প্রকাশিত: ১০/১০/২০১৬ ৯:৪৯ পিএম

img-21শামীম ইকবাল চৌধুরী,নাইক্ষ্যংছড়ি::
চারদিকে পাহাড়, সবুজ বৃক্ষরাজির বনাঞ্চল। কক্সবাজারের রামুর শেষপ্রান্তে গর্জনিয়া ও কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের অবস্থান। শিক্ষাদীক্ষায় বরাবরই পিছিয়ে ছিল পুরো অঞ্চলটি। সেই অন্ধকারে আলো জ্বালাতে স্বপ্ন দেখেন বৃহত্তর গর্জনিয়ার জমিদার মরহুম আলহাজ্ব হাকিম মিয়া চৌধুরী। তিনি একটি বিদ্যালয় নির্মাণের উদ্যোগ নেন। তাঁর ছেলে বৃহত্তর গর্জনিয়ার প্রয়াত চেয়ারম্যান ইসলাম মিয়া চৌধুরীকে সাথে নিয়ে সংগঠিত করেন এলাকার লোকজনকে। ১৯৬৩ সালে গর্জনিয়ার বোমাংখিল গ্রামে নিজেই ৩ একর ২০ শতক জমি দানের মধ্য দিয়ে হাকিম মিয়া চৌধুরী গড়ে তুলেন গর্জনিয়া উচ্চ বিদ্যালয়। তখন আশপাশের ২৫ কিলোমিটার এলাকায় এটিই একমাত্র মাধ্যমিক বিদ্যাপীঠ।

এ জন্য বিত্তশালীরা দিয়েছেন অর্থ, কৃষক, দিনমজুরসহ খেটে খাওয়া মানুষেরা দিয়েছেন শ্রম। সবার সহযোগিতায় চার কক্ষের দুচালা একটি ভবন তৈরি হলো। শুরু হলো বিদ্যালয়ের কার্যক্রম। গুটি কয়েক শিক্ষার্থী ও শিক্ষক নিয়েই চলতে থাকে বিদ্যালয়ের পাঠদান। ধীরে ধীরে সচেতন হতে থাকে লোকজন। বাড়তে থাকে শিক্ষার্থী। এভাবেই ভরপুর হয় বিদ্যালয়। ১৯৭৫ সালে রূপ নেয় পরিপূর্ণ উচ্চ বিদ্যালয়ে। তবে ১৯৯১ সালের প্রলয়নকারী ঘুর্ণিঝড়ে ল-ভ- হয়ে যায় বিদ্যালয় ঘরটি। চারদিকে শুরু হয় স্বপ্ন ভঙ্গের সুর।

তখন দক্ষিণ চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কক্সবাজার রামু আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য আলহাজ্ব সাইমুম সরওয়ার কমলের পিতা প্রয়াত আলহাজ্ব ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী লোকজনকে সাথে নিয়ে গহীন বনে গিয়ে কাঠ সংগ্রহ এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল সংগ্রহ করে পুনরায় বিদ্যালয়ঘর নির্মাণ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। পরে গর্জনিয়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) পাঁচ বার নির্বাচিত সাবেক চেয়ারম্যান তৈয়ব উল্লাহ চৌধুরী এক কানি এবং শিক্ষাবীদ মরহুম আমির মোহাম্মদ বাচ্চু চৌধুরী বিদ্যালয়ের নামে এক কোনি জমি দান করেন। এখন দূর থেকে আলোর অন্বেষণে বিদ্যালয়ে ছুটে আসে সাত শতাধিক শিক্ষার্থী। স্কাউট এবং ক্রীড়া ক্ষেত্রেও এই বিদ্যালয়ের খ্যাতি রয়েছে। ক্রীড়া ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বিভাগে অন্যতম ও কক্সবাজার জেলা পর্যায়ে গর্জনিয়া উচ্চ বিদ্যালয় স্কাউট দল শ্রেষ্টত্বের মুকুট অর্জন করেন। সেই স্কাউট দলের সদস্যরা অংশ গ্রহণ করেছে জাম্বুরীতে। বর্তমানে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এ এইচ এম মনিরুল ইসলাম। তাঁর সহযোগী হিসেবে রয়েছেন তেরজন শিক্ষক।

এরা হলেন-সহকারী প্রধান শিক্ষক কায়সার জাহান চৌধুরী, সিনিয়র শিক্ষক মোঃ আবুল কাশেম, ফখর উদ্দিন, আসহাব উদ্দিন, মিল্টন দত্ত, মাওলানা আবু মুছা কুতুবি, সুকুমার বড়–য়া, সহকারী শিক্ষক রহিম উল্লাহ, সীমলা প্রভা দে ও অফিস সহকারী অসিত পাল। এছাড়াও খন্ডকালিন শিক্ষক হিসাবে পাঠদান করাচ্ছে বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র শিক্ষক আহমদ শাহ বাবুল, প্রাক্তন ছাত্রী ফরিজা বেগম ও শাবনুর জাহান। কর্মচারী হিসাবে আছেন-মোহাম্মদ ইউছুপ ও মোহাম্মদ হাশেম।

বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র সাংবাদিক হাফিজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন-প্রতিষ্ঠানটি না থাকলে আমরা আঁধারেই থেকে যেতাম। এটা প্রতিষ্ঠার পর গর্জনিয়া ও কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের মানুষের মনে আশার সঞ্চার হয়, সন্তানের পড়াশুনার স্থান খুঁজে পায় বাবা-মা। দিনে দিনে বিদ্যালয়টি অনেক বিস্তার লাভ করেছে। বর্তমানে বিশাল খেলার মাঠ, সীমানা প্রাচীর-এই বিদ্যালয়ের শৃঙ্খলিত পরিবেশ সবাইকে মুগ্ধ করছে। তবে উন্নয়নের ক্ষেত্রে সর্বতোভাবে সরকারি সহযোগিতা পেলে গর্জনিয়া উচ্চ বিদ্যালয় এগিয়ে যাবে বহু দূর।

সরেজমিনে দেখা যায়, বিদ্যালয়ে পৃথক তিনটি পাকা ভবন আছে। একটিকে দ্বিতীল ভবনে উন্নীতকরণের কাজ চলছে। অপরটি টিনের ছাউনি দেওয়া বেড়ার ঘর। খেলার মাঠ অনেক বড়। সীমানা প্রাচীরও খুব মজবুত। রয়েছে উন্নত মানের স্যানিটেশন ও বিশুদ্ধ পানিয় জলের ব্যবস্থা। তবে দ্বিতল আরেকটি ভবন ও কম্পিউটার ল্যাব নির্মিত হলে বিদ্যালয়ে পরিপূর্ণতা আসবে।

প্রধান শিক্ষক এ এইচ এম মনিরুল ইসলাম বলেন, ১৯৯২ সালে বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগ চালু করা হয়। এর আগে মানবিক ও ব্যবসা শিক্ষা শাখায় পড়াশোনা করতো ছাত্র-ছাত্রীরা। বর্তমানে সাত শতাধিক শিক্ষার্থীর পদচারণায় মূখর থাকে স্কুল প্রাঙ্গন। তন্মধ্যে পাশ্ববর্তী কচ্ছপিয়া ইউনিয়নের শিক্ষার্থী রয়েছে দেড় শতাধিক। বিদ্যালয়ে রয়েছে আলাদা আলাদা বিষয়ে দক্ষ শিক্ষক, বিজ্ঞানাগার ও লাইব্রেরী। যার ফলে পরীক্ষার ফলাফলও ক্রমাগতভাবে ভাল হচ্ছে। ২০১০ সালে পিএসসি ও বর্তমান সংসদ সদস্য কমলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ২০১৫ সালে বিদ্যালয়ে স্থাপিত হয় জেএসসি কেন্দ্র।

প্রধান শিক্ষক আরও বলেন, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের বর্তমান পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মোঃ মাহবুবু হাসান, শিক্ষা বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক সুমন বড়–য়া, বিদ্যালয় পরিদর্শক নাজিমুল ইসলাম ২০১৫ সালের ১১ নভেম্বর গর্জনিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের জেএসসি কেন্দ্র পরিদর্শনে এসে সীমানা প্রাচীর, খেলার মাঠ ও মনমুগ্ধকর পরিবেশ দেখে খুবই সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। এবং তাঁরা বলেছিলেন এই বিদ্যালয়ে অবশ্যই এসএসসি কেন্দ্র স্থাপন করা সম্ভব। আমরা এই আশা নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি। তা সম্ভব হলে বিদ্যালয়ের কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদেরকে আর পার্বত্য বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে গিয়ে এসএসসি পরীক্ষা দিতে হবে না। পাশাপাশি বিদ্যালয়ের জন্য আরও একটি দ্বিতল ভবন দরকার।

গর্জনিয়া উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি তৈয়ব উল্লাহ চৌধুরী বলেন-বিদ্যালয়টি এলাকার আলোর প্রদীপ। নানা সমস্যার মধ্যেও তা জ্বালিয়ে রাখতে লোকজনকে সাথে নিয়ে আমরা প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সাবেক রাষ্ট্রদূত মরহুম আলহাজ্ব ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরীর স্মৃতি বিজড়িত এই বিদ্যালয়টি আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবে এমন প্রত্যাশা করছি।

অনুসন্ধ্যান মতে, ঐতিহ্যবাহী গর্জনিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা করে আজ অনেকেই প্রতিষ্ঠীত। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-চট্টগ্রামের যুগ্ম জেলা জজ মোহাম্মদ আবু হান্নান, নোয়াখালীর সহকারী জজ মাইনুল ইসলাম লিপু, বান্দরবান জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকার পক্ষের কৌঁশলি (পিপি) ড.মহিউদ্দিন, আমেরীকা প্রবাসী মোঃ সাইফুল্লাহ চৌধুরী লেবু, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইকবাল, শিল্পপতি আবদুল মাজেদ সিকদার, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সহকারী কলেজ পরিদর্শক আবুল কাশেম মো.ফজলুল হক, কক্সবাজার জেলা আইনজীবি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতা এড.আয়াছুর রহমান, ডা. শাহ আলম, বাইশারীর এড.আবুল কালাম, নাইক্ষ্যংছড়ি হাজী এম এ কালাম ডিগ্রী কলেজের অধ্যাপক জসিম উদ্দিন, কক্সবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের কালেক্টর মোহাম্মদ ইউনুছ, আদালতের বেঞ্জ সহকারী কলিম উল্লাহ প্রমূখ। এছাড়াও বর্তমানে এই বিদ্যালয়ের শত শত শিক্ষার্থী দেশের নানা প্রান্তের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করছে।

পাঠকের মতামত

৪০ ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থীকে বিনা বেতনে পড়াবে আহছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ৪০ জন করে ফিলিস্তিনি মেধাবী নারী শিক্ষার্থীকে বিনা বেতনে পড়ার ...

তাপপ্রবাহ: প্রাথমিকে ক্লাসের সময় কমলো, বন্ধ থাকবে প্রাক-প্রাথমিক

দেশজুড়ে চলমান তাপপ্রবাহের মধ্যে শ্রেণি কার্যক্রমের সময় এগিয়ে এনে রোববার থেকে খুলছে প্রাথমিক বিদ্যালয়। শ্রেণি ...

নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, এখন বিসিএস ক্যাডার

গল্প-আড্ডায় বিশ্ববিদ্যালয়জীবনটা উপভোগের সুযোগ আবদুল মোত্তালিবের হয়নি। দুপুর গড়ালেই তাঁকে ছুটতে হতো কাজে। অসচ্ছলতার কারণে ...