপদেষ্টা কর্তৃক ডকুমেন্টটি অনুমোদন পাবে। এরপরই দরপত্র আহ্বান করা হবে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, আগামী ১ জানুয়ারি থেকে এটি লিজ আউট করা হবে, যার মাধ্যমে এটি একটি প্রাণবন্ত ও কর্মচঞ্চল কেন্দ্রে পরিণত হবে।
তিনি আরও বলেন, এই আইকনিক রেলস্টেশন একটি প্রাইভেট অপারেটরের মাধ্যমে পরিচালনা করা হবে। কারণ, রেলওয়ের নিজস্ব জনবল দিয়ে এই ধরনের স্টেশন পরিচালনার সক্ষমতা নেই। বিশ্বের অনেক দেশেই এই ধরনের বৃহৎ স্থাপনাগুলো বেসরকারি অপারেটরের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে থাকে, আমরাও সে মডেল অনুসরণ করছি।
এছাড়া, এই স্টেশনটি শুধু যাত্রীসেবাই নয়, রাজস্ব আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবেও ভূমিকা রাখবে বলে সচিব আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
আইকনিক স্টেশনে যা আছে-
কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশনটি আধুনিক নকশার ছয়তলা ভবন। এটি বাইরে থেকে বিমানবন্দর বা পাঁচতারা হোটেলের মতো দেখায়। সমুদ্রসৈকত থেকে স্টেশনটির দূরত্ব মাত্র ৩ থেকে সাড়ে ৩ কিলোমিটার।
ছয়তলা স্টেশন ভবনটির প্রতিটি তলায় রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সুযোগ-সুবিধা। ভবনটির গ্রাউন্ড ফ্লোরের আয়তন ৪৬,০৭৩ বর্গফুট। এখানে রয়েছে তিনটি দোকানের জায়গা, এটিএম বুথ, ডাকঘর, লাগেজ ও লকার রাখার ব্যবস্থা এবং ফ্রেশ হওয়ার সুবিধা। রেলের ব্যবহারের জন্য রয়েছে টিকিট কাউন্টার ও সরকারি অফিসের বিভিন্ন সেবা।
প্রথম তলার আয়তন ৪২,০৭৭ বর্গফুট। এই ফ্লোরে রয়েছে ১৭টি দোকানের জায়গা ও একটি ফুড কোর্ট। এ ছাড়া রয়েছে ডিপারচার লাউঞ্জ, ওয়েটিং লাউঞ্জ, ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন ডেস্ক, প্রোডাক্ট ডিসপ্লে সেন্টার এবং প্রার্থনা রুম।
ভবনটির দ্বিতীয় তলা ৩৫,৩২৫ বর্গফুট আয়তনের। এখানে ভাড়া দেওয়ার জন্য রাখা হয়েছে ১৭টি দোকানের জায়গা ও পাঁচটি শোরুম। এ ছাড়া রয়েছে ফুড কোর্ট ও রেস্টুরেন্ট।
তৃতীয় তলার আয়তন ৪৩,০৬৬ বর্গফুট। মূলত হোটেল সুবিধার জন্য নির্ধারিত এ তলায় মোট ৩৯টি রুম রয়েছে, যার মধ্যে ২৫টি স্ট্যান্ডার্ড এবং ১৪টি ডিলাক্স। এ ছাড়া রয়েছে চারটি কমার্শিয়াল স্পেস, রেস্টুরেন্ট ও ডাইনিং এরিয়া।
চতুর্থ তলা ৩৫,৭৩৪ বর্গফুট আয়তনের। এখানে রয়েছে সাতটি অফিস স্পেস, একটি মাল্টিপারপাস হল এবং একটি রেস্টুরেন্ট। পঞ্চম তলা ৩৬,৫৯২ বর্গফুট আয়তনের, যা মাল্টিপারপাস ব্যবহারের জন্য রাখা হয়েছে।
এ ছাড়া প্রতিটি তলায় সিঁড়ি, এসকেলেটর, বেবি কেয়ার কর্নার, টয়লেট এবং ইনফরমেশন ডেস্ক রয়েছে। ভবনের বাইরেও প্রশাসনিক ভবনসহ আরও ১৭টি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে।
২০১৮ সালের জুলাইয়ে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকার দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প শুরু হয়। সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত (ফাস্ট ট্র্যাক) এ প্রকল্পে কাজ করছে চীনের চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি), তমা কনস্ট্রাকশন, চায়না সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন করপোরেশন (সিসিইসিসি) এবং বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড। এই প্রকল্পের অংশ হিসেবেই ২১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশন নির্মাণ করা হয়।
২৯ একর জমির ওপর ২১৫ কোটি টাকার দৃষ্টিনন্দন এই অবকাঠামো শুধুই চোখের আরাম নয়- এর পুরো সম্ভাবনা কাজে লাগাতে প্রয়োজন দ্রুত এবং দক্ষ পরিচালনার। এখন দেখার বিষয়, তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে পরিচালনা কতটা বদলাতে পারে কক্সবাজার আইকনিক স্টেশনের চিত্র বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

পাঠকের মতামত